Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জীবন থেকে অভিনয়ের পাঠ

বছর চারেক আগে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রস্তাব আসে যে, তাঁকে নাটক শেখাতে হবে সংশোধনাগারের আবাসিকদেরকে। যাতে নাটকের মাধ্যমে তাঁদের আত্মশুদ্ধি করা যায়। শুরু হয় আর এক লড়াই। নাট্য নির্দেশক সুশান্ত হালদার-কে নিয়ে লিখছেন সুস্মিত হালদার।স্কুল থেকে সাইকেল চালিয়ে সংশোধনাগারের পথ ধরেন মানুষটা। মাথার মধ্যে ঢেউ খেলে যাচ্ছে একের পর এক চিন্তা।

সুশান্ত হালদার।

সুশান্ত হালদার।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:২০
Share: Save:

স্কুল থেকে সাইকেল চালিয়ে সংশোধনাগারের পথ ধরেন মানুষটা। মাথার মধ্যে ঢেউ খেলে যাচ্ছে একের পর এক চিন্তা। পাশ দিয়ে হুঁশ করে চলে যাওয়া গাড়িগুলোর দিকেও তাঁর নজর নেই। তাঁকে দেখে হাঁক পাড়েন কোনও পরিচিত জন। শুনতে পান না তিনি। আসলে মানুষটা চলেছেন নিজের খেয়ালে।

সংশোধনাগারে গিয়ে তাঁকে এখনই নাটকের মহড়া দিতে হবে। একেবারেই আনকোরা মানুষগুলোর ভিতর থেকে অভিনয় বের করে আনা যে কতটা কষ্টের, তা তিনি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন গত কয়েক মাসে। কিন্তু হাল ছাড়ার মানুষ নন তিনি। জানেন, নাটককে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারলেই অভিনয় বেড়িয়ে আসবে নিজে থেকে। সেটা হতেও শুরু করেছে একটু একটু করে। কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগারের আবাসিকদের নিয়ে যে নাটক তুলছেন জেলার অন্যতম সফল নির্দেশক সুশান্ত হালদার।

রাত পর্যন্ত চলবে সেই মহড়া। এ দিকে, তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে ‘কৃষ্ণনগর সিঞ্চন’-এর কলাকুশলীরা। রাত গভীর হয়। সুশান্তবাবুর বাড়িতে সেই মহড়া সেরে ক্লান্ত কলাকুশলীরা বাড়ি ফেরে। তার পর কোনও রকমে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বসে যান পরবর্তী নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে। আবার, ভোর হলেই নাটক-পাগল মানুষটা সাইকেলে চেপে পৌঁছে যান কলেজের মাঠে। সেখানে তখন হকিস্টিক হাতে তাঁর অপেক্ষায় ছেলেমেয়েরা।

বেলা বাড়লে মাঠ থেকে ফিরেই আবার স্কুল। সেখানেও আবার দৈনন্দিন ক্লাসের ফাঁকে পড়ুায়াদের নিয়ে নানানরকম সমাজসেবামূলক কাজ। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছুটে চলেছেন মানুষটা। শহরের কেউ তাঁকে চেনেন নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক হিসাবে। কেউ চেনেন হকিপাগল মানুষ, আবার কেউ চেনেন এক জন সমাজকর্মী হিসাবে।

তাই তো যখনই তিনি খবর পান কোনও গ্যাস ডেলিভারির যুবক অর্থাভাবে তাঁর জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে না পেরে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কেঁদে ওঠে তাঁর মন। ‘কৃষ্ণনগর সিঞ্চন’-এর কুশিলবদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন রাস্তায়। শহরের জনবহুল এলাকাগুলিতে মঞ্চস্থ করেন পথনাটিকা ‘তাহারুশ’। হাত পাতেন পথচলতি মানুষের হাতে। আবার, কখনও কেরলের বন্যার পরে একই ভাবে পথনাটিকা করে টাকা তুলে পাঠিয়ে দেন সাহায্যের জন্য।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, এত কাজ এক সঙ্গে করেন কী করে? মাথায় রাখেন কী করে এত বিষয়? প্রশ্নটা শুনে মুচকি হাসেন সুশান্তবাবু। বলেন, “সবটাই করি সাইকেল চালাতে চালাতে।” একটা কাজ সেরে আর একটা কাজের ভিতরে ঢোকার মধ্যেকার রাস্তায় তিনি সাইকেল চালাতে চালাতে ভাবতে থাকেন। ছক কষে নেন পরের কাজটা কী ভাবে করবেন। তাই হাজার চেষ্টার করেও সাইকেল থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেননি কেউ।

সেই ছোট্টবেলায় পাড়ার থিয়েটারে দিয়ে তার হাতেখড়ি। সেখান থেকে স্কুলের নাটকে। আস্তে আস্তে নাটকের প্রেমে পড়া। এরই মধ্যে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে সুযোগ এল নাটকের কর্মশালায় অংশ নেওয়ার। স্পর্শ পেলেন, আধুনিক নাট্যভাবনার। ফিরে এসে স্কুল-কলেজের নাটকের বন্ধুদের জড়ো করে ১৯৮৯ সালে তৈরি করলেন নাটকের দল ‘কৃষ্ণনগর সিঞ্চন’।

প্রথম নাটক ‘চেতনায় হানিছে আঘাত’। কিন্তু না। মন অস্থির হতে থাকল। নাটকের মধ্যে সেই বক্তব্য নেই। নেই সেই ঝাঁজ। তেমন করে যেন জীবনের কথা বলা হয়ে উঠছে না। এবার নিজেই লিখতে শুরু করলেন নাটক ‘সকালের জন্য’। একে একে লিখে ফেললেন ৩০টি নাটক। লিখে ফেললেন আলোড়ন জাগানো নাটক ‘সমুদ্র মন্থন’, ‘দ্য ইনকুইজিশন’, ‘অন্ধকারের যাত্রী’। একের পর এক নাটকে আসতে থাকল রাজ্য ও জাতীয় স্তরের নানা পুরস্কার। যুব নাট্য উৎসবে পর পর চার বার প্রথম হল তাঁর দল। দু’বার দ্বিতীয়। এলাহাবাদে সর্বভারতীয় নাট্য প্রতিযোগিতায় ১৩টি বিভাগের মধ্যে ১১টিতেই প্রথম। এর বাইরেও একাধিক বার জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় এল শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার।

কিন্তু তিনি শুধু নাটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার মানুষ নন। হকিতে তিনি বাংলা দলের হয়ে অংশ নিয়েছেন জাতীয় স্তরে। মঞ্চের মতো মাঠও তাঁকে ডাকে। তাঁকে ডাকে হকির স্টিক। ডাকে সবুজ মাঠ। একসময় স্কুল স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন তাকে দায়িত্ব দিল জেলায় হকির ক্যাম্প করার। আবার, তিনি ফিরে এলেন প্রিয় হকির মাঠে। এক জায়গায় হলেন শহরের এক কালের দাপুটে সব হকি খেলোয়াড়েরা। সকলে মিলে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

তৈরি হল ছেলেদের চারটি ও মেয়েদের তিনটি টিম। ২০১০ সালে তাঁদের সকলের প্রচেষ্টায় প্রথম তৈরি হল ‘নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট হকি অ্যাসোসিয়েশন’। হকির জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে আয়োজন করা হল আইপিএলের মতো করে লিগ। অনেকেই এগিয়ে এলেন সেই টিম কিনে লিগে অংশ নিতে। জমে উঠল লিগ। এরই মধ্যে সুশান্তদের উদ্যোগে তৈরি কয়েক জন খেলোয়াড় ডাক পেল রাজ্য দলে। এখন তিনি নাটকের পাশাপাশি হকির মাঠেও সমান উদ্যমী।

তাঁর এই নাটকের প্রতি ভালবাসার কথা পৌঁছে গিয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে। বছর চারেক আগে তাঁর কাছে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রস্তাব আসে যে, তাঁকে নাটক শেখাতে হবে সংশোধনাগারের আবাসিকদেরকে। যাতে নাটকের মাধ্যমে তাঁদের আত্মসুদ্ধি করা যায়। একমুহূর্ত না ভেবে রাজি হয়ে যান সেই প্রস্তাবে। শুরু হয়ে যায় তাঁর আর এক লড়াই। যদিও সেই লড়াই মোটেই সহজ ছিল না। বরং সেটা ছিল অনেক অনেক বেশি কঠিন। এমনিতেই একেবারে আনকোরা সব কলাকুশলী। সেই সঙ্গে আছে তাঁদের ভিতরকার নানান জটিলতা, নানা হীনম্মন্যতা। সেই সব কাটিয়ে তিনি একটু একটু করে তৈরি করতে থাকলেন ওঁদের।

মাসের পর মাস এ ভাবে চলার পর একসময় তাঁর হাত ধরে কৃষ্ণনগর সংশোধনাগারে তৈরি হল নাটকের দল। শুরু হল বিবেকানন্দের জীবনের উপরে নাটক ‘মহাবৃত্তে’। সংশোধনাগারের ভিতরে মঞ্চস্থ করার পরে ২০১৬ সালে রবীন্দ্রভবনে প্রথম সংশোধনাগারের বাইরে আবাসিকেরা মঞ্চস্থ করলেন সেই নাটক। সে দিন দর্শকদের হাততালি দেখে চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল সুশান্তবাবু। বলেছিলেন, “আমার এই চেষ্টা যদি ওদের মনে এতটুকুও রেখাপাত করতে পারে, সেটাই হবে আমার সব চেয়ে বড় পাওনা।” দর্শকের হাততালিতে কেঁদে ফেলেছিলেন কলাকুলশীরা। গোটা পরিবেশটাই যেন হয়ে উঠেছিল অন্যরকম। মুগ্ধ হয়েছিলেন কারা দফতরের কর্তারা। সে দিনই ঠিক হয়ে যায় এই নাটক মঞ্চস্থ হবে কলকাতায়। সেই বছরই তা বাস্তবায়িত হয়। কলকাতা থেকেও প্রশংসা কুড়িয়ে আসেন সুশান্ত ও তাঁর কুশিলবেরা।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকার মানুষ নন তিনি। শুরু হয়েছে নতুন নাটকের মহড়া। এ বার রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’। সেই মতো চলছে সকলের হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সুশান্তবাবু বলেন, “এটা তো শুধু নিছক নাটক নয়। বলতে পারেন নাটক থেরাপি। নাটকের মহড়ায় ওঁদের আত্মস্থ হতে দেখেছি। দেখেছি, চরিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে গিয়ে কী ভাবে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলছেন কেউ কেউ। ভিতর থেকে একটা উত্তরণ ঘটে চলেছে মানুষগুলোর মধ্যে।”

এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড় পাওনা। এখানেই যেন লুকিয়ে আছে আত্মতৃপ্তি। তিনি বলছেন, “জীবনে নাটক করে, নাটক নির্দেশনা করে অনেক পুরষ্কার পেয়েছি। কিন্তু যখন দেখি, নাটকের মাধ্যমে মানুষগুলো একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে, তখন মনে হয়, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরষ্কার।” জানাচ্ছেন, এই পুরস্কারের লোভে তিনি আরও অনেক অনেক পরিশ্রম করতে পারি।

নাটকের প্রতি তাঁর এই ভালবাসা তাঁকে অনেক সময়ই অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। ২০১০ সালে মারা গেলেন তাঁর বাবা। এ দিকে নাটকের শো আছে। কী করবেন, ঠিক করতে পারছেন না। অনেক ভেবে ঠিক করলেন না, যাই হোক না কেন নাটক বন্ধ রাখা যাবে না। এই কঠিন দিনে পাশে এসে দাঁড়াল পরিবার। স্ত্রী, ভাই, ছেলে জানিয়ে দিল তিনি নাটক করতে যান। তাঁরাই এদিকটা সামলে নেবেন।

শেষ পর্যন্ত কাছা খুলে পড়লেন নাটকের পোশাক।

কোনও কিছুই নাটক থেকে তাঁকে আলাদা রাখতে পারেনি। তাঁর স্ত্রী জয়া হালদার বলছেন, “আমরা বুঝে গিয়েছি যে, ওই মানুষটা ঠিক আর পাঁচটা মানুষের মতো করে সংসারি নন। ওঁকে সংসারে আটকে দিলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।”

তাই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কখনও নাটক তো, কখনও হকির মাঠ। কখনও অচেনা গ্যাস ডেলিভারির যুবকের জন্য তো, কখনও কেরলের বন্যার্ত মানুষের জন্য নেমে পড়েন রাস্তায়। সবাই যখন ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েন, তখন তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, “হতাশ হবেন না। দেখবেন, একদিন এদের অভিনয় দেখে হাততালি দেবে গোটা প্রেক্ষাগৃহ।” আর সেটাই বাস্তবে পরিণত করে দেখালেন।

তবে নাটক তাঁর কাছে শুধুমাত্র বিনোদন নয়। নাটক তাঁর কাছে মানুষের কথা বলার হাতিয়ার। তাঁর নাটকে বারবার উঠে আসে ব্যক্তিমানুষের ঘাত-প্রতিঘাত, জটিলতা আর সেই সব মানুষের কথা যারা দুর্বল, পিছিয়ে পড়া। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, “থিয়েটার মানুষের কথা বলবে। আমার কাছে থিয়েটার শখের নয়। বাস্তব জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে নাটক। জড়িয়ে থাকবে থিয়েটার।”

তিনি বিশ্বাস করেন, শিল্প শুধু শিল্পের জন্য নয়, শিল্প জীবনের জন্য। যে শিল্প মানুষের কথা বলে না সেই শিল্প কোনও শিল্পই না।

তিনি বিশ্বাস করেন, জীবনকে না চিনলে জীবনের জন্য অভিনয় করা যায় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Correctional home Sushant Haldar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE