Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভরদুপুরে ক্যারম খেলে কর্মহীন কার্সিয়াং

অনেকদিন ধরেই মাথার মধ্যে ইচ্ছেটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই সুযোগ আসতেই এক কথায় হ্যাঁ বলে দিলাম। দার্জিলিং যাব, তবে এ বার শুধু পাহাড় দেখতে নয়। সঙ্গে থাকবে সেখানকার মানুষ, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাব বেশি করে। বুঝতে চেষ্টা করব পাহাড়ের মানুষজন কী ভাবেন সমতলের মানুষদের সম্পর্কে।

বাদশা মৈত্র
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ১৭:২১
Share: Save:

অনেকদিন ধরেই মাথার মধ্যে ইচ্ছেটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই সুযোগ আসতেই এক কথায় হ্যাঁ বলে দিলাম। দার্জিলিং যাব, তবে এ বার শুধু পাহাড় দেখতে নয়। সঙ্গে থাকবে সেখানকার মানুষ, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাব বেশি করে। বুঝতে চেষ্টা করব পাহাড়ের মানুষজন কী ভাবেন সমতলের মানুষদের সম্পর্কে। কলকাতায় বসে তাঁদের ভাল থাকার যে কথা সব সময় শুনতে পাই, তার বাস্তবতা ঠিক কতটা! এই রকম নানা ভাবনা মাথায় নিয়ে পৌঁছে গেলাম এনজেপি স্টেশন। সঙ্গে পুরো জার্নিটা শুট করার জন্য দু’জন ক্যামেরা পার্সন, অজয়দা আর অমিত। সুকনার জঙ্গল পার হয়ে রোহিনীর দিকে এগোতেই চোখ আটকে গেল রাস্তার ধারে একটা পোড়ো বাংলোর দিকে। ২০০৯-এ গোর্খাল্যান্ড-এর দাবিতে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এই বাংলো। তখন থেকে সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে এখনও। ঠিক উল্টো দিকেই ছোট চালা ঘরে থাকেন কয়েক ঘর নেপালি। চেওয়াং ইয়োমলো, সুর্যবাহাদুর তামাং, জিনা তামাং— এঁদের দিয়েই শুরু হল এ বারের কথোপোকথন।

সরাসরি জানতে চেয়েছিলাম, কেমন আছেন তাঁরা। ক্যামেরার সামনে কথা বলার প্রাথমিক জড়তা কেটে যেতেই বেরিয়ে এল একরাশ ক্ষোভ। অনেক দিনের জমে থাকা অভিমান। কমবয়েসী ছেলেরা বাইরে চলে যাচ্ছে কাজের খ‌োঁজে। স্থায়ী কোনও কাজ নেই বললেই চলে। একটা চাকরির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া জিনার কথায়: ‘‘চেষ্টা করতে হয়, তাই করছি। কিন্তু পরিস্থিতি খুব খারাপ।’’ সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘‘পাহাড়ে পর্যটনের উন্নতি নিয়ে সরকারের এত কথা শুনি, কিন্তু উল্টো দিকের বাংলোটা কেন এত দিনে সারিয়ে আবার চালু করা গেল না? গেলে তো কিছু মানুষ সেখানে কাজ পেতে পারত।’’ এই রকম নানা প্রশ্নে আমার প্রায় দিশেহারা অবস্থা। কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে ফিরে গেলাম গাড়িতে।

সমতলকে পিছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে চলল কার্সিয়াংয়ের দিকে। বাইরের তাপমাত্রা কমে এসেছে অনেকটা, ব্যাগ থেকে জ্যাকেটটা বের করে গায়ে চড়িয়ে নেমে পড়লাম কার্শিয়াং বাজারে। বেশ জমজমাট এলাকা, সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। মহেন্দ্র ছেত্রী স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাস্তাঘাটের অবস্থা নিয়ে খুব একটা খুশি নন। কিন্তু তার থেকেও বেশি রেগে আছেন পাহাড়ে রাজ্য সরকারের তৈরি করা বিভিন্ন উন্নয়ন পর্ষদ নিয়ে। তাঁর কথায়, এটা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’। এতে পাহাড়বাসী আগামী দিনে নিজেদের মধ্যে অশান্তিতে জড়িয়ে পড়বে। তাঁর কথায়, এক রকম জাতি-দাঙ্গার বীজ বোনা হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। সু্ন্দর স্বাস্থ্য, কমবয়েসী ছেলে নবীন, অনেক দিন হল ফ্রায়ার ব্রিগেডে চালক পদে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। আজও জানেন না, কেন তাঁকে নেওয়া হয়নি। কিছুটা সামনে এগোতেই রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে। সিঁড়ির শেষ মাথায় একটা বেশ বড়সড় বাজার। সকালের ব্যস্ততা নেই। অল্প কিছু কমবয়সী ছেলে হইহই করে ক্যারম খেলছে, কেউ কেউ পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে আর আড্ডা মারছে নিজেদের মধ্যে। এতগুলো কমবয়সী ছেলেকে একসঙ্গে পেয়ে কথা বলার সুযোগ ছাড়া নেই। শুরুর দিকে খেলা ছেড়ে কথা বলায় একটু অনাগ্রহ থাকলেও, ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল সবাই।

পাহাড় কেমন আছে জানতে চাই শুনে হো হো করে হেসে উঠল একসঙ্গে। সন্দেহ হল, এটাই কি সেই কলকাতার রাস্তায় বড় বড় হোর্ডিংয়ে লেখা, ‘পাহাড় হাসছে’। বিজ্ঞাপনের হাসি, না কি এ হাসির অন্য কোনও নাম আছে? এক মিনিটের একটা নীরবতা, প্রায় সবাই মিলে জানতে চাইল, কী আছে তাদের? জিটিএ কি হাসপাতাল বানাবে, কলেজ বানাবে, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করবে? সামান্য নাক-কানে ব্যথা হলে ডাক্তার দেখাতে ছুটতে হয় শিলিগুড়ি। স্কুলে ক্লাস টু-র পরে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েকে অ্যাডমিশন নিতে হয় সমতলের কোনও কলেজে গিয়ে। স্থায়ী কোনও কাজ নেই বললেই চলে। কার্শিয়াংয়ে পর্যটক ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সবাই এখানে না থেকে দার্জিলিং চলে যাচ্ছেন। কারণ, ট্যুরিস্ট স্পটগুলো এখানে ভাল ভাবে উন্নয়ন করা হচ্ছে না। তার মধ্যে উন্নয়নের নামে বিভিন্ন জাতির জন্য আলাদা উন্নয়ন প্রাসাদ তৈরি করা হচ্ছে। তা ঘুরিয়ে জিটিএ-র গুরুত্ব কমিয়ে দেবে বলে তারা মনে করে। বিভাজন পাহাড়ের মানুষের জন্য ভাল হতে পারে না। এত তীব্র ক্ষোভ, অভিমান, রাগ, ঝরে পড়ছে কথায়।

আমার আর নতুন করে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হল না। ক্যামেরা গুটিয়ে একটু একটু করে সরে আসার কথা ভাবছি। আচমকাই একটা প্রশ্ন উড়ে এল পিছন থেকে, ‘আপনাদের কলকাতায় এই ছেলেরা কি দুপুরবেলায় সবাই মিলে এ রকম করে ক্যারাম খেলে, না কি কাজ করে কিছু?’ উত্তরটা আন্দাজ করতে পেরে নিজেই বলল, ‘আমাদের কিছু করার নেই, তাই এ ভাবেই সময় কাটাই রোজ।’ কোনও কথা নেই কারও মুখে, ক্যারাম স্টিকারটাও যেন নড়তে সাহস পাচ্ছে না। এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ, আমরা অনেক সময় একে ‘প্রেগন্যান্ট পজ’ বলে থাকি। যার পরেই কিছু একটা ঘটবে, হলও ঠিক তাই। মৃদু গলা, কিন্তু খুব স্পষ্ট করে একটি ছেলে বলে উঠল, ‘কাল হয়তো এখানে এলে শুনবেন এই সব কথা বলার জন্য পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।’

কি অদ্ভুত! গ্রেফতার শুনেই এতক্ষণের নৈঃশ্যব্দ কাটিয়ে সবাই কেমন বেশ জোরে হেসে উঠল। তাচ্ছিল্যের হাসি। কোনও কিছুকেই আর পরোয়া না করার হাসি, এতক্ষণ থেমে থাকা স্টিকারটা হঠাৎ করেই আবার ঠকাস ঠকাস আওয়াজ তুলে ঘুরতে লাগল এক হাত থেকে আর এক হাটে। সব কিছুই যে যার ছন্দে ফিরে আসছে আবার। শুধু খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে কেন জানি না আমার হঠাৎ মনে হল, কিছুতেই যেন আর একটু আগের হেঁটে উঠে আসার ছন্দটা ফিরে পাচ্ছি না। কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া রাস্তা ফুঁড়ে গাড়ি এগিয়ে চলল দার্জিলিংয়ের দিকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Badshsh Moitro
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE