Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্ব পুতুল দিবসে কচিকাঁচারা মাতল তালপাতার সেপাইয়ে

দিন গিয়েছে তালপাতার সেই সেপাইদের! এক সময় তালপাতার সেপাই নিয়ে সিঁদ কাটতে যেত চোরেরা। পরে লিকপিকে সেই পুতুলই শিশুর খেলার উপকরণ হয়ে ওঠে। দু’দশক আগেও মেলায় কিংবা হাটেবাজারে দেখা মিলত এই পুতুলের। এখন গাঁ-গঞ্জের মেলায় বিশেষ আর দেখা যায় না বাংলার ঐতিহ্য-প্রাচীন এই পুতুলটিকে। বিদেশি সফ্ট টয়ের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে তালপাতার সেপাই।

ঝাড়গ্রামের স্কুলে আয়োজিত কর্মশালায় নিজেদের তৈরি পুতুল হাতে কচিকাঁচারা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

ঝাড়গ্রামের স্কুলে আয়োজিত কর্মশালায় নিজেদের তৈরি পুতুল হাতে কচিকাঁচারা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৪ ০৪:০৪
Share: Save:

দিন গিয়েছে তালপাতার সেই সেপাইদের!

এক সময় তালপাতার সেপাই নিয়ে সিঁদ কাটতে যেত চোরেরা। পরে লিকপিকে সেই পুতুলই শিশুর খেলার উপকরণ হয়ে ওঠে। দু’দশক আগেও মেলায় কিংবা হাটেবাজারে দেখা মিলত এই পুতুলের। এখন গাঁ-গঞ্জের মেলায় বিশেষ আর দেখা যায় না বাংলার ঐতিহ্য-প্রাচীন এই পুতুলটিকে। বিদেশি সফ্ট টয়ের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে তালপাতার সেপাই।

বিশ্ব পুতুল দিবসে হারাতে বসা এই পুতুল শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোগী হল ‘ঝাড়গ্রাম আর্ট অ্যাকাডেমি’। সংস্থার অধ্যক্ষ সঞ্জীব মিত্র জানান, তালপাতার সেপাই পুতুল-শিল্পটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন। খ্রিস্ট-পূর্ব পঞ্চম শতকে শূদ্রক রচিত সংস্কৃত ভাষায় ‘মৃচ্ছকটিকম্’ নাটকে এই পুতুলের ব্যবহারের কথা জানা যায়। তবে মূলত চুরির জন্যই এই পুতুল ব্যবহার করত চোরেরা। প্রাচীন ওই নাটকের একটি চরিত্র ‘সার্বিলক’ নামে এক ব্রাহ্মণ চৌর্যপেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সার্বিলক গৃহস্থের ঘরে সিঁধ কাটতেন। সিঁধ কাটার পরে লিকপিকে হাত-পা ছোড়া পুতুলটিকে সিঁধের ফোকর দিয়ে ঢুকিয়ে দেখে নিতেন তিনি। নিশ্চিত হওয়ার পরে তারপর চুরি করতে ঢুকতেন সার্বিলক। এই নাটকের সূত্র ধরলে হিসেব মতো আড়াই হাজার বছর আগে এই পুতুলের অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীকালে উজ্জয়িনীর এই পুতুলটি শিশুর খেলার সামগ্রী হিসেবে বঙ্গদেশে জনপ্রিয় হয়।

শুক্রবার ২১ মার্চ বিশ্ব পুতুল দিবসে এই পুতুল পুনরুজ্জীবনের শুভ সূচনা হল। এ দিন ঝাড়গ্রাম আর্ট অ্যাকাডেমির আয়োজনে ঝাড়গ্রাম শহরের সানি পয়েন্ট স্কুলে এক দিনের ‘তালপাতার সেপাই’ পুতুল তৈরির কর্মশালা হল। কর্মশালাটির আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন বিশিষ্ট কবি শুভ দাশগুপ্ত। সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এই কর্মশালায় অংশ নেয় সানি পয়েন্ট স্কুলের প্রায় সাড়ে তিনশো কচিকাঁচা। আর্ট অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ সঞ্জীব মিত্র জানালেন, তাঁরা অবশ্য পুতুল তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে তালপাতার পরিবর্তে পুরু কাগজ ব্যবহার করছেন। এর কারণ প্রথমত, শিশুরা প্রথম এই পুতুল তৈরি করছে, ফলে তালপাতা কাটতে তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না-ও করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এখনকার দিনে বিপুল পরিমাণে তালপাতা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। আগে তালপাতা কেটে পুতুল তৈরি করে ভেষজ রঙে রাঙানো হতো। মাথা-সহ ধড়টির সঙ্গে সুতো দিয়ে বেধে দেওয়া হতো হাত ও পা। হাত ও পা গুলিও দু’টি করে চার টুকরো করে তৈরি করা হত। হাতের পায়ের টুকরো অংশগুলিও সুতো দিয়ে বাঁধা থাকতো। পুতুলটির ধড়ের মধ্যে সরু কাঠি ঢোকানো থাকতো। কাঠিটি ঘোরালেই তালপাতার সেপাই যুদ্ধের কৌশলে লিপপিক করে হাত ও পা ছুড়তে থাকলে মজা পেত শিশুরা।

সঞ্জীববাবুদের তালপাতার সেপাই অবশ্য আধুনিক যুগের সঙ্গে মানানসই। ভেষজ রঙের জায়গা নিয়েছে এখন মোম রং বা জল রং। সুতোর পরিবর্তে স্ট্রেপলারের পিন দিয়ে হাত ও পা গুলি জোড়া হচ্ছে। এদিন কর্মশালায় আর্ট অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে আর্য, শুভঙ্কর, সুপ্রীতি, জয়কৃষ্ণ, সনাতন, শেফালির মতো সাড়ে তিনশো কচিকাঁচারা কাগজ কেটে প্রতীকি তালপাতার সেপাই পুতুল তৈরি করে। সানি পয়েন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কাকলি মল্লিক বলেন, “বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা এই পুতুলের কথা জানেই না। এ দিন কর্মশালায় নিজের হাতে পুতুল তৈরি করে ওরা বেজায় খুশি হয়েছে।”

আর্ট অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ সঞ্জীব মিত্র বলেন, “দেশের প্রাচীন এই লুপ্তপ্রায় পুতুলশিল্পকে বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। শনি ও রবিবার দু’দিনের পৃথক একটি কর্মশালা হবে আর্ট অ্যাকাডেমির নিজস্ব প্রাঙ্গণে। সেখানে আরও সাড়ে পাঁচশো শিশু, কিশোর ও কিশোরী এই পুতুল তৈরি করবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kingshuk gupta world puppet day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE