Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ভোট মরসুমে ‘জমে দই’ বন্দুক-বাজার

ছোট একটা পাহাড়ের আশপাশে অনেকটা ধু-ধু এলাকা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটা বাড়ি। পাহাড় বেড় দিয়ে চলে গিয়েছে রেললাইন। আসানসোলের সালানপুরে ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা ওই কানগুই পাহাড়ের কোলে হাসিপাহাড়ি গ্রামে কথা হচ্ছিল জনা তিনেক যুবকের সঙ্গে। শম্ভু, জয়, দেবুদের সৌম্য চেহারা। এক নজরে বোঝার উপায় নেই, তারা বেআইনি অস্ত্রের কারবারি।

সুশান্ত বণিক
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৩
Share: Save:

ছোট একটা পাহাড়ের আশপাশে অনেকটা ধু-ধু এলাকা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটা বাড়ি। পাহাড় বেড় দিয়ে চলে গিয়েছে রেললাইন।

আসানসোলের সালানপুরে ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা ওই কানগুই পাহাড়ের কোলে হাসিপাহাড়ি গ্রামে কথা হচ্ছিল জনা তিনেক যুবকের সঙ্গে। শম্ভু, জয়, দেবুদের সৌম্য চেহারা। এক নজরে বোঝার উপায় নেই, তারা বেআইনি অস্ত্রের কারবারি। শান্ত ভাবে জানতে চায়, “ওয়ান শটার চাইলে আজই পাবেন। নাইন এমএম পিস্তলও মিলবে। কী চান বলুন?”

বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকে রাজ্যের এই খনি-শিল্পাঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্র ঢোকে, এলাকাবাসী থেকে প্রশাসনের উপরমহল—কারও অজানা নয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে দেওয়া রিপোর্টে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ভোটের মুখে বোমা-বন্দুকের কারখানা এবং ভাঁড়ারে পরিণত হয়েছে কিছু জেলা। প্রশাসন সূত্রের দাবি, সে তালিকায় বর্ধমান আছেই। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছিল, যে পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, তাতে তারা খুশি নয়।

হাসিপাহাড়ি গ্রাম লাগোয়া এলাকা দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল বলেই জানেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ভোটের মুখে অস্ত্র ঢুকছে, আশপাশের এলাকা থেকে এমন খবর শুনে খোঁজ করতে যাওয়া হয়েছিল সেখানে। খানিক এ দিক-ও দিক খুঁজে হদিস মিলল বত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের ওই তিন যুবকের। পাহাড়ের কাছে নিরিবিলি একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে কথাবার্তা শুরু করল তারা। জানাল, বেচাকেনা সারা বছরই হয়। তবে এখন অস্ত্র কিনতে অনেক বেশি লোক আসছে। কারণ, সামনে ভোট।

—“সব ভোটের আগেই কি বন্দুকের চাহিদা বাড়ে?”

—“তা তো বাড়েই। বাজার সবচেয়ে ভাল থাকে পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে। তবে এ বার জোট বনাম ঘাসফুল। মানে চাপ আছে। তাই বাজার জমে দই।”

—“ঘাসফুল কি এ বার বেশি মাল কিনছে?”

—“তা কেন? ঘাসফুল চমকালে পাল্টা চমকানোর দরকার তো এ বার অন্য দুটো পার্টিরও। তবে কী জানেন, রুলিং পার্টির দিক থেকে বরাবরই বেশি কাস্টমার থাকে।”

কোথা থেকে আসে এই সব অস্ত্র? শম্ভুরা জানায়, বিহারের গয়া, ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া ও মিহিজাম থেকে আসে ওয়ান শটার। নাইন এমএম আসে বিহারের মুঙ্গের থেকে। ঝাড়খণ্ড হয়ে বারাবনি, সালানপুর, রূপনারায়ণপুর দিয়ে ঢুকে পড়ে এ রাজ্যে। কিছু অস্ত্র বীরভূম হয়ে অজয়ের পাণ্ডবেশ্বর ঘাট পেরিয়ে দুর্গাপুর-অন্ডাল পৌঁছে যায়। অন্য সময়ে ট্রেনে বা বাসের ছাদে চাল-গমের বস্তায় ভরে বা খড়ের লরির মধ্যে আনা হয়। কিন্তু ভোটের আগে নজরদারির কড়াকড়ি থাকায় সে ঝুঁকি নেওয়া হয় না। ঝাড়খণ্ডের দিক থেকে কয়লার বস্তায় ভরে পিঠে নিয়ে বা সাইকেলে চাপিয়ে পাচার করা হয়। রূপনারায়ণপুর স্টেশন থেকে খানিকটা দূরের ফাঁকা এলাকা বা অজয়ের ঘাট পেরিয়ে সালানপুর-বারাবনির কিছু গ্রামের নির্জন রাস্তা ধরে এখন আনা-নেওয়া চলছে।

কোন অস্ত্র বিকোচ্ছে বেশি?

-“ওয়ান শটার। দাম কম। একটা গুলি, কিন্তু অল্প পাল্লায় সাংঘাতিক কাজের। তাই ওটার স্টক রেডি থাকে। দেশি নাইন এমএমের ম্যাগাজিনে গুলি ধরে ছটা। চলে মাখন। কিন্তু দাম বেশি। চাইলে অর্ডার দিতে হবে। সাত দিনে পেয়ে যাবেন। ’’

দেবু-জয়রা জানাল, ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া সালানপুর, বারাবনির কয়েকটি গ্রামে বন্দুক মজুত রাখা থাকে। ‘কাস্টমার’ চাইলে সামান্য বেশি খরচে নিরাপদে ‘হোম ডেলিভারি’র গ্যারান্টিও দেওয়া হয়।

ভোট মরসুমে অস্ত্রের কারবারিদের এই দাপটের কথা অজানা নয় আসানসোলের সিপিএম নেতা বংশগোপাল চৌধুরীর। দলের অস্ত্র কেনার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘মিহিজাম-রূপনারায়ণপুর হয়ে শিল্পাঞ্চলে যে অস্ত্র ঢুকছে, তা পুলিশও জানে। আমরা ভোট ঘোষণার আগেই সে ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছি। পুলিশ-প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে ভোটের দিন রক্তপাতের আশঙ্কা থাকছেই।’’ একমত শিল্পাঞ্চলের কংগ্রেস নেতা চণ্ডী চট্টোপাধ্যায়। পক্ষান্তরে, আসানসোলের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের বিদায়ী মন্ত্রী মলয় ঘটকের বক্তব্য, “এলাকায় অস্ত্র ঢুকছে, এমন অভিযোগ আমার জানা নেই। তবে তৃণমূলকে ভোটে জেতার জন্য অস্ত্র কিনতে হয় না।”

পুলিশ কমিশনারেটের এডিসিপি (পশ্চিম) বিশ্বজিৎ মাহাতোর দাবি, ডিসেম্বর মাস থেকে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে শিল্পাঞ্চল থেকে প্রচুর বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘শুধু অভিযান নয়, এলাকায় বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ঢোকা রুখতে আমরা অজয় নদের বেশ কিছু ঘাটে এবং ঝাড়খণ্ড সীমানার চেকপোস্টে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসিয়েছি।’’

কিন্তু গ্রামের অলিগলি দিয়ে অস্ত্র ঢোকা আটকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? মুখে কুলুপ পুলিশ-কর্তাদের।

(সহ-প্রতিবেদন: নীলোৎপল রায়চৌধুরী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE