Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভোটের দায়িত্ব হাতিপোতায় শুনেই মনে পড়ল দেবদাসকে

প্রতিদিনের নির্ঝঞ্ঝাট শিক্ষকতার জীবনে আচমকা ছন্দপতন! ভোটের চিঠি এসেছে যে। শুরু হল চিন্তা। ভোটের জিনসপত্র গ্রহণ কেন্দ্র (ডিসিআরসি) কালনায়। শুরু হল প্রস্তুতি। ভোটের আগের দিন যাত্রা শুরু হল।

কৌশিক দে (প্রিসাইডিং অফিসার)
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০২:২১
Share: Save:

প্রতিদিনের নির্ঝঞ্ঝাট শিক্ষকতার জীবনে আচমকা ছন্দপতন! ভোটের চিঠি এসেছে যে। শুরু হল চিন্তা। ভোটের জিনসপত্র গ্রহণ কেন্দ্র (ডিসিআরসি) কালনায়। শুরু হল প্রস্তুতি। ভোটের আগের দিন যাত্রা শুরু হল। ডিসিআরসি-তে গিয়ে জানতে পারলাম আমাকে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব সামলাতে হবে। স্থান পূর্বস্থলী দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত হাতিপোতা গ্রাম। গ্রামের নাম শুনতেই এক লপ্তে মনে পড়ে গেল ছেলেবেলা থেকে জেনে আসা শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের কথা। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে এই গ্রামেরই কথা লেখা রয়েছে যে!

হাতিপোতার কথা বলতেই কয়েকজন বাসিন্দা চোখ গোল গোল করে বলেছিলেন, ‘‘গ্রামটা ভাল নয়’’। একরাশ চিন্তা চেপে বসল মাথায়। যাই হোক, চিন্তা নিয়েই ডিসিআরসি থেকে বেরিয়ে শুরু করলাম বাসের খোঁজ। বাস মিলতে মিলতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। কালনা থেকে সরু পিচ রাস্তা দিয়ে বাস এগোচ্ছিল। জানলার ধারে বসে দু’চোখ ভরে দেখে চলেছিলাম গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য। চোখটা সবে একটু লেগেছে এমন সময় দেখি অন্যান্য ভোটকর্মীরা উসখুস করছেন। কী হয়েছে? খোঁজ নিয়ে জানলাম সামনেই একটা সরু কাঠের সাঁকো রয়েছে। সকলের চিন্তা, বাসটা কী ভাবে যাবে ওই সরু সাঁকো দিয়ে? তবে শেষমেশ চালক অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে সাঁকোটা পের করে বাস নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে পড়লেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা সকলে।

বিকেল গড়িয়ে ততক্ষণে সন্ধে নেমেছে। এতক্ষণে ‘দেবদাসে’র গ্রামের সীমানায় পৌঁছলাম। এ বার চালক জানালেন, ‘‘আর বাস যাবে না।’’ অগত্যা নেমে পড়া। কিছুদূর যেতেই দেখি একটা প্রাচীন বটগাছ। গ্রামেরই এক ভদ্রলোক জানালেন, এই বট গাছটারও নাকি উল্লেখ রয়েছে শরৎচন্দ্রের লেখায়। আরও খানিক এগোতেই দেখি গ্রামের সীমান্তে একটা জমিদারবাড়ির ভগ্নাবশেষ। অবশেষে পৌঁছলাম হাতিপোতা অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলের ভোটকেন্দ্রে।

ভোটকেন্দ্রে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। সে আলোয় নিজের ছায়ার বেশি আর কিছু নজরে পড়তে পারে বলে মনে হল না। সমস্যার সমাধান করলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ব্যবস্থা করলেন আলো, ফ্যান আর খাবারেরও। ধুলোর মধ্যেই চাদর বিছিয়ে শুরু হল ভোটের প্রাথমিক কাগজপত্র পরীক্ষার কাজ। এ বার ঘুমনোর পালা। কিন্তু কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক হয় না। যদিও প্রাথমিক কিছু দুর্ভোগ ছাড়া তেমন কোনও সমস্যা হয়নি রাতে। আসলে ওই ‘গ্রামটা ভাল নয়’ কথাটাই বারবার যেন ঘুরেফিরে কানে বাজছিল।

রাতে ঘুম হল না। ভোর রাতেই উঠে পড়লাম। চারদিকে চেয়ে দেখি গ্রামটার প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভাল করে দেওয়ার মতো। চলে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। শুরু হল ভোট। ভোর ৬টা থেকেই লম্বা লাইন বুথের সামনে। সবই ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। আচমকা ভেসে এল গোলমালের শব্দ। সঙ্গে ‘মার মার’ আওয়াজ। দেখি মোটা লাঠি হাতে কয়েকজন ছুটে আসছেন। ভয়ে প্রাণ হাতে চলে আসার মতো! ভাবলাম, দেবদাসের মতো এই গ্রামে আমাদেরও ভবলীলা সাঙ্গ হয় কিনা!

এ বার দেখলাম কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতা। তিন জন জওয়ান ভোটকেন্দ্রের গেটে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লেন। চলে এল আরও বাহিনী। গোলমাল বড় আকার নেওয়ার আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেন বাহিনীর জওয়ান ও রাজ্য পুলিশের কর্মীরা। কড়া পাহারায় ফের শুরু হল ভোটগ্রহণ। ফের সমস্যা। বিদ্যুৎ চলে গেল। শেষমেশ টর্চ জ্বালিয়ে বিপত্তি সামলানো গেল।

সব মিটিয়ে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম রাতে। তবে বাড়ি ফিরেও এ বারের ভোটে দু’জনের কথা বড্ড মনে পড়ছে। এক বৃদ্ধা ভোট দিতে এসেছিলেন, যাঁর বয়স একশোর আশেপাশে। আরও একজনের কথা, একটি যুবক যিনি ওই গোলমালের মাঝে পড়ে জখম হয়েছিলেন। দেবদাসের গ্রামে এমন আক্রোশের ছবিটা দেখব বলে আশা করিনি।

(লেখক আটাঘর তাজপুর হাই মাদ্রাসার শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

presiding officer assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE