এমন কোনও মধ্যবিত্ত বাঙালি কি কেউ দেখেছেন, যার ছেলেমেয়েরা একেবারে কম বয়স থেকে হয় লেখে না, না-হয় ছবি আঁকার স্কুলে যায় না, বা গানের স্কুলে, বা নিতান্তই পাড়ায় বা স্কুলে থিয়েটার করে না একেবারে? বা নেহাতই একটা গিটার টুং-টাং করে না? আছে নিশ্চয়ই। তবে তা পাওয়া মুশকিল। ফুল ফুটুক বা না-ই ফুটুক, সংস্কৃতিচর্চার বসন্তকাল বঙ্গজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কবে থেকে বাঙালি জীবনে এ হেন সংস্কৃতি চর্চার বাড়বাড়ন্ত? রবীন্দ্রনাথের পর থেকে? না কি উপনিবেশবাদেরই এ এক অনিবার্য ফল, যার দাদন আজও গিলে চলেছি আমরা? প্রাচীন বঙ্গদেশের সাহিত্য রচয়িতারা বরাবরই দারিদ্র নিয়ে ভেবেছেন, অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে সবিস্তার বলেছেন, ধর্মের কর্মেও তাঁদের আস্থা অটুট, কিন্তু বঙ্গদেশীয় সন্তান মাত্রেই চিরকেলে সংস্কৃতিপিপাসু— মনে তো হয় না। অন্তত সাহিত্যিক নমুনায় এমন কোনও সমাজচিত্র নেই। নবদ্বীপের নিমাই তাঁর দলবল নিয়ে নামসংকীর্তন করেছেন বটে, কিন্তু তাও তো প্রধানত ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ— সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা কোথায়? বরং গড়পড়তা বঙ্গদেশীয় মানসিকতা বোঝাতে মধ্যযুগীয় এক পর্তুগিজ পর্যটক, নাম টুমে পিরেস, লিখছেন, ‘যখন ওরা (ভারতীয়রা) কাউকে অপমান করে গালাগালি দিতে চাইত তখন বলত ‘বাঙালি’। অর্থাৎ যারা মূলত শঠ।’ অষ্টাদশ শতাব্দীতেই ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থ ‘রিয়াজউস সালাতিন’-এর ভারতবর্ষীয় লেখক মন্তব্য করছেন, ‘দুষ্টবুদ্ধি, নষ্টামি, প্রতারণা ও বদমায়েশিতে বাঙালিদের জুড়ি মেলা ভার।’ আইন-বিশেষজ্ঞ, ইনটেলেকচুয়াল, সদ্য তিরিশ পেরোনো, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোটা বেতনের চাকুরে লর্ড মেকলে, যিনি পরে ইন্ডিয়ান পিনাল কোড তৈরি করবেন এবং বাংলায় এসেই প্রায় তৈরি করবেন তাঁর সেই বিখ্যাত শিক্ষা-প্রস্তাব, সেখানে পরিষ্কার লিখবেন, “We must at present do out best to create a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, as in intellect.” (Minutes on Indian Education: Lord Macaulay, 1835. নিম্নরেখ লেখকের)। শুধু তাই নয়, বাঙালি সম্পর্কে তাঁর সেই বহুলপরিচিত উক্তি, ‘মোষের যেমন আছে শিং, বাঘের যেমন থাবা, প্রাচীন গ্রিকদের ভাষায় মেয়েদের যেমন সৌন্দর্য, বাঙালির তেমন আছে প্রতারণা, লম্বাচওড়া বাক্তাল্লা, চটজলদি অজুহাত, প্রতারণার সূক্ষ্ম বিস্তার, ধূর্ততা, মিথ্যাচার, জালিয়াতি— গঙ্গার নিম্নাঞ্চলের মানুষদের এগুলোই হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র।’
এ সব কথাকে কতটা সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত বলতে পারব না, তবে এ তো মানতেই হবে, উপনিবেশবাদের ভাষার হাত ধরে শিক্ষা যেমন এল, তেমনই এল সংস্কৃতিও। তবে সে তো অনেক পরে, সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট নাগরিক প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যাওয়ার পর। আরও খুলে বলতে গেলে, প্রধানত একটি বর্ণহিন্দু সাংস্কৃতিক প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে। কিন্তু মেকলের ওই বিখ্যাত শিক্ষাপ্রস্তাব পাশ হবার আগেই যে সমাজে ওই বিশেষ প্যাটার্নের দাবি উঠে গেছে এবং ওই প্যাটার্ন আত্মস্থ করলে যে অন্তত সাহিত্যে বহির্দেশে খ্যাতি পাবার প্রভূত সম্ভাবনা, তাও ওই মেকলে কথিত ‘চতুর বংগালী’ বুঝছে। এ কথা আমরা বুঝতে পারি ১৮৩৪-এর সাময়িক পত্রে লেখা এক প্রবন্ধে যেখানে প্রাবন্ধিক প্রস্তাব করছেন ‘...তবে তাঁহারদিগের (অর্থাৎ বঙ্গভাষী লেখকদের) উচিত হয় যে তাঁহারা শীঘ্র এক প্রধান সভায় একত্র হইয়া তাঁহারদিগের গ্রন্থ ইঙ্গরেজি অক্ষরে লিখিতে ও মুদ্রাঙ্কিত করিয়া প্রকাশ করিতে স্থির করেন। ...এইক্ষণে হিন্দুদিগের মধ্যে যাঁহারা জ্ঞানবান ও পণ্ডিত তাঁহারদিগের অভিলাষের এই উত্তম পথ খোলা আছে। যদি তাঁহারা তাঁহারদিগের সকল গ্রন্থ ইঙ্গরেজি অক্ষরে লিখেন তবে তাঁহারদিগের বিদ্যা ও বিজ্ঞতা এবং ধর্ম্ম সর্ব্বত্র ইউরোপে এবং অন্য তাবৎ শিষ্ট দেশে বিখ্যাত হইবে।’ (সংবাদপত্রে সে কালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত)
মেকলে এবং এই মতের মূর্তিমান বিরোধিতা তা হলে বঙ্কিম আর মধুসূদন, যাঁরা ওই ‘শিষ্ট’ দেশে খ্যাতি পাবার আকাঙ্ক্ষায় প্রথমে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেও পরে আজীবন বাংলাতেই লিখলেন। অন্য দিকে, লিয়েবেদফ আসার আর বাংলা থিয়েটার কেমন ভাবে করতে হবে তা দেখিয়ে দিয়ে চলে যাবার প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর বাঙালি শুরু করল নিজস্ব নাট্যচর্চা, তবে তা ইংরেজিতেই। মাঝে মাঝে সংস্কৃতে। আর বাংলার ঘরে ঘরে নাট্যকর্মী জন্মাতে শুরু করল তার প্রায় চল্লিশ বছর বাদে, গিরিশ ঘোষরা যখন শুরু করলেন মধ্যবিত্তের বাংলা থিয়েটার, বাইরে যার নাম ছিল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। আর বঙ্কিম বা মধুসূদনে যা ছিল ব্রিটিশ বিশ্বায়নপ্রসূত এক ধরনের, যেন-বা দেশের মধ্যেই এনআরআই প্যাটার্ন (যার বিকল্পে তলায় তলায় যদিও সমাজে থেকে গিয়েছিল আলালের ঠগচাচা বা হুতোমের কিস্সা), তার থেকে সাহিত্যকে তুলে নিয়ে মধ্যবিত্তের মধ্যে মুক্তি দিলেন আর এক বিত্তবান এবং নিজেকে ডিক্লাস্ড করতে চাওয়া লেখক রবীন্দ্রনাথ। বিশেষত তাঁর নোবেলপ্রাপ্তি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যেমন ভারতের অধিনায়কত্ব বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার পর চারিদিকে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পের জোয়ার উঠেছিল, প্রায় সে ভাবেই চার দিকে কাব্যসাহিত্যচর্চার বান শুরু হয়ে গেল। নৃত্য বা গানেরও। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টা সহজ ছিল না মোটেও। মঙ্গলকাব্য ইতিহাস রচয়িতা আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক স্মৃতিগ্রন্থে ‘একটি অনুষ্ঠানের বিবরণ’ দিতে স্মরণ করছেন, ১৯২৯-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল-এ আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক সন্ধের কথা। দুই বোন মঞ্চে উঠবে। ছোট বোনটির বয়স আট-নয়, সে, ‘একটু সাজিয়া গুজিয়া মঞ্চে উঠিয়া হাত-পা নাড়িয়া নৃত্যের ভঙ্গি করিবে, পিছন হইতে দিদি হারমোনিয়াম বাজাইয়া একটি রবীন্দ্রসংগীত গাহিবে।’ সংশয় যে ছিল, তাও ছাত্র আশুতোষ বলছেন, কারণ অনুষ্ঠানের নির্ঘণ্টে Dance না লিখে লেখা হয়েছিল action song, কিন্তু ঝামেলা বাধলই। কেননা, ‘অনুষ্ঠান হইয়া যাইবার পরের দিনই ঢাকার ‘ঢাবুক’ পত্রিকা ইহার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে হেডিং দিয়া ছাপাইল: জগন্নাথ হলে আবার মেয়ে নাচিল।’ নাচ বা গান যে কেন পরবর্তী ক্ষেত্রে বঙ্গজীবনে কেবলমাত্র বিবাহোপযোগিতার কাজে লাগবে কনেদের, তা এই ঘটনা থেকে খানিকটা বোঝা যেতে পারে। এর বহু দিন পরে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন। যাঁর সাহিত্য থেকে এই স্বীকৃতি, সারা পৃথিবীর এক জন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে গড়পড়তা বাঙালি মনে রাখল না তেমন, শুধু ঘরে ঘরে বহু গোদার বুনুয়েল তারকভ্স্কির জন্ম হয়ে গেল। রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান প্রকরণ হারমোনিয়াম গিটারে রূপান্তরিত হল গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে নানান কার্যকারণসূত্রে। তারও অবশ্য একটা প্রাগিতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের অনুপুঙ্খ বিচারে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ তথা গৌতম চট্টোপাধ্যায় সেই ধারার পথিকৃৎ— বাংলা উপন্যাসের প্রতিতুলনায় তিনিই আমাদের বঙ্কিম; রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র যেমন তার অনেক পরের ঘটনা। কিন্তু ওই যে বাঙালি বুঝতে শুরু করল ‘সংস্কৃতি ছাড়া গীত নেই’, তা তবে ওই উপনিবেশবাদ এবং তার বিরুদ্ধ নিজস্ব চাপ— এই দুইয়ের সমবায়। যা সে নিজের শরীরে ধারণ করল প্রায় নিয়তির মতোই।