Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

নিয়ম বাঁচিয়েই চাটাই পেতেছে শাসকের দলবল

ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। নিঃশব্দে এবং আইন বাঁচিয়েও শক্তি প্রদর্শন করা যায়।সোমবার দুপুর ১২টা নাগাদ বাঁকুড়ার মেলেড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বড়কলা গ্রামের বটতলায় তাই জনা কুড়ি-পঁচিশ যুবকের ভিড়।

চাটাই পেতে ক্যাম্প তৃণমূলের। বাঁকুড়ার ফুলকুসমার বেশির ভাগ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরেই দেখা গিয়েছে এই ছবি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

চাটাই পেতে ক্যাম্প তৃণমূলের। বাঁকুড়ার ফুলকুসমার বেশির ভাগ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরেই দেখা গিয়েছে এই ছবি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সুরবেক বিশ্বাস
রাইপুর শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৫
Share: Save:

ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। নিঃশব্দে এবং আইন বাঁচিয়েও শক্তি প্রদর্শন করা যায়।

সোমবার দুপুর ১২টা নাগাদ বাঁকুড়ার মেলেড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বড়কলা গ্রামের বটতলায় তাই জনা কুড়ি-পঁচিশ যুবকের ভিড়। কারও বুকে ঘাসফুলের ব্যাজ, কেউ আবার ঘাসফুল ছাপ দেওয়া টি-শার্ট পরা। তাঁদের পাশেই পুলিশের টহলদার ভ্যান। খাকি উর্দিধারীরা খোশগল্প জুড়েছেন যুবকদের সঙ্গে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ডিউটি দেওয়ার ফাঁকে বটের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেওয়া।

গাছতলা থেকে দেড়শো মিটার দূরে বড়কলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন ভোটগ্রহণ চলছে। জংলা পোশাকে ইনস্যাস রাইফেল হাতে ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ন (আইআরবি)-এর জওয়ানেরা বুথের সামনে চোয়াল কঠিন করে দাঁড়িয়ে। ওঁরা এসেছেন ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী প্রভাবিত সারান্ডা থেকে। মাওবাদীদের বুলেট, ল্যান্ডমাইনের মোকাবিলায় তাঁরা অভিজ্ঞ হতে পারেন, কিন্তু ক’দিনের জন্য বঙ্গদেশে ডিউটি করতে এসে পোক্ত ভোট মেশিনারিকে বুঝবেন বা যুঝবেন কী ভাবে? তাই বটতলার ওই জমায়েত যে ভোটে বাহুবলের সমার্থক, সেটা তাঁদের জানা নেই।

নির্বাচন কমিশন কোনও দলকে বুথ-লাগোয়া ক্যাম্প অফিস করতে দেয়নি। বুথের দুশো মিটারের মধ্যেও থাকার নিয়ম নেই। ফলে ভোটারদের বুথে যাওয়ার পথের মাঝখানে দুশো মিটার দূরত্ব বজায় রেখেই কোথাও চাটাই পেতে, কোথাও টেবিল পেতে ভোটার লিস্ট বিছিয়ে বসল তৃণমূল। যেন অলিখিত ক্যাম্প অফিস। কোথাও আবার শুধুই জড়ো হয়ে থেকে ভোটার-আগন্তুক-গাড়ি সকলের উপর নজর রাখা হল। বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে সর্বত্র না হোক, কিছু এলাকায় অন্তত এ ভাবেই ‘ভোট করালো’ শাসক দল।

বড়কলার ওই বুথে যেমন সিপিএম এজেন্ট-ও নেই। কেন? সিপিএম সূত্রেই জানা গেল, যাঁকে এজেন্ট করা হয়েছিল, তিনি সাতসকালে বুথে এসে বলে দেন, তাঁর পেটের অবস্থা খুব খারাপ। তার পর চলে যান। সত্যি সত্যিই পেট খারাপ নাকি অন্য কিছু, সেই ব্যাপারে দল অবশ্য মেডিক্যাল সার্টিফিকেট চায়নি। সিপিএম কোনও বদলি এজেন্টও দিতে পারেনি।

তৃণমূলের দখলে থাকা এই মেলেড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামগুলোতে সিপিএমের পতাকা বা দেওয়াল লিখন দূরবীনে চোখ লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মেলেড়া হাইস্কুলে ঢোকার প্রায় দু’শো মিটার আগে, বাজার-দোকান ভোটের দিনেও জমজমাট। কারণ ঘাসফুল ব্যাজধারীদের সংখ্যা সেখানে আরও অনেক বেশি। তাঁদের গলার স্বরেই বাজার গমগম। অথচ আইআরবি-র আট জন জওয়ানের সুরক্ষায় মোড়া মেলেড়া হাইস্কুলে তখন কী নির্বিঘ্নেই না ভোট চলছে!

মেলেড়ার স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন মল্লিক বললেন, ‘‘সিপিএমের আমলে সিপিএম একচেটিয়া প্রভাব খাটাত, এখন তৃণমূলও সেই একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে।’’

বেলা সাড়ে ১২টায় রাইপুরের সিপিএম প্রার্থী দিলীপ হাঁসদা অভিযোগ করলেন, ‘‘বুথের ভিতর গণ্ডগোল কিছু হচ্ছে না, তবে সারেঙ্গার নেতুলপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় তৃণমূলের ছেলেরা রাস্তায় জড়ো হয়ে আছে।’’ বোঝা গেল, ওখানে তৃণমূলের লোক জড়ো হওয়ার খবর দলীয় প্রার্থীকে দেওয়ার জন্য সিপিএমের তা-ও কেউ আছেন। যেটা নেই মেলেড়া বা ফুলকুসমার মতো অঞ্চলে।

এই ভাবে বুথে যাওয়ার পথে লোকজন জড়ো করা মানে কি বিরোধী ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ধরানো নয়? যাতে তাঁরা ভোট দিতে যাওয়ার পথে, বুথে ঢোকার আগে ওই মুখগুলো দেখে দু’বার ভাবেন! এই তল্লাটে তৃণমূলের ভোটযুদ্ধের সেনাপতি রাজকুমার বা রাজু সিংহ অবশ্য সে কথা একেবারেই মানতে নারাজ। রাইপুর ব্লকের যুব তৃণমূল সভাপতি ও মেলেড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান এই রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হল ফুলকুসমা হাইস্কুলের কাছে। দুধসাদা এসইউভি থেকে নামলেন নীল পাঞ্জাবি-চোখে সানগ্লাস। ছ’ফুটের উপর লম্বা সুদর্শন যুবকের চেহারার সঙ্গে তাঁর নামের মিল আছে। তাঁর সামনেই রাস্তার ধারে চাটাই পেতে ভোটার লিস্ট নিয়ে বসে আছেন গৌরাঙ্গ কর্মকার, উজ্জ্বল সাহু, বিপ্লব দুলে’রা। পাশের গাছগুলোয় বাঁধা তৃণমূলের হাফ ডজন পতাকা। ফুলকুসমা গ্রাম পঞ্চায়েতের শালবনি গ্রামেও বুথের কিছুটা দূরে পতাকা টাঙিয়ে, চাটাই পেতে তৃণমূল কর্মীরা বসে।

রাজকুমারের বক্তব্য, ‘‘আমরা যদি সত্যি সত্যি শক্তি প্রদর্শন করতাম, তা হলে সিপিএম কি একটা বুথেও এজেন্ট দিতে পারত? ভোটের সময়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকে। তাই সবাই একসঙ্গে জড়ো হন। এর মধ্যে অন্য কোনও ব্যাপার নেই।’’

চাটাই পেতে বসা উজ্জ্বল সাহু, তরুণ দুলে’রা বলেন, ‘‘তিনটে বাজতে চলল। ৭০ শতাংশ ভোট পড়ে গিয়েছে। এ বার কয়েক জন বয়স্ক ভোটারকে আনতে আমরা গাড়ি পাঠাব।’’ যুব সভাপতির ছায়াসঙ্গী তৃণমূল কর্মী রাহুল সেনাপতির মুখে মুচকি হাসি। বললেন, ‘‘আমাদের ভোট কমপ্লিট।’’

নিশ্চিন্ত হয়ে এসইউভি-তে উঠে অন্য তল্লাটের খবর নিতে চলে যান রাজকুমার। তাঁর কথায় মনে পড়ে যায় বাম আমলের এক মন্ত্রীর কথা। যিনি বলেছিলেন, ‘‘ভোট একটা উৎসব, বাইরে থেকে লোকজন তো আসবেই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE