Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Entertainment News

ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে?

মান্না দে-র জন্মশতবর্ষে তাঁকে ফিরে দেখলেন তরুণ শিল্পীরা। শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়aএই সুরের রাজা হওয়ার পথে সুরের জাদুকর দেবজ্যোতি মিশ্র ফিরে যান মান্না দে-র ‘পড়সন’-এর গানে।

মানুষ মান্না দে ছিলেন কঠিন-কোমলে গড়া এক সুরপুরুষ।— ফাইল চিত্র।

মানুষ মান্না দে ছিলেন কঠিন-কোমলে গড়া এক সুরপুরুষ।— ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৮ ১৮:৫২
Share: Save:

জন্মদিনের সকাল। ২০১২ সাল। বেঙ্গালুরু। সুপর্ণকান্তি ঘোষ সে দিন সক্কাল সক্কাল মান্না দে-র কাছে। এই প্রথম জন্মদিনে ‘আন্টি’ নেই!

“মান্নাকাকু জন্মদিনে স্লিপিং সুট পরে কেবল ফোন ধরে চলছেন। আমায় দেখে বললেন, ‘‘তুমি আমার ফোনগুলো নাও। আমি চেঞ্জ করে আসি। দেখ, একটা শুভেচ্ছাও যেন বাদ না পড়ে। বহু দূর থেকে মানুষ আমায় ফোন করছেন।’’ আমি অবাক। তখন মান্নাকাকু ওয়াকারে, কিন্তু মানুষের প্রতি কি ভালবাসা! চুঁচুড়া থেকে অস্ট্রেলিয়া, কোথা না কোথা থেকে সে দিন যে ফোন এসেছিল, বলে বোঝানো যাবে না। কবিতা কৃষ্ণমূর্তি ফোন করে বলেছিলেন, ‘আজ আপনি ওর পাশে আছেন, এটাই ‘আন্টি’ চলে যাওয়ার পর ওর সবচেয়ে বড় গিফট।’ জন্মদিনে খাবার অর্ডার করে বিরিয়ানি আর মিট বল খাইয়েছিলেন তাঁর আদরের মান্নাকাকা, আজ খুব মনে পড়ছে তাঁর, তিনি সুপর্ণকান্তি ঘোষ। স্মৃতির মাঝে ফিরে গেলেন তাঁর মান্নাকাকার কাছে।

গানের জগতের আর এক সুরের মানুষ হৈমন্তী শুক্লার সকাল থেকে মন খারাপ। “আজ মান্নাদার জন্মদিনে আমার গানের ঘোরে ওর ছবির দিকে তাকিয়ে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কত স্নেহ পেয়েছি। ও রকম বিখ্যাত এক মানুষ, কিন্তু কোনও দম্ভ নেই। এক বার অজগাঁয়ে স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি শিল্পীদের বসার ব্যবস্থা অবধি নেই। আমি তো বেশ রাগ দেখালাম। কিন্তু হঠাৎ দেখি মান্নাদা! তা-ও আবার স্কুলের একটা বেঞ্চের ওপর বসে ভাঁড়ের চা খাচ্ছেন। সে দিন বলেছিলাম নিজেকে, ধিক হৈমন্তী!” নরম গলায় ভেসে এল সে দিনের স্মৃতিরা।

মানুষ মান্না দে ছিলেন কঠিন-কোমলে গড়া এমনই এক সুরপুরুষ।

আরও পড়ুন, জন্মশতবর্ষে ফিরে দেখা মান্না দে

সঙ্গীতের আর এক দিকপালের কাছে তিনি ‘ওস্তাদ’ নন, ‘পন্ডিত’-ও নন। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে উঠলেন, “মান্না দে চৈতন্য সঙ্গীতের স্রষ্টা। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতকে নান্দনিকতায়, রোম্যান্টিসিজমে যে ভাবে নিয়ে এলেন তিনি, তা আজও বিস্ময়কর! এক বার মুম্বইয়ের এক পরিচালক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কটুক্তি করেছিলেন। মান্না দে সেটা সহ্য করতে না পেরে তাঁকে বাড়িতে এনে দেড় ঘণ্টার ক্লাস নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, মান্না দে-র বাড়িতে রাখা সমস্ত স্বরবিতান থেকে সুর নিয়ে বুঝিয়ে যখন নিজের গলায় ‘ওগো স্বপ্নস্বরূপিণী’ ধরলেন তখন সেই পরিচালক গানের মূর্ছনায় টলতে টলতে বাড়ি ফিরেছিলেন।’’ একশো বছরের জন্মদিনে অভিজিৎবাবু নিজেও যেন রোমান্সে ভাসলেন। “ওই যে ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ গানে যে স্পর্শ স্বর লাগালেন তা শুনে মান্না দে-কে বলেছিলাম, আমি যাকে ভালবাসি তাকে তো ছুঁতে চাই। তার শাড়ির আঁচল যখন আমার গা ঘেঁষে হাওয়ায় চলে যায় সেই চলে যাওয়ার অনুভূতি মান্না দে-র ওই গানে আজও পাই।’’

ছোটবেলা থেকে মান্না দে-র গানের টানে পুজো প্যান্ডেলে যাওয়া। মান্না দে-র গানের জন্য পাগল তিনি, মনোময় ভট্টাচার্য, আজ যিনি শ্রোতাদের মান্না দে-র গান শুনিয়ে ফেরেন। “আসলে মার্গসঙ্গীতের চর্চা তাঁকে সব গান গাওয়ার ক্ষমতা দিয়েছিল। ধ্রুপদী গানের অমন শিল্পী, অথচ ‘হয়তো তোমারই জন্য’ গাওয়ার সময় কোনও কালোয়াতি করলেন না! কি সংযম! আমার মতো ক্ষুদ্র শিল্পীর জন্যও তাঁর মুখ থেকে অনায়াসে প্রশংসা বেরিয়ে আসতো।’’ অবাক গলায় বললেন সঙ্গীতশিল্পী মনোময়।


২০১২। বেঙ্গালুরুর বাড়িতে শিল্পী।— ফাইল চিত্র।

শুধু মনোময় নয়, মান্না দে-র কাছের মানুষ দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী দেখেছিলেন, এ প্রজন্মের কারও গান ভাল লাগলে, সেই ভাললাগার কথা শিল্পীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সে চেনা হোক বা অচেনা হোক। মান্না দে-র অনুষ্ঠান। দেবাশিস বসু সঞ্চালক। গ্রিনরুমে চা খেতে খেতে হাল্কা কথাবার্তা চলছে। মান্না দে হঠাৎ বললেন, ‘‘সে দিন টেলিভিশনে একটি মেয়ের গান শুনলাম। রবীন্দ্রনাথের গান গাইছিল। খুব ভাল লাগল। কিন্তু ঠিক আইডেন্টিফাই করতে পারলাম না।’’ মান্নাদা ছটফট করছিলেন নামটা না জানায়। দেবাশিস জিজ্ঞেস করল, ‘কোনও হিন্টস দেওয়া যায়? তা হলেই বের করে ফেলব।’ মান্নাদা বললেন, ‘একবারই নামটি দেখিয়েছিল। আমি ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। মনে হয় কোনও বাঙালি মেয়ে সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলেকে বিয়ে করেছে। এখনকার পদবিটা সম্ভবত ‘নায়ার’। দেবাশিস সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘ইয়েস, আই গট। শি ইজ মনীষা মুরলি নায়ার। দক্ষিণ ভারতের মেয়ে। ওর দাদা মনোজ মুরলি নায়ার। দু’জনেই শান্তিনিকেতনের। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। জানা না থাকলে ভাষা শুনে বোঝার উপায় নেই ওরা জন্মসূত্রে সাউথ ইন্ডিয়ান। বাংলা ওদের মাতৃভাষা নয়।’’ শুনে মান্নাদা অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের আবেদন কতখানি ভেবে দেখ। গান দিয়ে সব মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয় বোল, ওঁর গান আমার খুব ভাল লেগেছে।’’

অথচ তাঁর গানের পথ সহজ ছিল না!

আরও পড়ুন, ভারতে ছাড়পত্র পেল ‘ভুবন মাঝি’

“মান্না দে-র মতো পরিশ্রমী শিল্পী আর বোধহয় ভারতবর্ষে জন্মায়নি। আর তাঁকে বুঝতে গেলে আমাদের আরও একশো বছর লাগবে।’’ মান্না দে-কে দেখার জায়গায় এক অন্য দৃষ্টিভঙ্গির কথা বললেন সুরকার-গায়ক জয় সরকার। “মান্না দে-র গলা একেবারেই নায়কসুলভ ছিল না। উনি যখন গাইতে এলেন কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ রফি, মুকেশে আবিষ্ট আমাদের দেশ। যাঁদের গলাই আগে আমাদের হৃদয়ে পৌঁছে যায়। সেখানে মান্না দে শুধুমাত্র নিজের পরিশ্রমে, সাধনায় ভারতবর্ষে নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করলেন! ভাবাই যায় না। কী অসম্ভব ভাল ফিনিশিং! গলার সাহায্য পাননি, অথচ মানুষের হৃদয়ে যে কোনও ধরনের গানে রাজার আসনে আজ তিনি।’’

এই সুরের রাজা হওয়ার পথে সুরের জাদুকর দেবজ্যোতি মিশ্র ফিরে যান মান্না দে-র ‘পড়সন’-এর গানে।

বলেন, “কিশোরকুমার তো ওই দৃশ্যে সকলের চোখে, মেহমুদ ভাল অভিনেতা, তিনিও জয় করলেন দর্শকদের, রাহুলদাও সুরের ছটায় মুগ্ধ করলেন শ্রোতাদের, কিন্তু মান্না দে? তিনি কোন এক অলীক সুরমাধুরীতে সবাইকে ছাপিয়ে যেন জানালেন, শুধু ‘হয়তো তোমারি জন্য’ নয়। আমি এটাও পারলাম। প্রতি বার নানা গানে নানা দক্ষতায় তাঁকে নিজেকে প্রমাণ করে যেতে হয়েছে! আমার মনে হয় তিনি মহাভারতের কর্ণ!”

মান্না দে আসলে এক জন নয়। তিনি সঙ্গীতের নানা রং, সেই রঙে মনকেমন, ‘পুছনা ক্যায়সে ম্যায়নে,’ আবার কখন এই প্রজন্মের হুল্লোড় ‘জীবনে কী পাবো না’ কখনও বা কফি হাউসের ঝড়, কখন ভিতর শূন্য করে দেওয়া হাহাকার, “ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE