শিলিগুড়িতে দুই প্রতিবাদী, টুম্পা ও মৌসুমী কয়াল।—ফাইল চিত্র।
শিলিগুড়িতে প্রচারে বেরিয়ে আগে একটা বাড়িতে গেলাম। পরিবারটি যে তৃণমূলপন্থী বা চিরকালই বামেদের ভিন্ন মেরুতে, তা জানতাম। তবু গেলাম। গৃহকর্ত্রী বেশ অবাক করে দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। তার পর ছদ্ম অনুযোগের সুরে জানালেন, আমার জন্য তাঁর টেলিফোন বিল বেশি এসেছে। আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘কেন?’’ তিনিও হেসে জবাব দিলেন, ‘‘আপনার নামে তৃণমূলের লোকজন যাচ্ছেতাই বলছে। আমার খুব খারাপ লেগেছে। তাই আমার পরিচিত লোকজনকে ফোন করে এ সবের প্রতিবাদ করেছি। আপনার হয়ে কথা বলেছি। দু’হাজার টাকার বেশি বিল জমা দিতে হয়েছে।’’
কামদুনির দুই প্রতিবাদী মৌসুমি কয়াল এবং টুম্পা কয়ালকে আমরা শিলিগুড়িতে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। তা নিয়ে আমাদের সমালোচনা করছিল তৃণমূল। যে ভদ্রমহিলার কথা আগে বললাম, তিনি এই সমালোচনা সহ্য করতে পারেননি। বলছিলেন, ‘‘মৌসুমি-টুম্পাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য আপনার নিন্দা করছে এরা? কী চায় এরা? তা হলে কি মৌসুমি-টুম্পাদের বদলে ধর্ষকদের সংবর্ধনা দেওয়া উচিত ছিল?’’
ঘরে ঘরে ঠিক এ ভাবেই ফুঁসছেন মানুষ। জনমত এই ভাবেই ঘুরে গিয়েছে তৃণমূলের বিপরীতে। চির কাল বামেদের বিপরীত মেরুতে থেকে এসেছেন যাঁরা, তাঁরাও তৃণমূলকে হারানোর জন্য বামেদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এ বার। তাই এ বারের লড়াই শুধু আমাদের লড়াই নয়। রাজ্যের মানুষের লড়াই। যাঁরা ন্যূনতম গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁদের সকলের একজোট হওয়া দরকার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দরকার। এ বারের ভোটের লড়াই তাই শুধু হারজিতের অঙ্ক নয়। আমরা মনে করছি এটা আরও বড় একটা রাজনৈতিক লড়াই। মানুষের এই লড়াইকে সম্মান জানাতে আমরা দলীয় স্বার্থ ভুলেই এগিয়েছি। কোন দলের সঙ্গে কোন দল জোট গড়ল সেটা এই নির্বাচনে বড় কথা নয়। বাংলায় এ বার এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষ মনে মনে মহাজোট গড়ে নিয়েছেন। তাই সময়ের দাবি মেনেই সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক মঞ্চে আসতে হত এই নির্বাচনে।
২০০৬-য় অশোক ভট্টাচার্যের হয়ে শিলিগুড়ি ভোটপ্রচারে গিয়েছিলেন ভাইচুং।
এ বার তাঁর বিরুদ্ধেই তৃণমূলের প্রার্থী তিনি।—ফাইল চিত্র।
এই ঐক্যবদ্ধ লড়াই আমরা কিন্তু শুরু করেছি অনেক আগেই। চা-বাগানের সমস্যা নিয়ে সিপিএম এবং কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন-সহ মোট ২৬টি ট্রেড ইউনিয়নকে নিয়ে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম। গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে থেকেছি। সাড়াও পেয়েছি। তৃণমূল আর বিজেপির শ্রমিক সংগঠন এই আন্দোলনে ছিল না। এই বিরোধী ঐক্য তৃণমূলের সহ্যও হচ্ছিল না। বামপন্থীদের ডাকে সবাই একজোট হচ্ছিল। তাই আমাদের মারও খেতে হয়েছে। কিন্তু আমরা মার খেয়েছি, বলে আমরা ভোটে বেশি আসন নেব, অন্যদের ছিটেফোঁটা দেব, এমনটা আমরা করছি না। প্রথমত, বড় দলকে সব সময়েই স্বার্থত্যাগ করতে হয় অন্যদের চেয়ে বেশি। আর দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের বিরুদ্ধে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক আমরা দিলেও, কংগ্রেস তাতে খুব ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। চা বাগানের আন্দোলন থেকে শুরু করে শিলিগুড়ির পুর নির্বাচন— সর্বত্র কংগ্রেস কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে রুখতে।
এ বারের লড়াইটাকে যে আমরা একেবারেই অন্য চোখে দেখছি, সেটা আমাদের ইস্তাহার দেখলেই বোঝা যায়। কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতাকে যে আমরা মানুষের ইচ্ছা এবং সময়ের দাবি হিসেবেই দেখছি, তা আমাদের ইস্তাহারেই স্পষ্ট। অন্যান্য বছর ইস্তাহারে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের ডাক দেওয়া হয়। সেই আহ্বানে ভর করে রাজ্যে পর পর সাত বার সরকার গড়েছে বামফ্রন্ট। এ বার অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠনের ডাক দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইস্তাহারে তা বলা হয়নি। ইস্তাহারে বামপন্থী, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়েছে। সেই শক্তির সরকার গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
শিলিগুড়ি পুর-নিগম জয়ের পর।—ফাইল চিত্র।
একটা বিষয় লক্ষ করবেন, ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে পথেঘাটে, ট্রেনে-বাসে, হাটেবাজারে আলোচনায় কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছিল, তৃণমূলের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে একটা। এ বার কিন্তু কোথাও সেটা নেই। স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার সুর এ বার সর্বত্রই তৃণমূলের বিরুদ্ধে। কাজ, করেছি, উন্নয়ন করেছি, রাস্তা করেছি, ব্রিজ করেছি বলে তৃণমূল যতই চিৎকার করুক, সাধারণ মানুষ এ বার তাতে খুব বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন না। কারণ, মানুষ ঔদ্ধত্য পছন্দ করে না। এই ঔদ্ধত্যই এ বারের নির্বাচনে খুব বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে। মানুষ একটা তুলনা করার সুযোগ পেয়েছে। বামফ্রন্ট আমলের সঙ্গে তৃণমূল জমানার তুলনা। দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে আমাদের মধ্যে কি ঔদ্ধত্য আসেনি? এসেছিল। ভুলভ্রান্তি কি হয়নি? হয়েছিল। তার জন্যই ক্ষমতা থেকে আমাদের সরে যেতে হয়েছিল। ২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সালে আমাদের সরকার যে পরিমাণ কাজ করেছিল, তা আর কখনও হয়নি। তবু হারতে হয়েছিল কেন? ঔদ্ধত্যের কারণে। কিন্তু তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা পাঁচ বছর ক্ষমতার অলিন্দে কাটিয়েই ঔদ্ধত্যে সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন। তাঁদের নিদারুণ বেপরোয়া আচরণে বাংলা অতিষ্ঠ। বাম আমলের সার্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে তৃণমূল জমানার সামগ্রিক অবস্থার তুলনা করার সুযোগ পেয়েছে মানুষ। তাতেই জনমত ঘুরে গিয়েছে তৃণমূলের বিপরীতে। শিক্ষাক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপ আমাদের সময়েও হয়েছে। স্বশাসিত সংস্থায় নাক গলানোর প্রবণতা সে সময়েও দেখা গিয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের জমানায় সে সব বল্গাহীন হয়ে গিয়েছে। ঔদ্ধত্যের সীমা নেই। অযাচিত হস্তক্ষেপের কোনও শেষ নেই। অকারণে নাক গলানোর প্রবণতায় কোনও রেশ নেই।
সাধারণ মানুষকে আমরা বলছি, আমাদের মিটিং-মিছিলে আসতে হবে না। যদি মনে করেন, তৃণমূলের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি, তা হলে নিজের মতো করে প্রচার করুন। নিজের পরিচিতির পরিসরে প্রচার করুন। তৃণমূলকে বিপদ হিসেবে কেন মনে করছেন, সেটা আপনার নিজের মতো করেই বলুন। এই ভাবে মুখে মুখে আরও বড় গণআন্দোলন ছড়িয়ে দিন গোটা বাংলায়।
দলের কর্মী-সমর্থকদের বলেছি, মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরতে হবে। সাধারণ মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, সেই ভাষায় কথা বলতে হবে। কঠিন-কঠোর সিপিএমের ভাষায় কথা বলার দরকার নেই। সে কথা সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy