ছেলের স্কুলের রেজাল্ট নিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। সোফার ওপর পা ছড়িয়ে বসা। পরিচারিকা দাঁড়িয়ে পায়ের কাছে। একটা দগদগে বিষফোঁড়া হয়েছে পায়ে। তুলো দিয়ে পরিষ্কার করছেন সেটা। পরিষ্কার করে নিয়ে পা গুটিয়ে আড্ডা দিতে বসলেন লকেট।
এত বছর অভিনয় করছেন। ফিল্মের দুনিয়ায় অভিনয় বেশি দেখলেন, না রাজনীতির জগতে?
(হাসি) অভিনয়টা রাজনীতিতেই বেশি। এমন মানুষ আছেন যাঁরা অ্যাকশন, কাট ছাড়াই অভিনয় করেন।
বলছেন এঁরা ফিল্মে অভিনয় করলে টলিউডের ছবিগুলো হিট হত!
দেখে মনে হয়েছে আমরা আর পর্দায় কী অভিনয় করলাম! একবার এক গুণিজনকে ক্ষমতাশালী কারও শিল্পকৃতি দেখানো হচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছে সেই গুণী মানুষের সেটা ভাল লাগার কথা নয়। কিন্তু উনি অভিনয় করে ‘দারুণ দারুণ’ বলে গিয়েছেন। হয়তো কোনও চ্যাট শো-তে গিয়েছি। সেখানে ক্যামেরার সামনে শুনলাম কেউ বলছেন কী দারুণ উন্নয়ন হচ্ছে। যেই শো শেষ হল, ওমনি বলে ফেললেন ‘কিছু হবে না দলটার। যা বলেছেন, একদম ঠিক বলেছেন!’
একটা সময় আপনি সুদূর আন্দামান-নিকোবরে গিয়ে তৃণমূলের জন্য প্রচার করতেন। এখন যদি ওই একই দ্বীপে বিজেপির জন্য প্রচার করতে যেতে হয়! কেমন লাগবে?
আমাকে যে রকম কাজে ইনভলভ করা হবে, আমি সেটাই করব। এক সময় তৃণমূলে থাকতে ইন্ডাস্ট্রির কিছু মানুষের কাছে শুনতাম: ‘কী করছিস তুই এখানে? লুটেপুটে খেয়ে নে।’ শুনে খুব খারাপ লাগত। আমি তো লুটেপুটে নিতে আসিনি। উন্নয়নের স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্যই আমি তৃণমূলে গিয়েছিলাম। আজ যে পার্টিতে আছি, সেটা কিন্তু বিরোধী পার্টি। তৃণমূলে থাকাকালীন মহিলা কমিশনের সদস্য ছিলাম। সে সব ছেড়ে এখন আমি বিজেপিতে এসেছি। নিশ্চয়ই কিছু কাজ করতে পারব, এই আশা নিয়েই এখানে এসেছি।
মহিলা কমিশনে থাকার সময় কি কাজ করার অসুবিধে হত?
নিজেকে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো মনে হত। নাম কে ওয়াস্তে একটা পোস্ট। একজন সাংসদ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে মহিলাদের নিয়ে কী অপমানজনক কথা বললেন! তাঁর বিরূদ্ধে কী অ্যাকশন নেওয়া হল? কমিশনের চেয়ারম্যানকে বলতাম, ‘কী গো, কিছু বলা যাবে না?’
আপনি নিজে কিছু বলেছেন?
ওঁর সঙ্গে আমার হাই-হ্যালো টার্মস। আমার থেকে অনেক সিনিয়র। এবিপি আনন্দ-তে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি বলেছিলাম এটা খুব লজ্জার ব্যাপার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার কথা বলব। মেয়েটি যখন অভিযোগ জানায়, শুনেই আমরা দৌড়ই সেখানে। প্রো-ভিসির সঙ্গে কথা হয়েছিল। ঘটনাটা ওখানেই পরিষ্কার হয়ে যায়। সেখানেই সমাধান হয়ে যেত। দোষীদের খুঁজে বের করা আর তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। কিন্তু হস্তক্ষেপ করতে পারিনি। তার পর এত আন্দোলন। সেদিন যদি আমরা স্টেপ নিতে পারতাম, তা হলে ‘হোক কলরব’-এর দরকারই হত না।
একটা অপ্রিয় প্রশ্ন করছি। দল পরিবর্তনের পর কেউ যদি আপনাকে পাল্টি দিদি বলে ডাকেন?
বলতেই পারে। তারা তো বিষয়টা বোঝে না। আমাকে বললে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু আমি সময় চাইব এটা বোঝানোর জন্য যে কেন আমি আজ পাল্টি দিদি হয়েছি। আশা করি তখন আর পাল্টি দিদি বলবে না।
ক্যাম্প পাল্টালে সবাই আদর্শের কথা বলে থাকেন। ইন্ডাস্ট্রি থেকে রাজনীতিতে আসা অরিন্দম শীল আর আপনি, দু’জনেই দল পাল্টেছেন। দু’জনের পার্থক্যটা কোথায়?
অরিন্দম শীল এক সময় ভীষণ ভাবেই সিপিএম-কে সাপোর্ট করতেন। চ্যাট শো থেকে শুরু করে ফেসবুকে লেখালিখি করতেন। এখনকার সরকার নিয়ে কী সব কথা বলতেন। আমি তৃণমূলে থাকাকালীন অন্য কোনও দলকে আক্রমণ করিনি। বরং বলে গিয়েছি কী কাজ হচ্ছে, কী উন্নয়ন হচ্ছে। এরা সারাক্ষণ ব্যক্তি আক্রমণ করে গিয়েছে। আজ অন্য কথা বলছে। যারা সত্যিই তৃণমূলকে ভালবাসত, যারা দিদিকে ভালবাসত, তারা আজ দিদির থেকে দূরে চলে গিয়েছে। আর সুবিধেবাদী মানুষেরা দিদিকে ঘিরে রয়েছে। তারা কর্মী হিসেবে ওই দলে আসেনি। শুধু সুবিধে নিতে এসেছে। আমি এত দিন ওই দলে থেকেছি। একটাও সুবিধে নিইনি। প্রযোজক সংস্থার ঘনিষ্ঠ হয়ে রোলও চাইনি।
তার মানে আপনাকে পাল্টি দিদি বললে সঙ্গে ব্র্যাকেটে কি লেখা উচিত কাজে নিবেদিত প্রাণ?
(হাসি) না, না। পাল্টি দিদি যদি বলেন, তা হলে ব্রাকেটে লিখতে পারেন...
...কর্মযোগী?
(হাসি) লিখুন পাল্টি দিদি (কর্মযোগিনী)।
আর অরিন্দম শীলের ক্ষেত্রে?
পাল্টি দাদা (সুবিধেবাদী)।
একটা সময় রাজনীতি করতে এসে আপনাকে তো এন্টারটেনমেন্ট ব্রিগেডের সদস্য হতে হয়েছিল...
প্লিজ, ওই ঝিঙ্কু মামণিদের ভিড়ে থাকতে চাইনি। কী লজ্জা যে লাগত! শুধু আমার নয়, সত্তর শতাংশ মেয়ের এ রকম লাগত। কিন্তু কিছু বলতে পারত না। কারণ কাজ চলে যাবে। ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে যাবে। সিনেমার হিরোইন হতে পারবে না। অগত্যা... মনে হত যেন গোরুর পল্টন গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। বলছে চলো, আজ এখানে কাল সেখানে। আমি কাউকে গোরু বলছি না। আমার নিজেকে মনে হত যেন গোরুর পল্টনের একজন। একবার মনে আছে স্টেজে উঠিয়ে দেওয়া হল আর বলা হল ‘চালিয়ে যাও’। মুখে হাসি, কিন্তু মনে মনে ভাবছি এ কোথায় এলাম! ভাবতাম রাজনীতি করতে এসে হঠাৎ করে স্টেজে মাচার শো কেন করতে হচ্ছে!
আর্টিস্ট ফোরাম নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। শিল্পীদের সংগঠনে কি রাজনীতির রং থাকা উচিত?
আর্টিস্ট ফোরামের মিটিং আমি অ্যাটেন্ড করতাম না। ওখানে আমি চাই না কোনও রং থাকুক। আজ আমি বিজেপিতে আছি। তবু চাই না আর্টিস্ট ফোরামে বিজেপির রং লাগুক। নিরপেক্ষতা চাই।
সেন্সর বোর্ডে বিজেপির রং লেগেছে বলেও প্রশ্ন উঠছে...
মানুষের রাজনৈতিক মত থাকবেই। কিন্তু তার রং যেন এই সব সংগঠনগুলোতে না লাগে। যদি কেউ রাজনৈতিক দলের মানুষও হয়ে থাকেন তবুও এই বিষয়গুলোকে নিরপেক্ষ ভাবেই বিচার করা উচিত।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো তো অনেকেই ব্যবহার করেন রাজনৈতিক ভিত বাড়ানোর জন্য। সেখানে নিরপেক্ষতা কোথায়?
আমি নিরপেক্ষতা চাই। ভাবুন তো ‘হোক কলরব’-এর ব্যাপারটাই। কোনও রাজনৈতিক দল সেখানে ঢুকতে পেরেছে? পারেনি। ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে সবাই যদি এক হতে পারে, তা হলে কোনও রাজনীতির রং লাগানো যাবে না। রানাঘাট কাণ্ডটা দেখুন। আমি ওখানে গিয়েছিলাম। ফাদার এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন কেন উনি চাননি আমি স্কুলে ঢুকি। একজন মহিলা হয়ে আমি এই ঘটনার শুনে থাকতে পারিনি। কিন্তু ফাদারের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম উনি আমাকে ঢুকতে না দিয়ে ঠিক করেছেন। এই ঘটনায় ওরা যে রাজনৈতিক রং লাগাতে চায়নি, তা নিয়ে আমি খুশি।
আজ থেকে পাঁচ বছর পরে রাজনীতির দুনিয়ায় আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান? পাল্টি দিদি থেকে কি কাউন্সিলর, এমএলএ, এমপি, মিনিস্টার...
কাজ করতে চাই।
এমন কোনও রাজনীতিবিদ আছেন, যিনি অন রেকর্ড বলবেন যে তিনি কাজ করতে আসেননি?
না...
এটা নিশ্চয়ই দেখছেন না যে পাঁচ বছর পরেও এই ঘরেই বসে পায়ে ফোঁড়া নিয়ে আনন্দplus-কে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন...
(হাসি) না... এখন যদি নির্বাচনে দাঁড়াতে বলে, আমি না করে দেব। কারণ আমি মানসিক ভাবে তৈরি নই।
ইচ্ছে করে না লালবাতি দেওয়া গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে আর তার সঙ্গে চুটিয়ে সিনেমা করে যেতে?
এমপি, এমএলএ হয়ে অতিথিশিল্পী হয়ে থাকতে পারব না। যদি কাজ করতে চাই, তা হলে সিনেমা করার সময় কোথায়? শো করে যেতে হবে। ওখান থেকেই আমরা রোজগার করি। এমপি, এমএলএ হয়ে আমি কোনও পার্টির চিয়ারলিডার হব না।
গ্ল্যামারে কি ভোট পাওয়া যায়?
কাজ দিয়ে ভোট পাওয়া যায়। মানুষকে অত বোকা ভাববেন না। তারকাকে স্টেজে দেখে ভিড় করবে। অন্য পার্টির ভোটাররাও আসবে। মাচার শো দেখতে গেলে টাকা দিতে হয়। এটা ফ্রিতে হয়ে যায়। আমি যদি ভাবি মিষ্টি মিষ্টি সংলাপ বলব, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ বলে গান গাইব, এ সব দিয়ে ভোট আসবে না। কোনও দিনই আসত না। লোকে ভুল ভাবত।
গোধরা দাঙ্গা নিয়ে আপনার কী মত?
বিষয়টা সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না।
নিন্দুকরা বলছেন আপনি যে দলবদল করেছেন, তার কারণ আপনি একজন রাজনীতিবিদের খুব ঘনিষ্ঠ...
আমাদের পেশাটায় তকমা দেওয়া হয়। একটা ফিল্ম পেলেই বলা হয় প্রযোজকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বলেই কাজটা পেয়েছি। এতে দমব না। ছেলেদের তো বলা হয় না যে, অমুকের সঙ্গে প্রেম আছে বলে সে মন্ত্রী হয়ে গেল। ভাবটা এমন যে, মেয়েরা তো এমনিতে কিছু পারবে না তাই বলাই যায়। সারা দেশে মহিলাদের এত কদর। ওবামা এদেশে যখন এসেছিলেন, পূজা ঠাকুর বলে একটি মেয়েকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার জন্য। আর পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের নিয়ে বড় বড় বুলি। মানসিকতায় নিম্নমেধার।
পয়লা বৈশাখে মুক্তি পাচ্ছে আপনার অভিনীত ‘যোগাযোগ’। রোলটা নিয়ে কিছু বলবেন?
রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’। নিস্তারিণীর চরিত্রে রয়েছি আমি। জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে আমি পোড় খেয়ে গেছি। বাড়িতে নতুন বৌ এলে আমি তখন ওকে বলি, ‘এখানে এ সব মেনে নিতে হয়। আমরা এখানে সব্বাই দাসী’।
নিজের জীবনে তো আপনি...
...একদম মানি না। ছেলে-মেয়েদের আলাদা আলাদা সত্তা আছে। কাউকে কারও মতো হতে হবে না।
মহিলাদের অধিকার নিয়ে আপনি কথা বলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী নিয়েও অনেক বিতর্কিত কথা ওঠে। আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?
দেখুন, এটা একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যক্তিগত জীবনে কে কখন কী করছে, সেটা নিয়ে খুঁত ধরাতে আমি বিশ্বাসী নই।
ছবি: কৌশিক সরকার, মেক আপ: অনিরুদ্ধ চাকলাদার, পোশাক: গৌরাঙ্গ শাহ্।
আনাচে কানাচে
লুক টেস্টের ফাঁকে: নাইজেল, ঋতাভরী, রূপা, ভাস্বর। ছবি ‘অপলা’।
সঙ্গে পরিচালক শতরূপা সান্যাল। ছবি: কৌশিক সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy