Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

একদা আইজেনস্টাইন, এখন হরি নামে রক্ষা

তিন সিনেমা হলের জমজমাট প্রতিযোগিতা। ফিল্ম সোসাইটি, চলচ্চিত্র উৎসব, শ্যুটিংয়ের মেদিনীপুর শহরে সিনেমা হল বিষয়টা বিলুপ্তির পথে। লিখলেন বরুণ দেতিন সিনেমা হলের জমজমাট প্রতিযোগিতা। ফিল্ম সোসাইটি, চলচ্চিত্র উৎসব, শ্যুটিংয়ের মেদিনীপুর শহরে সিনেমা হল বিষয়টা বিলুপ্তির পথে। লিখলেন বরুণ দে

ইতিহাস: এখানে আগে ছিল মহুয়া সিনেমা হল। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল 

ইতিহাস: এখানে আগে ছিল মহুয়া সিনেমা হল। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল 

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৮ ০১:৩৪
Share: Save:

তখনকার কথা। ষাট-সত্তরের দশক। মেদিনীপুর শহরে থিকথিকে ভিড় ছিল না। কিন্তু সিনেমা হলগুলোর সামনে টিকিট নিয়ে মারামারি চলত। ব্ল্যাক হত। জেলা শহরের সিনেমা প্রেমীরা টালিগঞ্জ-মুম্বই ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছিলেন। চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হত শহরে। সুইডেন থেকে বাংলাদেশের অন্য ধারার পরিচালকদের সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করত একটি সংস্থা। কিন্তু মেদিনীপুর শহরের সেই সুসময় গিয়েছে। প্রেক্ষাগৃহ নামক বস্তুটি ক্রমশ অবলুপ্তির পথে।

দুঃসময়ের ইতিহাস পর্বে পৌঁছনোর আগে সুসময়ের স্মৃতিচারণাটা করে নেওয়া যেতে পারে। মেদিনীপুর শহরে তখন তিন তিনটে সিনেমা হল। গোটা ছয়েক ভিডিও হল। সপ্তাহ শেষে হলগুলোতে ভিড় হত ভালই। মাঝেমধ্যে হাউসফুল বোর্ড ঝুলত। শহরের বিধাননগর এলাকার পাশে ছিল মহুয়া সিনেমা হল। গোলকুয়াচকের কাছে ছিল অরোরা। মেদিনীপুর শহরে প্রথম গড়ে ওঠে অরোরা হলই। তারপর হরি। শেষে মহুয়া। সত্তর-আশির দশকে সিনেমা দেখতে মানুষ ভিড় করতেন অরোরাতেই। পরে অবশ্য ছবিটা বদলে যায়। ভিড় বেশি হতে থাকে মহুয়ায়। কারণ, এই হলে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। সাউন্ড সিস্টেমও ছিল ভাল। নতুন হিন্দি ছবিগুলো মুক্তি পাওয়ার সপ্তাহ থেকেই এই হলে চলত। আর বাংলা ছবিগুলো বেশি চলত অরোরায়।

শহরতলির বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব নমিতা সামন্তের কথায়, “তখন কলেজে পড়ি। মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখতে যেতাম। দল বেঁধে ‘ধন্যি মেয়ে’ দেখতে গিয়েছিলাম। সেই সময়ের কথা ভাবলে এখন নস্টালজিক হয়ে পড়ি।” শহরের বাসিন্দাদের সিনেমার প্রতি এই আগ্রহ দেখেই একসময়ে গড়ে উঠেছিল মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটি। সে-ও এক ইতিহাসের অংশ। কলকাতার বাইরে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের ঢেউ যে মফফ্সল শহরে প্রথম আছড়ে পড়ে, সেটি মেদিনীপুর। ১৯৬৩ সালে সংস্কৃতিমনস্ক কয়েকজন যুবকের উদ্যোগে গড়ে ওঠে মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটি। নেতৃত্বে ছিলেন মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক অনিমেষ পাল। উদ্দেশ্য ছিল, ভাল সিনেমার প্রচার ও প্রসার করা।

১৯৬৩ সালের ঠিক কবে সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা এখনও অজানা। তবে ওই বছরের অগস্টে একদিন সোসাইটির উদ্যোগে প্রথম সিনেমা দেখানো হয় তত্কালীন জেলাশাসক শিবপ্রসাদ সমাদ্দারের বাংলোয়। প্রদর্শিত হয় আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’। ফিল্ম সোসাইটির কার্যকরী সভাপতি শিবাংশু বসু বলছিলেন সোসাইটির প্রথম পর্বের কথা। বললেন, ‘‘১৯৬৯-৭০ সালের কথা বলছি। তখন আমরা অরোরা সিনেমা হল ৬০ টাকায় ভাড়া করতাম। রবিবার সকালে শো হত। সোসাইটির সদস্য, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ছবি দেখতে আসতেন।” সোসাইটির জন্য প্রথম আলমারি কেনা, প্রথম প্রোজেক্টর কেনা, অফিসঘর তৈরির জন্য জমি দেখা, আরও কত কী। মেদিনীপুর কমার্স কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শিবাংশুবাবুর কথায়, “তখন তো সোসাইটির নিজস্ব কোনও অফিসঘর ছিল না। মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক অনিমেষ পালের বাড়িই অফিসঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। প্রথম আলমারি কেনার কথাটা খুব মনে পড়ছে। ৩০ টাকা দিয়ে আলমারিটা কেনা হয়েছিল। পোস্ট অফিস রোডের সামনের এক দোকান থেকে। তার কয়েক বছর পর ১৬ মিলিমিটারের প্রোজেক্টর কেনা হল। তখন দাম ছিল ১২ হাজার ৫০০ টাকা।”

সোসাইটির উদ্যোগে ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব’এ বিদেশের বহু প্রশংসিত ছবিই দেখানো হয়। সুইডেন, আর্জেন্তিনা, ডেনমার্ক, মায়ানমার, নেপাল, ফিলিপিন্স, ইরান, বাংলাদেশ-সহ বিভিন্ন দেশের পরিচালকদের সিনেমা প্রদর্শিত হয়। তালিকায় ছিল বাংলাদেশের মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’, সুইডেনের ‘অ্যাভালোন’। কাজাকস্তানের ‘ওয়ারিয়র্স অফ দ্য স্টেপি’, ইরানের ‘হাশ! গালর্স ডোন্ট স্ক্রিম’। ‘চার্লি চ্যাপলিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ হয়েছে। কখনও ‘ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ হয়েছে।

আশির দশকের মাঝামাঝি কার্যালয় তৈরির জন্য জমির লিজ পায় সোসাইটি। পরে সেখানে অফিস ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। তৈরি হয় অডিটোরিয়ামও। ৩২০ জন দর্শকের বসার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এক সময়ে যে সংস্থাকে সিনেমা দেখানোর জন্য প্রেক্ষাগৃহ, প্রোজেক্টর ভাড়া করতে হত, এখন সেই সংস্থার একটি ১৬ মিলিমিটার প্রোজেক্টর, দু’টি ৩৫ মিলিমিটার প্রোজেক্টর, একটি সিনেমাস্কোপ লেন্স থেকে এলসিডি, মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টর, ভিসিডি, ডিভিডি, সবই রয়েছে। সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সত্যজ্যোতি অধিকারীর কথায়, “বলা যায়, শুধু ফিল্ম তৈরি ছাড়া, একটা ফিল্ম দেখানোর জন্য যা কিছু প্রয়োজন, আমাদের কাছে তার সবই আছে।” সোসাইটির প্রকাশনা বিভাগের সম্পাদক সিদ্ধার্থ সাঁতরার কথায়, “তখন ফিল্ম সোসাইটির পুঁজি বলতে ছিল কিছু সিনেমা-পাগল লোকের চিন্তাভাবনা, আগ্রহ এবং শ্রম।” একটা সময়ে খুব বেছে বেছে সদস্য নেওয়া হত। ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হওয়াটা একটা বিশেষ মর্যাদার বলে গণ্য হত। সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ তপন পালের কথায়, “এখনও বছরে একাধিক চলচ্চিত্র উত্সব হয়। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহ তৈরির জন্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন হয়।”

সম্প্রতি মেদিনীপুরে চলচ্চিত্র সম্মেলন হয়েছে। সিনেমা নিয়ে কথা বলা, কথা শোনার তেমন সুযোগ থাকে না মফফ্সলে। মেদিনীপুরের তথ্যচিত্র নির্মাতারা এই সম্মেলনকে উৎসাহব্যঞ্জক বলেই মনে করছেন। এঁরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও তৈরি করেন। সিনেমা পাগল এমন শহরে এখন হলগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। মহুয়া এবং অরোরা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দু’টো জায়গাতেই সম্ভবত বাণিজ্যিক ভবন তৈরির প্রস্তুতি চলছে। টিমটিম করে চলছে শুধু হরি। বেঁচে থাকা হরিতে আসন সংখ্যা ৭০০। কিন্তু দর্শক আসে নামমাত্র। মাঝে মাঝে একটু বেশি ভিড় হয়। গত দু’বছরে মাত্র দু’টো ছবিই ভাল চলেছে। একটি মাত্র সিনেমা হল থাকায় সব ছবি রিলিজের পরপরই শহরের হলে আসে না। অনেকে বাধ্য হয়ে খড়্গপুরে যান। শহরের একমাত্র হলটিও অত্যাধুনিক নয়। তা নিয়ে আক্ষেপও রয়েছে শহরবাসীর। তুহিন ঘোষের কথায়, “শহরে এখন মাত্র একটাই সিনেমা হল. মাল্টিপ্লেক্সও নেই। এটা ভাবলেই মন কেমন করে! অনেক ছবি তো শহরের হলে আসেই না।”

সিনেমা হলে ভিড় না হওয়ার গল্প খুব চেনা। মোবাইল, ইন্টারনেট, ইউটিউবের যুগে ঘরে বসে বিনোদনের ব্যবস্থা হয়েছে। পুরনো হলগুলোয় ঝাঁ চকচকে ব্যবস্থা নেই বলে নতুন প্রজন্মের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয় না। ফল? হল ভেঙে বহুতল বা বিক্রি।

একসময়ে ‘বসন্ত বিলাপ’ সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল মেদিনীপুরে। অনুপকুমার আর সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের সেই সিনেমা দেখতে যাওয়ার দৃশ্যে ছিল মহুয়া সিনেমা হল। এখন সিনেমা হলের বসন্ত নেই। শুধু বিলাপ রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cinema Halls Theatre Midnapore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE