Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পঞ্চমের হারমোনিয়াম আশার গলা

আবার পারাপার। বাংলা ছবিতে আশা ভোঁসলে-র গান। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।সাদা ধুতিতে মোড়া হারমোনিয়াম। তার কাঠের প্যানেলের ওপর চন্দনের একটা ফোঁটা। সদ্য স্নান সেরে এসে বসেছেন আশা ভোঁসলে।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৪ ০৪:০৯
Share: Save:

সাদা ধুতিতে মোড়া হারমোনিয়াম।

তার কাঠের প্যানেলের ওপর চন্দনের একটা ফোঁটা।

সদ্য স্নান সেরে এসে বসেছেন আশা ভোঁসলে।

বললেন, “এটা পঞ্চমের হারমোনিয়াম। নাও, এটা বাজিয়েই গানটা তোলাও।”

মঙ্গলবারের সকালের স্মৃতিটা ঠিক এ ভাবেই জ্বলজ্বল করছে কণ্ঠশিল্পী সৌম্যজিৎ আর পিয়ানোবাদক সৌরেন্দ্রর মনে।

এত দিন শো, অ্যালবাম করার পরে এই প্রথম তাঁরা ছবিতে সুর দেওয়ার কাজ হাতে নিয়েছেন। ফিল্মের নাম ‘পারাপার’। মুখ্য ভূমিকায় ঋতুপর্ণা আর পাওলি। পরিচালক সঞ্জয় নাগ।

আশাজি বললেন একসঙ্গে অন্তত
চারটে লাইন
গেয়ে রেকর্ড করবেন।
তাঁর এই আশি বছর বয়সে এসেও

সৌম্যজিৎ ও সৌরেন্দ্র

আশাজির গানটা আমরা কোনও নারী চরিত্রের
ক্ষেত্রে ব্যবহার করিনি।
ইচ্ছে করে এটা আমরা
প্রথমেই ঠিক করেছিলাম

সঞ্জয় নাগ

কী ভাবে রাজি করালেন আশা ভোঁসলেকে? “প্রথমবার ফোন করেছিলাম। কিন্তু বেজে গিয়েছিল। তার পর এসএমএস করে জানাই আমাদের ইচ্ছে। এসএমএস করার আধঘণ্টা পরে উনি ফোন করেন। জানতে চান গানটার বিষয়। তার সঙ্গে ট্র্যাকও পাঠিয়ে দিতে বলেন। ট্র্যাকটা শুনে ওঁর এত ভাল লাগে যে আমাদের গানটা রেকর্ড করতেও রাজি হয়ে যান,” বলেন সৌম্যজিৎ।

‘ছদ্মবেশী’র ‘আরও দূরে চলো যাই’, ‘একান্ত আপন’য়ের ‘তোলো ছিন্নবীণা বাঁধো নতুন তারে’ এবং ‘খেলব হোলি রং দেব না’, ‘প্রথম কদম ফুল’য়ের ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে’ বাংলা ছবিতে অসংখ্য গান গেয়েছেন তিনি। “জিজ্ঞেস করেছিলাম শেষ কবে বাংলা ছবির জন্য গান গেয়েছেন? আশাজি বলেন এক দেড় বছর আগে হবে। এটাও বলেন গানটা শেষ পর্যন্ত বেরিয়েছিল কি না তাও ওঁর মনে নেই। তবে এর থেকে বেশি আর কিছু মনে করতে পারলেন না,” বলেন সৌরেন্দ্র।

রেকর্ডিং বললেই তো আর রেকর্ডিং হয় না! গানের কথাগুলো চেয়ে পাঠালেন আশা। মন দিয়ে শুনলেন শ্রীজাতর লেখা ‘যেন কারশেডে পাশাপাশি দুটো ট্রেন/ আলসের কোণে কাছাকাছি দুটো টব/ সমান্তরাল সমস্ত লেনদেন/ মুঠোয় এসে ভাগ হয়ে যায় সব.../ বন্ধু তবুও বাড়াও তোমার হাত--/ আগের মতোই ধরা যায় কি না দেখি/ ছাতের কিনারে তারা জ্বলে সারা রাত.../ মাঝখানে ওরা দূরত্ব মানবে কি?’

“তার পর প্রশ্ন করলেন এটা কি কোনও কবি লিখেছেন? এই স্টাইলে লেখাটা গুলজারসাব প্রথম নিয়ে আসেন সিনেমার গানে,” সৌম্যজিৎ বলেন।

তা শুনে শ্রীজাত বলেন, “আমার কাছে এটা স্বপ্নেরও অনেক বেশি। কারণ এই মানুষটি এত দূরের তারা, এবং এত প্রিয়, তাঁর গলায় যে আমার লেখা গান কখনও শুনতে পাব, এমন ভাবার সাহসও ছিল না।”

প্রত্যেকটা শব্দের অর্থ জেনে নেন আশা। তার পর শুরু হয় গান তোলার মহড়া। দুই সুরকার জোর দিয়ে বলেন এ রকম অভিজ্ঞতা নাকি তাঁদের পেশাদার জীবনে বিরল। তাঁদের ভাষায়, “অনেক শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছি। অনেকে তো ওয়ার্ড-পাঞ্চ করে ডাব করেন। কিন্তু আশাজি বললেন একসঙ্গে অন্তত চারটে লাইন গেয়ে রেকর্ড করবেন। তাতে সময় বেশি লাগতে পারে। কিন্তু এই পদ্ধতিতেই করবেন। তাঁর এই আশি বছর বয়সে এসেও।”

মঙ্গলবার সকালবেলায় মুম্বইয়ের বাড়িতে আশা ডেকে নেন সুরকারদের। স্নান করে রেডি। “দেখা হওয়ার পরেই আমাদের বলেন, ‘তোমরা তো গিটার নিয়ে আসোনি! তা হলে গান তোলাবে কী করে?’ জিজ্ঞেস করলাম বাড়িতে একটা হারমোনিয়াম পাওয়া যাবে...”

এর কিছুক্ষণ পরে সেই সাদা ধুতিতে মোড়ানো হারমোনিয়ামটা নিয়ে আসা হল বসার ঘরে।

গান তোলা আর স্টুডিয়োতে গিয়ে রেকর্ডিং করার মধ্যে অনেক আড্ডা, স্মৃতিচারণ। কখনও বলেছেন আজকাল অনেক শিল্পীদের গলাটা খাদে যায় না। কখনও এই নবীন সুরকারদের গান শুরু করার আগে ‘ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর’ বলে দেওয়ার রেওয়াজ শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন শঙ্কর জয়কিষেণের। “ওই প্রবাদপ্রতিম সুরকাররা একসঙ্গে সব গানে সুর দিতেন না। কোনওটা শঙ্করজি করতেন, কোনওটা জয়কিষেণজি। আশাজি বলেন যে, যখন শঙ্করজি ‘ওয়ান টু’ দিতেন, তখন উনি বুঝতে পারতেন যে ওই গানটা শঙ্করজির সুর করা। আর জয়কিষেণজি ‘ওয়ান টু’ দিলে বুঝতেন ওটা উনি সুর করেছেন,” বললেন সৌম্যজিৎ। তার পর কিশোরকুমারের প্রচুর গল্প। একবার নাকি কিশোরকুমার মাটিতে শুয়ে পা দুটো তুলে গান করতে শুরু করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, তাতে সুর এক ফোঁটাও সরে যায়নি। আর তার পর বলেছিলেন সেই একই জিনিস আশা ভোঁসলেকে করে দেখাতে। “আর পঞ্চমের সম্পর্কে বলেন যে ও রকম সাদামাটা আর সৎ শিল্পী দেখেননি তিনি। হয়তো লতাজির জন্য গান কম্পোজ করেছেন। কিন্তু গানটা আগে আশাজিকে শুনিয়ে বলেছেন যে সেটা লতাজিকে দিয়েই গাওয়াবেন,” সুরকাররা বলেন।

নানা ধরনের গল্প। প্রত্যেকটাই অভিনব। এই শুনতে শুনতেই খাম্বাজ রাগের ওপর আশ্রিত গানের রেকর্ডিং শেষ হল। তবে ছবিতে গানটা কারও লিপে থাকছে না। দুজন অসমবয়সি মানুষের বন্ধুত্ব বোঝাতে গিয়েই এই গানটা আবহসঙ্গীতে ব্যবহার করা হবে। কোথাও এই দুই চরিত্রের জীবনের মধ্যে ভরাট করে দেওয়ার মতো একটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। আবার ভরাট করার চেষ্টার মধ্যে একটা সংশয়ও। “আহমেদ রুবেল আর সোহমের ওপর গানটার দৃশ্যায়ন হবে। ইচ্ছে করেই আমরা কোনও পুরুষকণ্ঠ ব্যবহার করিনি এই গানে,” বলছেন পরিচালক।

এখন দেখার যে, এই দুই পুরুষ অভিনেতার ওপর চিত্রায়িত এই ঘুমপাড়ানি গান বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে থাকে কি না।


সিনেমার শ্যুটিং নয়। মঞ্চের রঙিন আলোয় নুসরত। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।


গানের এ পারে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও তনুশ্রী চক্রবর্তী।
গায়িকা স্বপ্না রায়-য়ের সিডি প্রকাশ অনুষ্ঠানে। ছবি: কৌশিক সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE