Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভয় জয়ের উৎসবে মাতল মানুষ

এই তো সে দিন। পূর্ব মেদিনীপুরে প্রচারে এসে একের পর এক সভায় তোপ দাগলেন মুখ্যমন্ত্রী। হুমকির সুরে বললেন, ‘‘দিল্লির দালাল পুলিশ এখানকার ভিতু পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে।...আমি বুঝে নেব।...যারা (তাণ্ডব) করছে, তাদের রেকর্ড আমার কাছে আছে। যদি বেঁচে থাকি, প্রত্যেকটার উত্তর দিয়ে দেব।’’

আমার গণতন্ত্র... নন্দকুমারের একটি বুথে ভোটারদের লম্বা লাইন। বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

আমার গণতন্ত্র... নন্দকুমারের একটি বুথে ভোটারদের লম্বা লাইন। বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০০:৪৩
Share: Save:

এই তো সে দিন। পূর্ব মেদিনীপুরে প্রচারে এসে একের পর এক সভায় তোপ দাগলেন মুখ্যমন্ত্রী। হুমকির সুরে বললেন, ‘‘দিল্লির দালাল পুলিশ এখানকার ভিতু পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে।...আমি বুঝে নেব।...যারা (তাণ্ডব) করছে, তাদের রেকর্ড আমার কাছে আছে। যদি বেঁচে থাকি, প্রত্যেকটার উত্তর দিয়ে দেব।’’

অথচ সেই পূর্ব মেদিনীপুরেই শিরদাঁড়া সোজা রেখে ভোট করালো পুলিশ। যাঁরা ভোট দিতে পারছিলেন না, তাঁরা ভোট দিলেন যে পুলিশের জোরে, সেই পুলিশের হাতেই ঠ্যাঙানি খেলেন ‘বেগড়বাই’ করা বাহুবলীরা। আর শেষ দফা ভোটে জিতে গেলেন সেই মানুষই।

ভোট নির্বিঘ্ন করতে এ দিন সকাল পৌনে ৬টা থেকেই নিজের অফিসে চলে আসেন জেলা সুপার অলোক রাজোরিয়া। ছিলেন আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) জ্ঞানবন্ত সিংহ ও ডিআইজি (মেদিনীপুর রেঞ্জ) বাস্তব বৈদ্যও। দিনভর সরগরম ছিল পুলিশ সুপারের অফিস। দিনের শেষে রাজোরিয়া বলছেন, ‘‘কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া শান্তিতেই ভোট মিটেছে। এমনকী যে সব এলাকায় ঘরছাড়ারা ফিরেছিলেন, তাঁরাও ভোট দিতে পেরেছেন। বিভিন্ন গোলমালের ঘটনায় মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’

অশান্তির শুরুটা হয়েছিল একেবারে সকালে ময়না বিধানসভার সবচেয়ে স্পর্শকাতর বাকচায়। আড়ংকিয়ারানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিরোধী সমর্থকদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে পাঁচ তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আমিরুদ্দিনচক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেও গ্রেফতার করা হয় একজনকে। একই অভিযোগে ময়নার দক্ষিণ হরকুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছ থেকে দুই তৃণমূল সমর্থককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ময়নার সুদামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে জটলা। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর লাঠিচার্জে নিমেষে ফাঁকা হয়ে যায় বুথ। পূর্ব পাঁশকুড়া বিধানসভার গোপালগঞ্জ হাইস্কুল চত্বরে এক সিপিএম সমর্থককে বেধড়ক মারধর করা হয়। অভিযোগ পেয়েই তিন তৃণমূল সমর্থককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। কয়াডাঙ্গি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছেও তৃণমূলের জমায়েতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনী। তমলুকের জানুবসান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (৯৪ নম্বর বুথ) কাছে তৃণমূল কর্মীদের জমায়েতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। পালাতে গিয়ে পাকা রাস্তায় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে একজন।

জানা গিয়েছে, গোটা পূর্ব মেদিনীপুরে গ্রেফতার হয়েছেন মোট ২৮ জন, শুধু ময়নাতেই ১০ জন। তিনটি ঘটনায় এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ। দিনের শেষে নিট ফল— জেলা জুড়ে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন, শাসক দলের হুমকি অগ্রাহ্য করেই।

আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেসুরো বেজেছে তৃণমূল নেতাদের কথা। পূর্ব পাঁশকুড়ার তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী বিধায়ক বিপ্লব রায়চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনী আমাদের দলের কর্মী-সমর্থকদের উপর বিনা প্ররোচনায় লাঠি চার্জ করেছে। গ্রেফতার করেছে। আমি জেলা পুলিশ ও পর্যবেক্ষকে অভিযোগ জানিয়েছি।’’ এক ধাপ এগিয়ে ময়নার তৃণমূল ব্লক কার্যকরী সভাপতি সুব্রত মালাকার বলেন, ‘‘পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় জমায়েত সরানোর নামে আমাদের সমর্থকদের উপর লাঠি-চার্জ করেছে। এ নিয়ে আমরা নির্বাচন দফতরের কাছে একাধিক অভিযোগ জানিয়েছি।’’ দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, তৃণমূলের পক্ষ থেকে নির্বাচন দফতরের কাছে ২০টি অভিযোগ জানানো হয়েছে শুধুমাত্র ময়নায়। অধিকাংশই পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। রাজ্যের শাসক দল হয়েও পুলিশের বিরুদ্ধে এত নালিশ কেন? সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘১৪৪ ধারা জারি করে জমায়েত হটানোর নামে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী বেশ বাড়াবাড়ি করেছে।’’

শাসক দলের নেতাদের গলায় যখন এত অভিযোগের সুর, তখন বিরোধীরা পুলিশের নিরপেক্ষ ভূমিকার কথা মানছেন। জেলা সিপিএমের সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের কড়া পদক্ষেপে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট পেরেছে। কিছু এলাকায় তৃণমূলের বাধা সত্ত্বেও মানুষ তা অগ্রাহ্য করে ভোট দিয়েছে। পুলিশের ভূমিকা ভাল ছিল।’’

এ দিন বাহিনীর লাঠি থেকে রেহাই পাননি হলদিয়ার কাউন্সিলর থেকে তৃণমূলের যুব নেতা। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভবানীপুর রামকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৃণমূলের শেখ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বের জটলা পাকিয়েছিল তৃণমূল কর্মীরা। সরে যেতে বললেও কান দেননি তাঁরা। বাহিনীর জওয়ানরা লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করেন। লাঠির ঘায়ে শেখ আব্দুল কাদের-সহ মোট পাঁচজন জখম হন। যদিও কাউন্সিলেরর দাবি, “তিনি ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। অন্যায় ভাবে তাঁকে লাঠিপেটা করা হয়েছে।’’ ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের যুব তৃণমূল সভাপতি শ্রীকান্ত প্রামাণিককেও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা লাঠিপেটা করে। অভিযোগ, ওই ওয়ার্ডের যাদবচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের ভেতরে ঢুকে শ্রীকান্তবাবু ভোটারদের প্রভাবিত করছিলেন। ক্ষুদিরামনগরে ২৩১বুথের সামনেও জটলা সরাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা লাঠিচার্জ করলে বুথ তৃণমূলের সভাপতি অচিন্ত্য হাতি-সহ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

শ্রীকান্তবাবুর দাবি, “বয়স্ক এক ভোটারকে বুথে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভোট দেওয়া হলে তাঁকে নিয়ে বুথের বাইরেও চলে আসি। সে সময় বুথের বাইরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা আমাকে লাঠিপেটা করে।” শুধু বুথে নয়, হলদিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে বাহিনী। হলদিয়ার শাসকদলের প্রার্থী মধুরিমা মণ্ডলও অভিযোগ করেছেন, “সকাল থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা আমাদের নেতাকর্মীদের উপর অন্যায়ভাবে লাঠিচার্জ করেছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি।” যদিও বিরোধী জোটের আহ্বায়ক সিপিএমের শ্যামল মাইতি বলেন, “কোথাও ভোটদানে বাধা, কোথাও ভোট লুঠের চেষ্টা চলেছে। তবে সফল হয়নি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা ভাল ছিল। তাই মানুষ ভোট দিয়েছেন”

মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশ্য হুঁশিয়ারির পর তৃণমূলের গড় পূর্ব মেদিনীপুরে নির্বিঘ্ন ভোট করানো পুলিশের কাছে ছিল বড়সড় চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশের তৎপরতায় বড় কোনও অশান্তি ছাড়াই সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন। এর কৃতিত্ব পুলিশকেই দিয়েছেন বিরোধীরাও।

সাধারণ মানুষও বলেছেন, তাঁরা ভোট দিতে পেরেছেন। সুহাতাটার গোপালপুরের দুর্জয় মণ্ডল বলেন, ‘‘বুধবার রাতে বহিরাগতরা ভোটারদের প্রভাবিত করছিল। তার প্রতিবাদ করায় তৃণমূলের লোকজন মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তবে আমরা ভীত নই। এ দিন সপরিবারের ভোট দিয়েছি।’’ যদিও সুতাহাটার তৃণমূল নেতা আনন্দময় অধিকারী বলেন, ‘‘ওই এলাকায় সিপিএমের প্রভাব বেশি। মারধরের প্রশ্নই নেই। সিপিএম নাটক সাজিয়েছে।’’

এগরার ভোট দেখে দিনের শেষে খুশি ডান-বাম দু’পক্ষই। এই সে দিনও তৃণমূলে ছিলেন এগরার ডিএসপি প্রার্থী মামুদ হোসেন। এর আগে তৃণমূলের হয়ে কত ভোট করিয়েছেন। এ বার তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ সেই তৃণমূলই! সকাল থেকেই নির্বাচন কমিশনে একের পর এক অভিযোগ জানিয়েছেন। কখনও জানিয়েছেন বুথের সামনে শাসক দলের লোকেদের জটলা করে থাকার অভিযোগ, কখনও জানিয়েছেন তাঁর সমর্থকদের ভয় দেখানোর অভিযোগ। দিনের শেষে সেই মামুদের মুখেই তৃপ্তির হাসি। বলছেন, “যে সব অভিযোগ কর্মীদের কাছ থেকে এসেছিল, তাই কমিশনকে জানিয়েছি। ভোট ভাল হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সন্তোষজনক।” এরপরেই তিনি বলছেন, ‘‘তৃণমূলের একটা বড় অংশ আমাকে সমর্থন করছে। ভোটে এর প্রভাব পড়বেই।” এগরার তৃণমূলপ্রার্থী সমরেশ দাসও এ দিন বুথে বুথে চষে বেরিয়েছেন। ভোট কেমন চলছে, কর্মীদের কাছ থেকে সেই খোঁজখবর নিয়েছেন। দিনের শেষে সমরেশবাবুরও দাবি, ভোট খুব ভাল হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 East Midnapore CM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE