Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আমি প্রার্থী! মুড়ি আটকে গেল গলায়

ঝমঝম করে গেদে লোকাল আড়ংঘাটার স্টেশন ছেড়ে যেতেই প্রথম আব্দারটা উড়ে এল— ‘‘বাবু, সিনিডা (চিনি) হালকা কইর‌্যা দিস, সঙ্গে দুইডা লেড়ো।’’

এক কাপ চায়ে...। দোকানে বাবুসোনা। — নিজস্ব চিত্র

এক কাপ চায়ে...। দোকানে বাবুসোনা। — নিজস্ব চিত্র

রাহুল রায়
রানাঘাট শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:২২
Share: Save:

ঝমঝম করে গেদে লোকাল আড়ংঘাটার স্টেশন ছেড়ে যেতেই প্রথম আব্দারটা উড়ে এল— ‘‘বাবু, সিনিডা (চিনি) হালকা কইর‌্যা দিস, সঙ্গে দুইডা লেড়ো।’’

উনুনে আঁচ পড়েছে সদ্য। পাকানো ধোঁয়ায় স্টেশন জুড়ে যেন বৈশাখের কুয়াশা। প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁষে কোমর সমান পাঁচিলের গায়ে লাল-হলুদ ডুরে। বয়ামে সার দিয়ে বাপুজি কেক, বোঁদের লাড্ডু, পাঁচ-সাত কিসিমের সস্তার বিস্কুট। ‘সরকার টি স্টল।’

গেদে লোকাল চলে গেলেই নিঝুম প্ল্যাটফর্মটা যেন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। জমে ওঠে বিকিকিনি। ঘুঘনি-রুটির ফরমাস হেঁকে কারও দাপুটে অর্ডার, ‘‘বাবু, ছ’টা দশের গাড়িটা ধরব কিন্তু। হাত চালা।’’ পরক্ষণেই উড়ে আসে মিহি গলার অনুরোধ, ‘‘লঙ্কা দিয়ে একটা ডবল-ওমলেট হবে নাকি ভাই?’

আড়ংঘাটা জাগছে।

চিনি কম, বেশি ঝালের প্রভাতী আব্দার সামলে দিনে দিনে কত কিছুই না শিখতে হল! এখন বিলক্ষণ জেনে গিয়েছেন, মিছিলে কোথায় চওড়া হাসি হাসতে হয়। কোথায় বা জোড় হাতে ঘাড় ঝুঁকিয়ে ‘একটু দেখবেন’ বলতে হয়। তিন সপ্তাহ আগেও অবশ্য রুটিন এমন ছিল না। জামার খুঁটে চশমার কাচ মুছতে মুছতে বাবুর স্মৃতিচারণ, ‘‘সে দিন মুড়ি খেতে খেতে টিভি দেখছি। দলের ক্যান্ডিডেট ঘোষণা করছেন বিমানদা (বসু)। রানাঘাট (উত্তর-পূর্ব), বাবুসোনা সরকার! বিশ্বাস করুন, গলায় মুড়ি আটকে গিয়েছিল!’’

সকাল থেকে চা-ঘুগনি, ঝাল-মিষ্টির মতো অজস্র দাবি সামাল দেওয়া বাবু দলের দাবিটুকুও সামলে নিয়েছেন। কাঁটাতারের গা ছুঁয়ে পাখিউড়া গ্রামে ভরদুপুরে প্রচারের ফাঁকে বললেন, ‘‘আসলে আড়ংঘাটা স্টেশনে আমাদের চায়ের দোকানটা একটা বিরাট মঞ্চের মতো, জানেন! গত ক’বছরে কত রকমের মানুষ যে দেখলাম! রাজনীতির অনেক পাঠই ওখান থেকে নেওয়া।’’

টিনের চালে গত বর্ষার ক্ষত, দেওয়ালে ঠেসানো পুরনো সাইকেল। বাড়ির সামনে মাটির উঠোনে ডাঁই করে রাখা দলীয় পতাকার উপরে খান তিনেক উচ্ছ্বল মুরগিছানা। ‘‘এই যা দেখছেন, ব্যাস। আর স্টেশনের ওই চায়ের দোকান। দিনে মেরে-কেটে শ’পাঁচেক টাকা রোজগার।’’এর বাইরে?

এ বার ভোটের ময়দানে সবচেয়ে ছেলেমানুষ (‌মোটে ছাব্বিশ) প্রার্থীটির জবাব, ‘‘আর কিছু নয়। শুধু দল। দশ বছরে সংগঠনের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছি....। এখন দল ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না!’’ অথচ রানাঘাট কলেজে পা রাখার আগে সিপিএম নিয়ে আলাদা ভাবে ভাবতে শেখেননি। বাবু বলছেন, ‘‘প্রচারে হাঁটতে হাঁটতে একটা দুপুরের কথা খুব মনে পড়ছে।’’ দশ বছর আগের সেই দুপুর, বাবা রঙ্গলাল ছেলেকে কাছে ডেকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন— ‘ঠাকুমাকে কানে কানে বলবি, ভোটটা যেন সিপিএম’কে দেয়!’

এ হেন তরুণ যে কলেজে ভর্তির দিন কয়েকের মধ্যে এসএফআইয়ের ডোরে বাঁধা পড়বেন, তা বুঝি সে দিনই কপালে লেখা হয়ে গিয়েছিল। কলেজের ছাত্র সংসদ, পরে সিপিএমের আড়ংঘাটা লোকাল কমিটির সম্পাদক। ক্রমে জোনাল সদস্য, পঞ্চায়েত সদস্য। এ বার একেবারে বিধানসভায় প্রার্থী?

বাড়িতে এ নিয়ে কিঞ্চিৎ আপত্তি উঠেছিল। দোকানে ডিম ফাটানোর ফাঁকে রঙ্গলাল অস্ফূটে বলেছিলেন, ‘‘প্রার্থী হয়ে গেলি একেবারে!’’ প্রতিবন্ধী বাবার চোখে আসল প্রশ্নটা পড়তে বাবুসোনার অসুবিধে হয়নি— তা হলে দোকান কে সামলাবে?

‘‘চায়ের দোকান তো কী হয়েছে? ওটাকে সামনে রেখে বড্ড সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু।’’— প্রসঙ্গ উঠতেই যিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, তিনি এই রানাঘাট উত্তর-পূর্বের বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক। সমীর পোদ্দার। এ বারও প্রার্থী হয়েছেন। পাঁচ বছর আগে প্রায় ৩২ হাজার ভোটে জিতে আসা সমীরবাবু ফাঁসিয়ে দিতে চাইছেন ‘সহানুভূতি’র ফানুস। প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘শুনেছি, বাবুসোনা অনেক দূর পড়াশোনা করেছে। নিশ্চয়ই তেমন দুঃস্থ নয়! না হলে পড়ল কী করে?’’ গত লোকসভা ভোটে এখানে বিজেপি প্রায় ২১% ভোট কুড়িয়েছিল। সে দলের প্রার্থী নিখিলরঞ্জন সরকারও চোখ পাকিয়ে বলছেন, ‘‘চায়ের দোকান চালিয়ে সংসার চলে কিনা, সেটা পরের ব্যাপার। লড়াই তো চায়ের দোকান নিয়ে নয়! বাবুসোনার সঙ্গে যুদ্ধটা রাজনৈতিক।’’ শুনে বাবুসোনা অনাবিল হাসছেন— ‘‘সত্যিই তো! আমার ছাপোষা চায়ের দোকান নিয়ে ওঁদের মাথাব্যথা থাকবে কেন?’’

সরকার টি স্টলের ঝাঁপ পড়ার সময় হল। এ বার হাটপাড়া থেকে মিছিল। বয়াম খুলে খান কয়েক লেড়ো বিস্কুট নিয়ে পকেটে পুরতে পুরতে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন বাবু। ‘‘খিদে পেলে কে দেখবে বলুন? আমাদের মতো হাড়-হাভাতেদের লড়াই তো আসলে খিদের সঙ্গেই। চলি দাদা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM Tea Stall assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE