Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বিক্ষিপ্ত গোলমাল, প্রথম দফায় তবু খুশি সব পক্ষ

নিশ্চিন্ত ও নির্বিঘ্ন ভোটের আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী। সোমবার রাজ্যের প্রথম দফার ভোট দেখল, কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া মোটের উপর কথা রেখেছেন জৈদী। এই পর্বের ভোট নিয়ে শাসক যেমন খুশি, তেমন বিরোধীরাও অন্তত বুঝিয়েদিয়েছেন যে তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। বাংলার ভোটচিত্রে যা কিছুটা বিরলই!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

নিশ্চিন্ত ও নির্বিঘ্ন ভোটের আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী। সোমবার রাজ্যের প্রথম দফার ভোট দেখল, কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া মোটের উপর কথা রেখেছেন জৈদী। এই পর্বের ভোট নিয়ে শাসক যেমন খুশি, তেমন বিরোধীরাও অন্তত বুঝিয়েদিয়েছেন যে তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। বাংলার ভোটচিত্রে যা কিছুটা বিরলই!

নয়াদিল্লিতে নির্বাচন সদনে প্রথম দফার ভোট নিয়ে কমিশনের প্রধান সচিব আর কে শ্রীবাস্তবের প্রতিক্রিয়া, ‘‘যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট।’’

প্রথম দফা ভোটের আগের দিন রাত পর্যন্ত প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা না পেয়ে অনেকেরই ধারণা হয়েছিল, এলাকায় টলহদারি ঠিক মতো হবে না। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যথারীতি শাসকের দাদাগিরি অব্যাহত থাকবে। এ সব ক্ষেত্রে মূলত দু’টো অভিযোগ সামনে আসে। এক, ভুতুড়ে ভোটারের আনাগোনা এবং দুই, বৈধ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের আগেই আটকে দেওয়া। কিন্তু প্রথম দফার ভোটপর্ব মেটার পরে দিনের শেষে সেই ধরনের অভিযোগ খুব একটা সামনে আসেনি। তবে তার মানে এই নয় যে, এমন ঘটনা ঘটেনি। কোথাও মুড়ি-চানাচুর, নগদ টাকা বা পানীয় দিয়ে প্রভাবিত করার অভিযোগ যেমন উঠেছে, তেমনই নীরব সন্ত্রাসের ছায়াও দেখা গিয়েছে কিছু জায়গায়। তবে সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন এ বারে মোটের উপর একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ উপহার দিতে পেরেছে বলে অন্তত প্রথম দফার শেষে মানছেন শাসক-বিরোধী দু’পক্ষই।

যদিও অনেকেই বলছেন, প্রথম দফার ভোট দেখেই কমিশনকে তারিফ করার মতো কিছু হয়নি। আরও ছ’দফা ভোট বাকি। ফলে সত্যিই ভোট কতটা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে হল, তার বিচার হবে পরের পর্বগুলি দেখার পরে। কারও কারও মতে, প্রথম দফায় জঙ্গলমহলের বেশ কিছু এলাকায় তৃণমূল দাপটের সঙ্গে ভোট করিয়ে নিয়েছে। সেখানে বিরোধী দলের কোনও অস্তিত্বই ছিল না! ফলে একতরফা ভোট হয়েছে ওই সব জায়গায়। যার সব ক’টিতেই জেতার জন্য এ দিন মাঠে নেমেছিল তৃণমূল। তবে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় কোথাও কোথাও শাসক দলের সঙ্গে সমানে টক্কর দিতে দেখা গিয়েছে বিরোধী প্রার্থীদের। বিরোধীরা প্রথম দফায় অন্তত ছ’সাতটি আসনে ভাল ফলের আশা করছেন।

প্রশাসনিক মহলের একাংশ মনে করছেন, জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় শাসক দলের দাপট এবং বিরোধী পক্ষের তুলনামূলক অনুপস্থিতির জন্য কমিশনকে দায়ী করা যায় না। বরং এ দিন পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার যে ১৮টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে, সেখানে কোথাও ভোট চলাকালীন বুথ থেকে বড় ধরনের গোলমালের খবর পাওয়া যায়নি। যে কয়েকটি বুথে বিক্ষিপ্ত কিছু গোলমাল হয়েছে, সেখানেও কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। এ দিন ভোট নিয়ে ৫৩৭টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। তার মধ্যে ৫৩১টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে বলে দাবি কমিশনের।

তবে সর্বত্র ছবিটা যে পুরো স্বাভাবিক ছিল না, এ দিন তার প্রমাণও মিলেছে অনেক কেন্দ্রেই।

বাঁকুড়ার রাইপুর কেন্দ্রের মেলেড়ায় ১৯টি বুথের দু’টিতে কোনও এজেন্ট ছিল না সিপিএমের। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরের পেটবিন্দি গ্রামের খুদমারাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিজেপি এজেন্ট বুদ্ধেশ্বর দিগার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ বুথের বাইরে বেরিয়েছিলেন। সে সময় তৃণমূলের লোকেরা তাঁকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। জামবনি ব্লকের আমতলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেলপাহাড়ির জুজারধারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনেই সিপিএমের পোলিং এজেন্টকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ভোট চলাকালীন বেলপাহাড়ির পূর্ণাপানি, ডাকাইতে টাকা বিলি করে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। গোপীবল্লভপুর কেন্দ্রের লোধাশুলির নহরিয়ায় নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলে এবং খারবাঁধি গ্রাম পঞ্চায়েতের নিশ্চিন্তা গ্রামেও বুথের কাছেই শিবির করে ভোটারদের মুড়ি-চানাচুর বিলির অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও কিছু অভিযোগ উঠেছে। বাঘমুণ্ডির বলরামপুরের গাড়াফুসড়ো প্রাথমিক স্কুলের বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়াই এক কম দৃষ্টিসম্পন্ন ভোটার-সহ বেশ কয়েক জনকে বুথের ভিতরে নিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তৃণমূলের কর্মীরা। বুথে ঢুকে তাতে মদত দেন রাজ্য পুলিশের এক কর্মীও। বিরোধীদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে অভিযোগ মিলতেই নির্বাচন কমিশন সরিয়ে দেয় বুথের প্রিসাইডিং অফিসারকে। বসানো হয় নজরদারি ক্যামেরাও। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ রঘুনাথপুরের সেনেড়া প্রাথমিক স্কুলের বুথে দেখা যায় ইভিএম রাখা আছে খোলা জানালার পাশে! তৃণমূলের কর্মীরা সেখান দিয়েই উঁকিঝুঁকি মারছেন!

এ দিন সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ রাইপুরের মেলেড়া হাইস্কুলের বুথে ছিলেন জনা আটেক জওয়ান। বুথ থেকে একশো মিটারের মধ্যেই তৃণমূল কর্মীদের পতাকা নিয়ে জটলা করতে দেখা গিয়েছে। সকাল পৌনে ১২টা নাগাদ রাইপুরের বড়কলা বুথে ভিতরে জনা আটেক কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের সামনেই গাছের তলায় খোশগল্পে মাতোয়ারা শাসকদলের জনা কুড়ি কর্মী। এখানে ভোট শুরুর আগেই বুথ ছেড়ে চলে যান সিপিএম এজেন্ট। যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় বলেন, ‘‘সব অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা!’’

কমিশনের বিরুদ্ধে ওঠা শিথিলতার সব অভিযোগ উড়িয়ে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল কুমার গুপ্ত বলেন, ‘‘প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। পুলিশ কেবলমাত্র লাইন ঠিক করার কাজ করেছে। দু’একটি ক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠা মাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত বাহিনীকে বুথের বাইরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাজে কমিশন খুশি।’’

প্রথম পর্বের ভোট নিয়ে মোটের উপর খুশি রাজনৈতিক দলগুলিও। তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের দাবি, বাম আমলের তুলনায় বেশি ভোট পড়েছে এ বারে এবং এটা ‘‘তৃণমূল সরকারের সদর্থক ভূমিকা ও উন্নয়নের পক্ষে ভোট।’’ প্রথম দিনের ভোটপর্বে খুশি সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, ‘‘জঙ্গলমহলের মানুষ প্রথম বলেই ছক্কা মারবেন, এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে এখন উইকেট বাঁচানোর লড়াই লড়তে হবে! প্রথম পর্বের ভোটে মানুষের বার্তা স্পষ্ট, তাঁরা তৃণমূলকে হঠাতে চান।’’

প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন বামেদের জোটসঙ্গী তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘‘কয়েকটি ঘটনা ছাড়া মোটের উপর মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন। তৃণমূলের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছে।’’ বাম-কংগ্রেস নেতৃত্বের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তাঁরা চাইছেন, ভয় কাটিয়ে সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে ভোটের লাইনে দাঁড়ান। তাতে চাপ বাড়বে শাসকের উপরেই। পাশাপাশি, যেটুকু জড়তা এখনও আছে, তা কাটিয়ে আরও সক্রিয় হবে নির্বাচন কমিশন। আর বিজেপির সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘মানুষ নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন। তার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ধন্যবাদ।’’

এ দিন শালবনি কেন্দ্রের আঁধার নয়নে বাম প্রার্থী শ্যামসুন্দর পাণ্ডেকে শাসানি দেয় তৃণমূল কর্মীরা। শ্যামবাবু কোনও রকমে এলাকা ছাড়লেও সে সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকেরা তৃণমূল কর্মীদের হাতে প্রহৃত হন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর চোখের সামনেই আনন্দবাজার, এবিপি আনন্দ-সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বেধড়ক পেটায় শাসকদলের লোকজন। মুখ্য নির্বাচনী অফিসার বলেছেন, ‘‘ওই ঘটনায় মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 west bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE