Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘ডিজিট্যাল বাগদা’র স্বপ্নের সঙ্গে এ বার টক্করে বিরোধী

সেটা ২০০৬ সাল। বামেদের ভরা বাজার। বিধানসভা ভোটে তৃণমূল মেরেকেটে ৩০টি আসন পেয়ে কোনওমতে প্রধান বিরোধী দলের তকমাটুকু পেয়েছে। ও দিকে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর সেই হুঙ্কার, ‘আমরা ২৩০, ওরা ৩০’— শুনে তোলপাড় বাংলা। সেই বাজারেও বাগদা আসনে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল।

সীমান্ত মৈত্র
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১১
Share: Save:

সেটা ২০০৬ সাল। বামেদের ভরা বাজার। বিধানসভা ভোটে তৃণমূল মেরেকেটে ৩০টি আসন পেয়ে কোনওমতে প্রধান বিরোধী দলের তকমাটুকু পেয়েছে। ও দিকে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর সেই হুঙ্কার, ‘আমরা ২৩০, ওরা ৩০’— শুনে তোলপাড় বাংলা। সেই বাজারেও বাগদা আসনে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। জয়ের কাণ্ডারী, দুলাল বর।

কিন্তু ‘দিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ কয়েক বছরের মধ্যেই দলের অন্দরে নানা আড়াআড়ি সমীকরণের মধ্যে পড়ে দলনেত্রীর বিশ্বাস কমল তাঁর উপরে। ২০১১ সালে বাগদায় ভোটের টিকিট পেলেন উপেন বিশ্বাস।

‘বহিরাগত প্রার্থী’কে শুরু থেকেই মেনে নিতে পারেননি দুলালবাবু ও তাঁর অনুগামীরা। ফল যা হওয়ার তাই। ক্রমে ক্রমে দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ল দুলালের। উপেনবাবুর সঙ্গে আকচাআকচির নানা রসাল খবর চতুর্দিকে। পরপর কয়েকটি ভোটে একেবারেই বসে গেলেন দুলাল। ২০১৫ সালে লোকসভার উপনির্বাচনের দিন সকালে নিজের জমিতে কোদাল চালাতে দেখা গেল তাঁকে।

তার কিছু দিন আগে থেকে মুকুল রায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে নানা জল্পনা স্থানীয় রাজনীতিতে। কালীঘাটের সঙ্গে তখন মুকুলের দূরত্ব বিস্তর। শেষমেশ ‘দলবিরোধী কাজ’-এর জন্য বহিষ্কৃতই হলেন দুলাল। কিছু দিন সব চুপচাপ। মাঝে তাঁকে খুনের চক্রান্তের অভিযোগও তুললেন দুলাল, অভিযোগের তির উপেন-ঘনিষ্ঠ এক যুব নেতার দিকে।

ধীরে ধীরে ভোট যত এগিয়ে এল, দুলালবাবুর ঘনিষ্ঠতা বাড়লে লাগল কংগ্রেস শিবিরের সঙ্গে। এমনিতে বাগদায় কংগ্রেসের তেমন প্রভাব কোনও কালেই ছিল না। কিন্তু দুলালবাবু আচমকাই তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে নিয়ে যোগ দিলেন ওই দলেই।

তত দিনে আবার রাজ্যে কংগ্রেস-বামেদের জোট দানা বেঁধেছে। বাগদা আসন ফরওয়ার্ড ব্লককে ছেড়ে রাখা হয়েছে। প্রার্থীও ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস তো বটেই, সিপিএম-ফরওয়ার্ড ব্লকের বড় অংশই চাইছিল, এলাকার পুরনো বিধায়ক দুলালই এ বার বিরোধী জোটের মুখ হোন বাগদায়। পরে আরও একবার প্রার্থী বদল করেও শেষমেশ পিছু হঠে ফরওয়ার্ড ব্লক। কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে দুলাল বরের নাম ঘোষণা হয়।

এ বার গোটা ব্যাপারটা দাঁড়াল সেয়ানে সেয়ানে, বলছেন বাগদাবাসী। দুলালবাবু রাখঢাক না রেখেই বলছেন, ‘‘আমাদের লড়াই যতটা না তৃণমূলের বিরুদ্ধে, তার থেকেও বেশি ব্যক্তি উপেন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে।’’ প্রচারে বেরিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যত না আক্রমণ শানাচ্ছেন দুলাল, উপেন বিশ্বাসের নামে কড়া কড়া কথা বলছেন আরও বেশি। বলছেন, কী ভাবে দলে ‘নূন্যতম সম্মান’টুকু না পেয়ে তাঁরা হতাশ হয়েছিলেন। উপেনবাবু কাউকে যোগ্য মর্যাদাটুকু দিতে জানেন না।

তবে আর কাউকে মর্যাদা দিন বা না দিন, ২০১১ সালে ভোটের আগে বাগদার কৃষককে মর্যাদা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন উপেন।

মেঠো পথ ধরে একদিন প্রচার সারছেন। এক চাষা মাথায় টোকা পড়ে ছুটতে ছুটতে এসে উপেনবাবুর গাড়ি আটকালেন। প্রাক্তন সিবিআই কর্তার সামনে হাত জোড় করে আর্জি জানালেন, ‘‘আপনি আমাদের দালান দিতে পারবেন না জানি। কিন্তু আমাদের একটু মর্যাদা দেবেন।’’

অঙ্গীকার করেছিলেন উপেনবাবু। সেই থেকে সেই চাষির কথা মাথায় রেখে মাথায় তালপাতার টোকা পরা শুরু করেন। বিধানসভা, মন্ত্রিসভার বৈঠকেও যান টোকা-শোভিত হয়ে।

কিন্তু এ না হয় হল চাষির সম্মানের কথা। দলের নেতা-কর্মীদের একটা অংশই যে বার বার তাঁর জন্য অসম্মানিত হয়েছেন বলে অভিযোগ, তা নিয়ে কী বলেন উপেন?

মেজাজী মানুষটি থেমে থেমে বললেন, ‘‘আমার জন্য এলাকায় পাচার বন্ধ হয়েছে। দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হয়েছে। সে সব অনেকের সহ্য হচ্ছে না বলে এ সব কথা উঠছে।’’

তৃণমূলের টিকিটে ভোটে দাঁড়ালেও নিজেকে আদ্যোপান্ত বামপন্থী বলতেই ভালবাসেন উপেন। বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে বামপন্থীদের মধ্যে যে আদর্শ দেখেছি, তা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু এখন ওরা সে সব হারিয়ে ফেলেছে।’’

বিরোধীরা তুলছে সন্ত্রাসের অভিযোগ। উপেনবাবু সে সব নস্যাৎ করছেন। বলছেন, ‘‘এলাকায় শান্তি ফিরেছে। তা ছাড়া, আমার কার্যকালে কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, এমন একটা উদাহরণ দেখাক ওরা।’’

এত সবের মধ্যে এলাকার উন্নয়নের খতিয়ান কি তবে প্রচারের তালিকায় পিছিয়ে পড়ল? বাগদার মানুষের গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা বলে, উন্নয়নের থেকেও ব্যক্তি উপেন আর দুলালের তরজাই আসর জমাচ্ছে।

যদিও মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাস্তাঘাট, জল— এ সবের কাজ কিছু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও ভাবাচ্ছে। বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে আজও অপারেশন থিয়েটার চালু হল না। যদিও তৃণমূল প্রার্থীর দাবি, ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালের পরিকাঠামো অনেকটাই উন্নত হয়েছে। তাঁর উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ভ্রাম্যমান চিকিৎসাকেন্দ্র। পাঁচ বছরে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ যেখান থেকে চিকিৎসা পেয়েছেন।

তবে এলাকায় বিধায়ককে তেমন দেখা যায়নি এই ক’বছরে, অভিযোগ আছে উপেনবাবুকে নিয়ে। যার জবাবে তিনি বলছেন, ‘‘মন্ত্রিত্ব সামলে আমার পক্ষে মাসে পনেরো দিন এলাকায় আসা সম্ভব হয়নি, তা ঠিক। তবে পাঁচ বছরে আমি হেঁটে এলাকার প্রায় ৭০০ কিলোমিটার পথ ঘুরেছি।’’

বাগদাকে ‘ডিজিট্যালাইজেশন’ করার বাসনা আছে উপেনবাবুর। জানালেন, যখন প্রথমবার প্রার্থী হয়েছিলেন, এলাকায় খুঁজে কারও ই-মেল অ্যাকাউন্ট পাননি। সেই বাগদায় এখন ওয়াইফাই জোন তৈরি হয়েছে গাঁড়াপোতা বাজারে। বিনা খরচে নেট পরিষেবা মিলছে সেখানে। যাকে কেন্দ্র করে বাগদার তরুণ প্রজন্মের উৎসাহ এখন নেট-জগতেও। স্পোকেন ইংলিশ, কম্পিউটার শেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে নিখরচায়। তারই সূত্রে বেড়েছে কর্মসংস্থানও। আইটিআই কলেজ হয়েছে। কৃষি শ্রমিকদের জন্য তৈরি হয়েছে ‘কৃষিকল্যাণ কেন্দ্র।’ কৃষিপ্রধান বাগদায় তৈরি হয়েছে কিসান মান্ডি।

অন্য দিকে, স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ার কথা বলে ভোট চাইছেন দুলাল। বলছেন, যে কোনও পরিস্থিতি, আপদে-বিপদে তাঁকে পাশে পাওয়া যাবে। আরও বলছেন, চিটফান্ড কেলেঙ্কারির কথা। এমনিতে সারদা ছাড়াও আর প্রায় কুড়িটির মতো ছোটখাট বেআইনি লগ্নিসংস্থার খপ্পরে পড়ে বাগদার বহু মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। প্রায় তিনশো কোটি টাকা সংস্থাগুলি লুঠ করেছে বলে অভিযোগ। ভোটের ঠিক আগে বাগদায় হাওয়া সরগরম নারদ-কাণ্ড নিয়েও।

পরিসংখ্যান বলছে, বাগদায় বহু দিন ধরেই তৃণমূলের দাপট। পঞ্চায়েত সমিতি তাদের দখলে। ব্লকের ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৭টি শাসক দলের। গত বিধানসভা ভোটে উপেনবাবু জিতেছিলেন ২০ হাজার ৯৫৬ ভোটে। লোকসভা ভোটে বাগদা থেকে তৃণমূল প্রার্থী কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর এগিয়েছিলেন ২২ হাজার ৮৭৩ ভোটে। সেই ব্যবধান আরও বাড়ে গত বছর লোকসভার উপনির্বাচনে। সে বার তৃণমূল প্রার্থী মমতাবালা ঠাকুর বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এগিয়ে ছিলেন ৩১ হাজার ৪২৪ ভোটে। ওই ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী কুন্তল মণ্ডল পেয়েছিল মাত্র ২ হাজার ৬৩৯টি ভোট। কংগ্রেস ও সিপিএম প্রার্থী ভোট যোগ করলেও তৃণমূল প্রার্থী এগিয়ে ছিলেন অনেকটাই।

বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী সুব্রত ঠাকুর পেয়েছিলেন ৫১ হাজার ২৯৮টি ভোট। বিজেপির সেই হাওয়া এখন নেই। তা ছাড়া, বিজেপি প্রার্থী বিভা মজুমদারকে নিয়ে স্থানীয় বিজেপির অন্দরেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

যদিও বিভাদেবীর কথায়, ‘‘এখানে যারা জোটবদ্ধ হয়েছে, তাদের কেউ কেন্দ্র থেকে বিতাড়িত। কেউ আবার বাংলা থেকে বিতাড়িত। এই জোট মানুষ ভাল ভাবে নিচ্ছেন ’’ আর উপেনবাবু সম্পর্কে বিজেপি প্রার্থীর মূল্যায়ণ, ‘‘উনি গুণী মানুষ। কিন্তু পাঁচ বছরে এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিল না।’’

উপেন-দুলাল লড়াইয়ের ফাঁক গলে জয়ের আশা দেখছেন তিনিও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bagda Assembly Election 2016 Congress CPM TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE