Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মিস্টার ডালমিয়া

পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া ক্রিকেট মহাপ্রশাসককে টানা বত্রিশ বছর কাছ থেকে দেখেছেন গৌতম ভট্টাচার্য। কখনও পরম বন্ধুত্বে। কখনও তীব্র ঝগড়ায়...পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া ক্রিকেট মহাপ্রশাসককে টানা বত্রিশ বছর কাছ থেকে দেখেছেন গৌতম ভট্টাচার্য। কখনও পরম বন্ধুত্বে। কখনও তীব্র ঝগড়ায়...

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

বছরটা অবশ্যই ১৯৯৬। মার্চ কী এপ্রিল— মাস মনে পড়ছে না। মাসটা অবশ্য প্রয়োজনীয়ও নয়।

ইডেনে খেলছে সিএবি প্রেসিডেন্টস ইলেভেন বনাম কলকাতা ক্রীড়াসাংবাদিক দল। তখন এই ম্যাচটা একটা বার্ষিক ফিক্সার ছিল। কালের নিয়মে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। অথচ তখন জগমোহন ডালমিয়া-সহ সিএবি-র পুরো টিম খেলত। অম্বর রায়, রুশি জিজিবয়, সম্বরণরা সবাই। চরম হাড্ডাহাড্ডি খেলা হত একটা প্রীতি ম্যাচের মাধুর্য রেখে।

সে বছর বিশ্বকাপ শেষ হওয়া পরবর্তী ছবিটা যে এমন তিক্ততায় বদলে গেছে প্রথম বল হওয়ার আগে কেউ বোঝেনি। কলকাতা মিডিয়ার সঙ্গে বিশ্বকাপের আনুষঙ্গিক নানা কিছু নিয়ে সে বার টুর্নামেন্ট চলাকালীন ডালমিয়ার ধারাবাহিক খটাখটি লেগেছে। কিন্তু সেই গরল যে এই পর্যায়ে নেমেছে কে জানত!

ডালমিয়া ওপেন করতেন। তিনি প্রাক্তন রঞ্জি ক্রিকেটার তপন ভট্টাচার্যকে নিয়ে নেমেছেন। হাইকোর্ট এন্ড থেকে প্রথম ডেলিভারিটাই তাঁর নাক ছুঁয়ে চলে গেল। ডালমিয়া আশ্চর্য হয়ে তাকলেন। এমন নয় যে এই ফ্রেন্ডলি ম্যাচটায় তাঁকে কেউ ফুলটস দিয়ে রান করতে দেয়। তবে এ ভাবেও কেউ বল করে না গোটা ওভার ধরে যা চলল। অবিরাম বাউন্সার। তপন এগিয়ে গেলেন নন স্ট্রাইকার প্রান্ত থেকে। খুব লজ্জিত মুখ। ‘‘স্যর, আপনি কোনও রকমে একটা সিঙ্গলস নিন। আমি দেখে নিচ্ছি।’’ কিন্তু ওই গতিতে বল ডালমিয়া ছোঁয়াতেই পারছেন না। পরের ওভারে যে ক্রিকেট লিখিয়ে বল করতে এল, সে এখন দিল্লিতে থাকে। এককালের জুনিয়র বেঙ্গলের পেসার। তার ওভারেও একই জিনিস। বোঝা যাচ্ছে দু’জনের সঙ্গেই বিশ্বকাপ চলাকালীন নির্ঘাৎ তাঁর অবিরাম খটাখটি হয়েছে। আর তাই আজ এরা প্রীতি দেখানোর কোনও কারণ দেখছে না।

ডালমিয়াকে দৃশ্যত বিস্ফারিত দেখাচ্ছে। মুখে কিছু বলছেন না, কিন্তু চোখেমুখে মনের ভাব ফুটে উঠছে যে, ‘হেলমেটহীন আমি। এটা কী হচ্ছে!’ তপন এগিয়ে এলেন এ বার। ‘‘গৌতম, এটা কী হচ্ছে? আটকাও।’’

বললাম, আমার কিছু করণীয় নেই। ক্যাপ্টেন সাবা। বোলারকে কিছু বলতে হলে ওকে বলতে হবে। ‘হিন্দু’র সাবানায়কনকে তখন ডাকা হল। কভার পয়েন্টে ফিল্ডিং করছে। সাবাকে দেখে বোঝা গেল, ও নিজেও প্রচণ্ড আশ্চর্য, বোলারদের বলবে কী! হা হয়ে গেছে। এর আগে কখনও এ জিনিস ঘটেনি। এ তো যে কোনও সময় মুখ ফেটে যেতে পারে। হাত ভেঙে যেতে পারে ডালমিয়ার। অন্যতম আম্পায়ার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় এ বার জটলায় এগিয়ে এলেন। ‘‘বোলারদের কিছু বলো। নইলে এদের চেঞ্জ করো।’’

থার্ড ওভার যখন শুরু হচ্ছে, শর্ট কভার থেকে ডালমিয়ার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে নিশ্চিত হয়ে গেছি যে এখন হয় দমাদ্দম চালাবে। নইলে পালাবে। সত্যি তো ভারতীয় ক্রিকেট যে লোকটা একা চালায় সে এখানে বেমক্কা ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? নন-স্ট্রাইকারকে এ বার ডাকলেন ডালমিয়া। বুঝলাম বোঝাচ্ছেন, ‘‘আমি চলে যাচ্ছি। এটা অসভ্যতা হচ্ছে!’’

আসলে ঠিক উল্টোটাই বলেছিলেন, ‘‘আমাকে নিয়ে ভেবো না। আলোচনাও করতে যেয়ো না।’’ আরও আধঘণ্টা কাটিয়ে চল্লিশের কাছাকাছি করেছিলেন। ওঁকে কিছু বলিনি। কিন্তু সে দিন নীরব স্যালুট করেছিলাম মানুষটাকে। হ্যাঁ, মানতেই হবে মস্তানি। এই লোকটা সত্যিই জীবনে পালাতে জানে না। সে আইসিসি-র সাহেবদের সঙ্গে লর্ডসেই হোক। বা ক্রিকেট মাঠে গরল ওগরানো মিডিয়ার সামনে!

আলাপ এবং ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা অবশ্য তার অনেক আগে হয়ে গিয়েছে। তিরাশিতে চাকরির একেবারে গোড়ায় হেমু অধিকারীর ইডেন কোচিং ক্যাম্পের কভার করতে গিয়েছিলাম। তখনই টকটকে ফর্সা সিএবি সচিব এসে আলাপ করেন। শুরুতে মোটেও সুবিধার মনে হয়নি। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী। কন্সট্রাকশনের ব্যবসা করে। তেল দিয়ে পেতে চুল আঁচড়ানো। এ তো বাংলা সিনেমার প্রোটোটাইপ ভিলেন। জটায়ুর ভাষায় ‘হাইলি সাসপিশিয়স’। এর খুব একটা কাছে যাওয়া নেই, সম্বোধনেও দূরত্ব রাখতে হবে। তাই বিশ্বনাথ দত্তকে যদিও ডেকে এসেছি বিশুদা। তখনকার সিএবি ট্রেজারার সৌরভের বাবাকে অবলীলায় চণ্ডীদা। কিন্তু ডালমিয়াকে প্রথম দিন থেকে ‘আপনি’ এবং মিস্টার ডালমিয়া। এই বত্রিশ বছরে একবারও ময়দানের পরিচিত সম্বোধন করিনি — জগুদা। উনিও নাম ধরে কখনও ডাকেননি। বলতেন, ‘মিস্টার ভট্টাচারিয়া’। উনিও বরাবর ‘আপনি’ বলেছেন। তুমি নয়।

ফর্ম্যাল সম্পর্ক রাখা ছাড়াও কেন জানি না মনে হত এ চূড়ান্ত ব্যবসায়ী। বেশি নেবে — তবেই দেবে। কাজেই গিভ অ্যান্ড টেক শুরু থেকে থাকাই ভাল। আমার চাই এক্সক্লুসিভ খবর। ওঁর চাই ভেতরের কিছু তথ্য। যেমন সুভাষ চক্রবর্তীর ফ্রেন্ডস অব দ্য স্টেডিয়াম টেস্টের দশ হাজার টিকিট চেয়ে বসে রয়েছে। ওটাই নাকি ওদের সদস্য সংখ্যা। অথচ তাদের ব্যাঙ্কার কানাড়া ব্যাঙ্কের মারফত পাওয়া তথ্যে সদস্য সংখ্যা দেখে এসেছি মাত্র ১৫৩ জন।

তথ্যটা দিতেই ডালমিয়া লাফিয়ে উঠলেন। তখনও সুভাষবাবুর সঙ্গে ওঁর পরবর্তী কালের অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়নি। তার মানে অনেক কম টিকিট দিলেই চলবে। কিছু দিনের মধ্যেই ইডেনে টেস্ট ম্যাচ। সেই গাওস্করের দেরিতে ডিক্লেয়ার দেওয়া নিয়ে ইডেন উত্তাল। ডালমিয়া একটা চিরকুট পাঠালেন ড্রেসিং রুমে। বিশ্ব ক্রিকেটে বোধহয় প্রথম এমন কিছু ঘটল যে, সংগঠক হোম ক্যাপ্টেনকে বলছে, ‘এ বার ডিক্লেয়ার না করলে ক্যালকাটা পুলিশ বলছে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিতে পারে।’ ডালমিয়া খবরটা জানিয়ে হালকা করে বললেন, ‘‘বলতে পারবেন না যে জানাইনি।’’ পরের দিন আনন্দবাজারে ওটা প্রথম পাতার লিড। কিন্তু জীবনের প্রথম লিড স্টোরিতে ঢুকে পড়ার আনন্দের মধ্যেও খচখচ করল যে, লোকটা তার মানে বোঝাল ১-১ করেছে। নিয়েছিল, এ বার দিল। তা হলে ‘মিস্টার ডালমিয়া’ ঠিকই আছে।

ডালমিয়ার দাদাগিরি

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

লোকটা সোর্স হিসেবে থাকবে। থাক। তবে একেও তার প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু কিছু দিতে হবে। যাকে বলে ডিল।

সমস্যা হল এমন উল্কার গতিতে উত্থান শুরু করলেন ডালমিয়া যে, আমার কেন, ভূভারতে কারও সোর্স হতে বয়েই গেছে তাঁর। সাংবাদিকের সোর্স হয় একটু মাঝারি স্তরে যে থাকে। বড় কর্তা তো আর সোর্স হয় না। বড় কর্তাকে বড়জোর খবর পেয়ে কনফার্ম করা যায় যে খবরটা ঠিক আছে কি না?

ডালমিয়ার ক্ষেত্রে তাতেও সমস্যা ছিল। খবরের ব্যাপারে তিনি খুব রক্ষণশীল। যতক্ষণ না শেষ বলটা খেলা হচ্ছে, পরিণাম বিশ্বাস করেন না। এখনকার যে ময়দানি কর্মকর্তারা হাফবেকড, অবাস্তব খবরগুলো সাংবাদিকদের নিত্যদিন খাইয়ে দেন তাঁদের ডালমিয়ার থেকে হাঁটু গেড়ে শেখার আছে। দু’হাজার সাল নাগাদ শুনলাম কীর্তি আজাদ উত্তরাঞ্চল সিলেক্টর হচ্ছেন। কীর্তি হওয়া আমাদের কাছে তাৎপর্যের কারণ তিনি সৌরভ সমর্থক। ডালমিয়া বললেন, ‘‘খবরটা পুরো ঠিক নয় এখনও। ধৈর্য ধরুন।’’ তাঁর স্টাইল ছিল কারওকে কোনও পদের জন্য মনোনীত করেই বিবৃতি ছেড়ে দিতেন না। সংশ্লিষ্ট লোকের কাছে লিখিত সম্মতি নিতেন আগে। কীর্তিকেও জানা গেল সম্মতি চেয়েছেন। কিন্তু কীর্তির কাছে যখন খবর গিয়েছে তখন বেশ রাত্তির এবং তিনি দিল্লির ডিস্কোথেকে ঢুকে পড়েছেন। ডালমিয়া বলেন, ‘‘ওই ডিক্সোর ফ্যাক্স থেকেই এক লাইন পাঠাও আমার নির্বাচক হতে আপত্তি নেই।’’ বোর্ডের একটা সূত্রে খবরটা পাওয়ার পর ডালমিয়াকে মাঝরাত্তিরে ফোনে ধরলাম, চেপে গেলেন তো। আপনি মশাই ডিস্কোথেকে কীর্তিকে দিয়ে ফ্যাক্স করালেন আর আমায় বলছেন চূড়ান্ত নয়! বললেন, ‘‘এখনও না।’’ বিশ্বাস করিনি। লিখে দিই। পরের দিন কীর্তির বদলে অন্য কেউ নির্বাচক মনোনীত হন। উত্তরাঞ্চল কর্তারা বৈঠকে এসে বলেন তাঁরা কীর্তিকে চান না। ডালমিয়াও আর জোরাজুরি করেননি।

কাহিনির সারমর্ম হল, পরিস্থিতি যে দিকেই গড়াক নিজের ডিফেন্স সব সময় অটুট রাখতেন ডালমিয়া। কাগজ যেন তাঁর হাতে থাকে। কোনও কিছু যেন হাওয়াতে না হয়।

একটা সময়ের পর বুঝতে পেরে গিয়েছি এই লোকটা অনেক বাঙালির চেয়ে মনের দিক থেকে বেশি বাঙালি। জটায়ু ফর্মুলার ‘হাইলি সাসপিশিয়স’ আদৌ নয়। কিন্তু এর মুখ্য স্কোরিং শট হচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খ হোম ওয়ার্ক। আর এই ডিটেলের কাজটা সবচেয়ে মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো। একবার মতি নন্দী আর অজয় বসুর পায়ের অপারেশনের জন্য ডালমিয়া বললেন, বোর্ড থেকে এক লক্ষ টাকা করে দেবেন। সহজ প্রসেস: ডক্টরের সার্টিফিকেটের সঙ্গে ওঁদের চিকিৎসার জন্য আমি তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে একটা আবেদন করব। অবশ্যই প্রবীণ দুই সাংবাদিকের সম্মতি-সহ। এর পর বোর্ড ওঁদের চেক দিয়ে দেবে।

সহজ প্রসেস কিন্তু সহজ নয়। ডালমিয়া আছেন যে। বললেন, ‘‘একজন ডাক্তারে হবে না। কেসটা ভাল করে সাজান। অন্তত তিনজন চিকিৎসকের লিখিত ওপিনিয়ন জমা দিন যে, এটা অপারেশন ছাড়া সামলানো যাবে না। তা না হলে মুশকিল।’’ বিরক্ত হয়ে বলি, কীসের মুশকিল। আপনিই তো বোর্ড। তা ছাড়া ওঁরা তো অপারেশন করানোর পর কাগজপত্র দিয়েই দেবেন। ডালমিয়া ঘাড় নাড়েন, ‘‘দু’জনকেই খুব শ্রদ্ধা করি। কিন্তু পাবলিক বডিতে আছি। কবে বোর্ডে আমার জায়গায় কে আসবে। সে কী বলবে। সব কিছু নিশ্ছিদ্র থাকা ভাল।’’

সব কিছু নিশ্ছিদ্র করাটা তাঁর ট্রেডমার্ক স্টাইল ছিল। যখন যা করেছেন আগাম লিখিত নথি হাতে রেখেছেন। প্রতিটি ডকুমেন্ট, প্রতিটি ফাইল কোথাও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। এক এক সময় অবাক লেগেছে এত সফল মানুষটা কেন নিজের জগতের বাইরে কোনও খোঁজখবর রাখেন না। সুনীলের ‘সেই সময়’ পড়া দূরে থাক‌, নাম শুনেছেন বলে মনেও হয় না। কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’ কী, কিছুতেই বলতে পারবেন না। একবার এবিপি-তে লেখা হয়েছিল সৌরভের জন্য যদি ডালমিয়া কিছু না করে থাকেন তা হলে ধরতে হয় হ্যারি পটার লিখেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। ডালমিয়া লেখাটা পড়ে সাতসকালে তাঁর শুভানুধ্যায়ীকে ফোন করেছিলেন, ‘‘এই হ্যারি পটার ব্যাপারটা কী বলো তো?’’ একটা দিক ঝাপসা শুধু নয়। নেই। কিন্তু যে দিকটা আছে পুরোটা নখদর্পণে। সেখানে চ্যাম্পিয়ন।

ডালমিয়ার আসল স্কিল বরাবরই মনে হয়েছে তাঁর ফোকাস। অভিনেতাদের মতো তাঁর কোনও সুইচ অফ, সুইচ অন ছিল না। সুইচ সবসময় অন। ২৪x৭।

তার সঙ্গে ক্ষুরধার বুদ্ধি। কে কোনটা চাইছে মুহূর্তে ধরে ফেলা। কোনও সাংবাদিকের হয়তো চাই নিছক খবর। অবধারিত স্ট্র্যাটেজি হবে, তাকে খবর দিয়েই ডিল করে তার সেরাটা নিজের কাজে লাগিয়ে নেওয়া। কেউ হয়তো চায় টিকিট। তাকে টিকিট দিয়ে খুশি করো। কোনও অফিশিয়াল হয়তো চায় বিদেশে ম্যানেজার হয়ে যেতে। তাকে ম্যানেজার করে অনুগত বানিয়ে নাও। এই চতুর লেনদেনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ডালমিয়া। ঝোপ বুঝে বড় বড় হাতিঘোড়াদেরও এমন কোপ মেরেছেন যে তাঁরা বশ্যতা স্বীকার করে ফেলেছে। কপিল, গাওস্করেরাও সেই তালিকায় পড়বেন। দেখতে দেখতে অনবরত মনে হত এ হল মারিও পুজ়ো-র ‘গডফাদার’। যেন বলছে, ‘‘আই উইল মেক অ্যান অফার দ্যাট ইউ কান্ট রিফিউজ।’’

বোর্ড থেকে বিতাড়িত ডালমিয়ার বিরুদ্ধে যখন আর্থিক অভিযোগ উঠত, একবারও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি। হ্যাঁ, লোকটা চূড়ান্ত ক্ষমতার সাধক। প্রতি শনিবার গোখেল রোডের হনুমান মন্দিরে যায় সাহস ধরে রাখতে। অথচ আবার জ্যোতিষীর সঙ্গে নিয়মিত পাথর নিয়ে কনসাল্ট করে রাজত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু এঁর যা অহং, পয়সা নিয়ে দু’নম্বরির মধ্যে যাওয়ার মানুষ বোধহয় নন।

ভারতীয় বোর্ড অবশ্য সেই আত্মগর্বেই আঘাত করেছিল। টাকা তছরুপের দায়ে মুম্বই আদালতে এফআইআর করে। গ্রেফতারই হয়ে যেতেন ডালমিয়া। আর তার হোতা ছিলেন এই পওয়ার আর শ্রীনিবাসন— যাঁরা গম্ভীর মুখে সে দিন মালা
দিতে এসেছিলেন। ললিত মোদী আর বিন্দ্রাও ছিলেন দলে। যাঁদের বিরুদ্ধে দৈনন্দিন দুর্নীতির অভিযোগ অন্তহীন। ঘনিষ্ঠরা মনে করেন, ওই যে অপমানে যন্ত্রণায় ভেতরটা পোড়া শুরু হল তাঁর, আর আদালতে আদালতে মামলা করে আত্মরক্ষা করতে হচ্ছিল তাঁকে, এই সময়ই ভেতরকার ট্রান্সফর্মার পুড়ে যায় তাঁর। যার পরিণাম গিয়ে দাঁড়ায় গত কয়েক বছরের অবিরাম অসুস্থতা। আর এ ভাবে চলে যাওয়া!

পঞ্চভূতে তিনি লীন হয়ে যাওয়ার পর থেকে যেন আরও আশ্চর্য লাগছে একটা মানুষ, তার হাতে না ছিল ব্যাট, না বল, না ছিল মুম্বই-দিল্লির ধনশালীদের মতো টাকা, না সে এমপি বা মিনিস্টার কিছু— তবু কী করে এত বড় রাজপাট তৈরি করেছিল যে ক্রিকেটমহলে এত বছর গোটা ভারতের বাংলা বিরোধী স্রোতটাও হামাগুড়ি দিয়ে শুনত! একটা মানুষ যাঁর ইংরেজি-বাংলা কোনও ভাষাতেই তেমন দক্ষতা নেই, গুছিয়ে বক্তৃতা করতে পারাটা যাঁর যোগ্যতার মধ্যে আদৌ পড়ে না — তিনি কী করে লর্ডসের এত দিনের মৌরসিপাট্টা ভেঙে দিলেন। কী করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথম নিয়ে চলে এলেন ইডেনে।

কাগজে পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরানোর প্রস্তাব দিচ্ছে ভারত লর্ডসের সভায়। আর ভারতের প্রতিনিধিত্ব কে করছে সেটা আর বলে দিতে হবে না। ফোনে বললাম, এটা বিরাট ঝুঁকি নিলেন না? ভারত সরকার সবে ওদের সঙ্গে খেলার অনুমতি দিয়েছে। আপনি আগ বাড়িয়ে একেবারে কি না সাউথ আফ্রিকাকে প্রপোজ করে দিলেন। ডালমিয়া বললেন, ‘‘কেন নয়! যদি সমর্থনই করতে পারি, তা হলে আর ওদের সমর্থনে প্রথম গলাটা আমার হতে আপত্তি কোথায়?’’ এর কয়েক সপ্তাহ বাদে আলি বাখারের মুখে শুনলাম, ‘‘সব দেশের অফার ছেড়ে ইডেনে প্রথম খেলছি কারণ আমাদের নামটা তো ডামিয়াই (বাখার বলতেন ডামিয়া) সবার আগে তুলেছিল।’’

এই দূরদর্শিতা কি কলকাতার নবীন কর্মকর্তারা অনুকরণ করতে পারবেন আগামী দিনে? না, এটা ক্রোমোজমের ব্যাপার? জিনের ব্যাপার? নইলে একটা লোক সিন্ধিয়ার টপ ফর্মে সিন্ধিয়াকে, পওয়ারের টপ ফর্মে পওয়ারকে হারায় কী করে। যদি রাজনৈতিক ব্যাকিংও পেয়ে থাকে সেটা পাওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে তো... অন্যদের করতে কে বারণ করেছিল!

ডালমিয়ার ব্যর্থতাও অবশ্যই আছে। লিলির পাকিস্তানে উইকেট নেই। সচিন-লারার লর্ডসে সেঞ্চুরি নেই। ভিভের বড় রান নেই কাদিরের বিরুদ্ধে। খুব কীর্তির জীবনেও কিছু অসম্পূর্ণতা তো থাকবেই। গড়াপেটা রোখায় যেমন আরও সপ্রতিভ হওয়া উচিত ছিল তাঁর। আজহার সম্বন্ধে আদ্যন্ত খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। সিবিআই-কে আগেই তদন্ত তুলে দেওয়া উচিত ছিল, যা মুথাইয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত হল। শহরভিত্তিক ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কোথায় যেতে পারে সেটাও তিনি আঁচ করতে পারেননি। সেই কবে চুরানব্বইতে তাঁর কাছে শহরভিত্তিক লিগের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন অরুণ লাল। মদত দিয়েছিলেন যিনি, বারো বছর বাদে তাঁর হাত ধরেই আইপিএল শুরু। কিন্তু ডালমিয়া তখন ললিত মোদীকে কোনও পাত্তা দেওয়ার কারণই দেখেননি। তাঁর মনে হয়েছিল দেশের আগে আবার ক্লাব বা শহর কী! নইলে আইপিএল ২০০৮-এ নয়, ১৯৯৪-এ শুরু হয়। চাকিং নিয়েও তিনি বড় বেশি নরমসরম ছিলেন। মুরলীর সময় থেকেই তীব্র আপসহীন হলে পরিস্থিতি আজকের চেহারায় নামত না।

তবে না পারাটা যোগ করেও পারার আশেপাশে আসবে না। ডালমিয়া সম্ভবত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থেকে যাবেন সেই ব্যক্তি হিসেবে যিনি ক্রিকেট মহল্লার একশ একুশ বছরের মেরুকরণটাই ভেঙে দিয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গ জোটকে আর একচ্ছত্র থাকতে দেননি। এটাই তো ক্রিকেট কর্মকর্তার পেশায় প্রথম দশ হাজার রান আর পাঁচশো উইকেট নেওয়া। যে ইয়ান চ্যাপেল ভারতীয় বোর্ডকর্তাদের প্রতি তীব্র অপছন্দে ইন্ডিয়া ম্যাচের কমেন্ট্রি অবধি করেন না তিনি শোকগাথায় ডালমিয়াকে ভরিয়ে দিয়েছেন প্রশংসায়। শুধু তো উপমহাদেশ নয়, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাও টুপি খুলছে। একজন কর্মকর্তার তো দিনের শেষে প্লেয়ারের থেকে বিচ্ছুরিত খ্যাতিতে বাঁচার কথা। এই লোকটা তা হলে জনপ্রিয়তার নিজস্ব স্যাটেলাইট স্টেশন তৈরি করেছিল কী করে?

সুপারঅ্যাচিভারদের কমন প্রবণতা হল তুচ্ছতম সমালোচনাতে উত্ত্যক্ত হয়ে যাওয়া। ডালমিয়ারও সেই বৈশিষ্ট্য ছিল। যখনই আক্রমণ করেছি, সম্পর্ক তাতে বিপন্ন না হোক প্রতিবার পলি পড়েছে।
গত কয়েক মাসে যেমন এবিপি-র খেলার পাতা বারবার বলেছে তাঁর শরীর কাজ করছে না। ইঙ্গিত দিচ্ছে সরে যাওয়া উচিত। ডালমিয়া সেই লেখালেখিগুলো একেবারেই মানতে পারেননি।

কিন্তু অবস্থা যে বিধ্বস্ত ছিল তাতে কোনও ভুল নেই। এ বারই তো বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে পঞ্চাশদিন পূর্ণ করার পর দশ নম্বর আলিপুর রোডে ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছি। প্রথম প্রশ্নটা শুনে ডালমিয়া বললেন আপনি বলুন উত্তর কী হবে? আমি শুনে তাজ্জব হয়ে যাই। আমি কী করে বলব আপনার কী উত্তর হবে?

‘‘লিখে দিন না সব দিক বাঁচিয়ে। আমার আসলে কিছু মাথায় আসছে না।’’ এমন প্রস্তাবে রাজি হইনি। তখন বললেন, ‘‘ওকে, আমি ৭৫ দিন পূর্তিতে ফোন করে ডেকে নেব। সে দিন নিজে বলব।’’ জানতাম ফোনটা আসবে না কারণ সে দিনও উনি গুছিয়ে উত্তর দেওয়ার জায়গায় থাকবেন না।

বারবার মনে হত ডালমিয়াও তো এক অর্থে বিরাট একজন পারফর্মার। কেন বোর্ডের বৈঠকে তাঁকে দু’দিকে দু’জন দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে হবে? কেন চেয়ারে বসার বদলে লোধা কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে টেবিলে বসে পড়বেন? এই অবস্থায় বোর্ড প্রেসিডেন্ট থাকার দরকার কী? সচিন আন্ডারহ্যান্ডে আউট হলে তাঁর সমর্থকরা তো বলবেই খেলা ছাড়ো। তোমাকে এই চেহারায় চাই না। পরিবার অবশ্য বলছিল মাঝে সোডিয়াম পড়ে যাওয়ায়, তাঁর এই হাল হয়েছিল। এখন আবার বেদানার রসটস খেয়ে ফিট। নিজেও নাকি ডাক্তারকে বলেছিলেন, ‘‘এগেন আই অ্যাম ব্যাক।’’

তাঁর মৃত্যুর সময় কলকাতা ছিলাম না। ফিরে এসে শুনেছি। হাসপাতালে ক’দিনের বসবাস নিয়ে কত রকম রোমহর্ষক খবর! কেউ কেউ বলেছে, পাকস্থলীর রক্তক্ষরণ আগের রাতেই শুরু হয়ে থাকতে পারে। স্টেন্ট বসানোর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ওটা আগেই অ্যাটেন্ড করা উচিত ছিল। কেউ বলছে ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত দক্ষিণ ভারতের ব্যবসায়িক সংস্থা বি এম বিড়লায় ফোন করে চিকিৎসার সব ভিতরকার খবর জানতে চেয়েছিল। অনেক কিছু গোপন খবর নাকি পেয়েও গিয়েছিল। কেউ বলছে, মৃত্যুর যা কারণ দর্শানো হয়েছে তা বড় বেশি নাটকীয়।

কুড়ি সেপ্টেম্বর রাতের পর এই সব আলোচনা অর্থহীন। মানুষটাই তো চলে গিয়েছে। মান্না দে-র বিখ্যাত গান দিয়ে বলতে হয়, ‘মুকুটটা তো পড়েই আছে, রাজা শুধু নেই’।

আর রাজা শুধু নেই তো নয়। তাঁর এমন আকস্মিক বিদায় যেন সম্মোহনগ্রস্ত করে দিয়েছে পরিচিতদের। এই লেখাটাও কেমন ঘোরের মধ্যে লিখছি। কই আর পাঁচজনের বেলায় তো হয়নি!

সম্মোহনের রেশেও অবশ্য এর পর ওঁর সঙ্গে দেখা হলে প্রথমে কী বলব ঠিক করে রেখেছি। নতুন জন্মে তো নতুন করে সব কিছু।

বলব, আপনি জানেন না চলে আসার পরেও গোটা কলকাতা কী হ্যাংওভারের মধ্যে ডুবে ছিল।

রিয়েলি ওয়েল প্লেড জগুদা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE