Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ভূত ভাগিয়ে অবাধ ভোট

সাংবাদিক ডেকে ছাপ্পা, বেসুর হাওড়ায়

ও প্রান্ত থেকে কী বার্তা এল, তা শোনার উপায় নেই। তবে এ প্রান্ত থেকে দ্রুত ‘রান’ নেওয়ার নির্দেশ দিলেন হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ এবং হাওড়া উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল সভাপতি গৌতম চৌধুরী।

নম্বর জেনে নিয়ে চলছে ছাপ্পা। ইভিএম ঘিরে দাঁড়িয়ে তিন মূর্তি। হাওড়ার সালকিয়ার ১৩৮ নম্বর বুথে সোমবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

নম্বর জেনে নিয়ে চলছে ছাপ্পা। ইভিএম ঘিরে দাঁড়িয়ে তিন মূর্তি। হাওড়ার সালকিয়ার ১৩৮ নম্বর বুথে সোমবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

দেবাশিস দাশ ও সুকান্ত সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৪
Share: Save:

‘শর্ট রান শুরু করেছিস?’

ও প্রান্ত থেকে কী বার্তা এল, তা শোনার উপায় নেই। তবে এ প্রান্ত থেকে দ্রুত ‘রান’ নেওয়ার নির্দেশ দিলেন হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ এবং হাওড়া উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল সভাপতি গৌতম চৌধুরী। তৃণমূলের ক্রিকেটার প্রার্থী লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র হয়ে ভোট করানোর ‘গুরুদায়িত্ব’ তাঁরই কাঁধে।

দুপুর দু’টো। আমরা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে সালকিয়া স্কুল রোডে। একটু আগে খবর এসেছে, বাইক বাহিনী নিয়ে ‘ভোট’ করতে বেরিয়েছেন গৌতম। ওই পথ ধরেই তাঁর সদলবল আসার কথা। সালকিয়া স্কুল রোড ধরে এগোতেই হুগলি ডক-এর উল্টো দিকে একটি গলির ভিতর থেকে বাইক বাহিনী বেরোচ্ছে দেখে গাড়ি থামালাম। তাঁদের কয়েক জন আমাদের গাড়ির কাছে এসে উঁকিঝুঁকি দিলেন। প্রেসের বোর্ড আর ফোটোগ্রাফারের হাতে ক্যামেরা দেখে মোটরবাইক নিয়ে গলির ভিতর মিলিয়ে গেলেন।

ঠিক করলাম, একটু এগিয়ে সালকিয়া এ এস স্কুলে যাব। সেখানে আমরা পৌঁছনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা লাল অল্টো এসে থামল। সঙ্গে গোটা চারেক বাইকে জনা দশেক যুবক। অল্টো থেকে নামলেন সপার্ষদ গৌতম। মাথায় সাদা মেক্সিকান টুপি। সাদা জামা, খয়েরি জিনস। কাঁধে আলগোছে ফেলে রাখা সাদা তোয়ালে। আমাদের কাছাকাছি আসতেই ওঁর মোবাইলটা বেজে উঠল। ও প্রান্তের কথা শোনার পর গৌতমের প্রশ্ন, ‘‘সব ঠিক আছে তো? শর্ট
রান শুরু করেছিস? শুরু করে দে। আমি আসছি।’’

দ্রুত চারপাশ দেখে গাড়িতে উঠলেন গৌতম। পিছনে বাইক বাহিনী। আমরাও পিছু নিলাম। বড় রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ঢুকল গলিতে। এ-গলি ও-গলি হয়ে গাড়ি থামল ২ নম্বর বরো অফিসের সামনে।

গাড়ি থেকে নেমে গৌতম আমাদের দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পর একগাল হেসে বললেন, ‘‘ভেতরে যা হবে, তা এক মিনিটের মধ্যে দেখে চলে আসতে হবে কিন্তু। কোনও প্রশ্ন করা চলবে না।’’

অগত্যা! গৌতমকে অনুসরণ করে ঢুকলাম ১২৫ নম্বর বুথের ভিতরে। ঢোকার মুখেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা পথ আটকালেন। তৃণমূল প্রার্থীর মুখ্য নির্বাচনী প্রতিনিধির পরিচয়পত্র দেখিয়ে কয়েক জন সঙ্গীকে নিয়ে ঢুকলেন গৌতম। আমরা ঢুকলাম নির্বাচন কমিশনের পরিচয়পত্র দেখিয়ে। বুথে জোট বা বিজেপি, কোনও পক্ষেরই এজেন্ট নেই। শুধুই তৃণমূল এবং নির্দল। তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘নম্বর বল।’’ আর সঙ্গীদের প্রতি নির্দেশ, ‘‘নে, শুরু কর।’’ এজেন্টরা ভোটার তালিকা দেখে নম্বর বলতে শুরু করলেন, আর ইভিএম-এর সামনে দু’তিন জন শুরু করে দিল ভোট দেওয়া। ইভিএম-এর পিঁ-পিঁ শব্দ থামতেই চায় না!

একেই তো বলে ছাপ্পা ভোট! অনেক শুনেছি। কিন্তু নিজে চোখে কখনও দেখব ভাবিনি। ‘‘তাড়াতাড়ি সরে যান’’, কানে আসতেই সম্বিত ফিরল। ততক্ষণে সঙ্গী চিত্র-সাংবাদিক রণজিৎ নন্দী ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করে দিয়েছে চর্ম-চক্ষে দেখা ছাপ্পা ভোট। প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। মুহূর্তে গৌতমের সঙ্গীরা আমাদের এক রকম ঠেলেই বের করে দিল বুথ থেকে। নিজেরাও কয়েক জন বেরিয়ে এল। হয়তো ‘নজর’ রাখতে! প্রায় একই সঙ্গে বেরোলেন গৌতম নিজেও। সঙ্গীদের নিয়ে গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে বুথের কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন, ‘‘নাইন্টি পার্সেন্ট করে দিস।’’

এ বার গাড়ি ছুটল বাঁধাঘাটের দিকে। সঙ্গে দু’টি বাইক। বাকিরা চলে গেল। গৌতমের গাড়ি একটু এগিয়েই গলির মুখে থামল। হাতের ইশারায় ওঁকে অনুসরণ করতে বললেন। আধো-অন্ধকার একটি বাড়িতে ঢুকলাম। এখানে কী? গৌতমের জবাব ‘বুথ।’ ১৩৮ নম্বর। বুথে ঢুকে জনৈক যুবককে সিপিএম-এর এজেন্ট বলে পরিচয় করিয়ে গৌতমের প্রশ্ন, ‘‘কী কোনও অসুবিধে নেই তো?’’ তথাকথিত ‘সিপিএম এজেন্ট’ একগাল হেসে ঘাড় নেড়ে বার তিনেক বললেন, ‘‘না, না। সব ঠিক আছে।’’

অতঃপর গৌতমের নির্দেশে শুরু ছাপ্পা ভোট! এক ফাঁকে নিচু গলায় প্রিসাইডিং অফিসারকে প্রশ্ন করলাম, আপনি চুপ করে কেন? কাঁচুমাচু মুখে আরও নিচু গলায় তিনি শুধু বললেন, ‘‘আমি কিছু জানি না!’’ এখানেও মিনিট পাঁচেক থেকে ‘অপারেশন শর্ট রান’ শুরু করিয়ে বেরিয়ে এলেন নেতা। গাড়িতে ওঠার আগে বললেন, ‘‘রবিবার বুথে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসার পর থেকেই ভোট শুরু করে দিয়েছি। কী করে ভোট করতে হয়, তা আমরা জানি। বিরোধীদের কোনও সংগঠন নেই। উত্তর হাওড়ার রাস্তায় আপনারা কি বিরোধীদের দেখেছেন?’’ উত্তরের অপেক্ষাই করলেন না। লাল অল্টো হাওয়া হয়ে গেল সামনের রাস্তায়। হয়তো ভোট করাতে!

আমরাও গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসের পথ ধরলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE