Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

'মালদহেই পেয়েছিলাম প্রথম জয়ের স্বাদ'

তাঁর কণ্ঠে এক রাশ সতেজতা। তাঁর সুরের মূর্ছনায় মন ভাল হতে বাধ্য। আর মনকে বেঁধে না রেখে উড়ান মেলার বার্তাও দিয়েছেন তিনি। তা সে ‘ইচ্ছে পাড়ি’ হোক কিংবা ‘বৃষ্টি পায়ে পায়ে’। তিনি গায়িকা শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আড্ডায় উঠে এল উত্তরবঙ্গে তাঁর ফেলে আসা শৈশব, ইচ্ছে আর স্মৃতির কথন। আড্ডার সঙ্গী রূম্পা দাস তাঁর কণ্ঠে এক রাশ সতেজতা। তাঁর সুরের মূর্ছনায় মন ভাল হতে বাধ্য। আর মনকে বেঁধে না রেখে উড়ান মেলার বার্তাও দিয়েছেন তিনি। তা সে ‘ইচ্ছে পাড়ি’ হোক কিংবা ‘বৃষ্টি পায়ে পায়ে’। তিনি গায়িকা শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৮ ০২:২০
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনি থাকতেন কোথায়?

উ: মালদহে নর্থ সিঙ্গাপাড়ায়।

প্র: পড়াশোনা কি মালদহেই?

উ: হ্যাঁ। বারলো গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। তার পর উইমেন্স কলেজে পড়াশোনা করতাম। সেখান থেকে তো কলকাতায় চলে আসি। তার পরের পড়াশোনা অবশ্য কলকাতাতেই।

প্র: আর সেই বাড়িটা... যেখানে ছোটবেলা কাটিয়েছেন...

উ: ওটা আর নেই। তবে মালদহে আমার দিদি এখনও থাকেন। ওখানেই কাজ করেন। ফলে মালদহের সঙ্গে কিন্তু আমার যোগাযোগ রয়েই গিয়েছে।

প্র: গানের সঙ্গে যোগাযোগ তো মালদহে থাকাকালীনই...

উ: একদম। আমার বাবা ছিলেন আমার সঙ্গীত শিক্ষার প্রথম গুরু। আমার গানের শিক্ষা, তালিম নেওয়া, প্রাথমিক ভিত তৈরি... পুরোটাই মালদহে, বাবার হাত ধরে।

প্র: ছোটবেলায় নানা জায়গায় অনুষ্ঠান করতেন?

উ: স্কুলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। কিন্তু বাবার কড়া নিষেধ ছিল অন্য জায়গায় গান গাওয়ার ব্যাপারে। ফলে ছোটবেলায় পাড়ায় বা অন্যত্র সে ভাবে কোনও অনুষ্ঠান করা হয়নি।

প্র: ছোটবেলাটা কেমন কেটেছে?

উ: বড্ড চাপ ছিল পড়াশোনার। আসলে আমাদের পরিবারে কঠোর অনুশাসন ছিল। তাই ছোটবেলা যে ভীষণ মজায় কেটেছে, তা হয়তো বলতে পারব না। পড়াশোনা আর গানবাজনা নিয়েই কেটে যেত সারা দিন। আর ক্লাসের পরীক্ষায় র‌্যাঙ্ক করতাম বলে বাড়তি চাপ তো ছিলই।

প্র: মালদহ বললেই কিন্তু আমের কথা মনে পড়ে যায়...

উ: আমাদের কো-অপারেটিভ ছিল বলে সে ভাবে ছোটবেলায় আম কুড়োনো হয়ে ওঠেনি। অনেক বন্ধুরা গ্রামের বাড়িতে যেত আম কুড়োতে। তবে আমি কাঁচা-মিঠে আম খেতে ভীষণ ভালবাসতাম। এখনও মনে আছে, স্কুলের দরজার কব্জায় কাঁচা-মিঠে আমগুলো চেপে ধরে দরজা বন্ধ করে দিতাম। ফলে সহজেই ভেঙে যেত আমগুলো। তার পর আর কী? নুন মাখিয়ে খাওয়া... (হেসে)

প্র: আর বেড়াতে যাওয়া?

উ: সত্যি বলতে কী, তেমন ভাবে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ মোটেও হয়নি। প্রত্যেকবার পুজোর সময় শুধু দাদুর বাড়ি যেতাম কালিয়াগঞ্জে। এ ছা়ড়া চড়ুইভাতি করতে হয়তো যেতাম। কিন্তু তেমন মজা আর হতো কই! খুলেই বলি। আমি যে স্কুলে পড়তাম, আমার মা ছিলেন সেই স্কুলের শিক্ষিকা। ফলে শিক্ষিকাদের সঙ্গে চড়ুইভাতি করতে যাওয়ার কি আর তেমন মজা থাকে? তাও আবার সেখানে যদি মা উপস্থিত থাকেন দিদিমণি হিসেবে! এমনকী সিনেমাও দেখতে যাওয়ারও তেমন সুযোগ ছিল না। মা কোথাও নিয়ে যাওয়ার আগে স্কুলের বাকি শিক্ষিকাদের জি়জ্ঞেস করতেন ছবিটা ভাল কি না। তবেই সেই সিনেমা দেখার সুযোগ পেতাম।

শুভমিতা এক নজরে

• শুভমিতার বাবা যশোদাদুলাল দাস ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী। তাঁর কাছেই শুভমিতার সঙ্গীতশিক্ষার হাতেখড়ি। এর পর তিনি গান শিখেছেন পণ্ডিত উলহাস কশলকর, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য এবং বিদুষী পূর্ণিমা চৌধুরীর কাছে।

• কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক, স্নাতকোত্তর পাশ করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

• সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমি, কলকাতা থেকে স্পেশ্যাল স্কলারশিপ পেয়েছেন। এর পর কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জাতীয় স্কলারশিপ পান ১৯৯২ সালে।

• ১৯৯৩ সালে এইচ এম ভি গোন্ডেন ট্যালেন্ট কনটেস্টে প্রথম হয়েছিলেন।

• এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বাংলা গানের অনুষ্ঠান ‘সা থেকে সা’ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। শুভমিতা মনে করেন, এই ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

• প্রায় এক ডজন অ্যালবাম, ২০০টিরও বেশি টেলি সিরিয়াল, টেলিফিল্ম ও বাংলা ছবিতে গান করেছেন।

• টেলি সিরিয়ালের জন্য সেরা গায়িকার পুরস্কার পেয়েছেন তিন বার ২০০৬, ’০৭ ও ’০৮ সালে।

• ২০০৯ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে পণ্ডিত রবিশঙ্করের ‘ইন্ডিয়া কলিং’-এর বিশেষ অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেন।

• দেবজ্যোতি মিশ্রের সুরে, ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখায় ‘বহু মনোরথ’ শুভমিতার অন্যতম জনপ্রিয় গান। গানটি ছিল সঞ্জয় নাগের পরিচালনায় ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ ছবিতে।

প্র: মালদহের অভাব বোধ করেন?

উ: ওখানে আসলে রান্নার জন্য যা-ই আসত, সবটাই বাগান থেকে। ফলে ওখানকার আনাজপাতি, মাছের স্বাদই আলাদা। এটা আমি এখন খুব ভাল বুঝতে পারি। শুধু মালদহ কেন, গোটা উত্তরবঙ্গের আনাজ, মাছের স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এখন তো সেটাই আমার মনে হয়। আর আমি পাহাড় ভালবাসি। তাই বেড়ানোর পাশাপাশি ওই সব জায়গায় অনুষ্ঠান করতে যেতেও ভাল লাগে। উত্তরবঙ্গের মানুষ সংস্কৃতিমনস্ক, গানপাগল। আমরা অনুষ্ঠান করতে গেলেও বড্ড আদর-যত্ন করে রাখেন। প্রাণের টান অনুভব করি। আর ট্রেন থেকে নামলেই যে গন্ধটা নাকে ভেসে আসে, সেটা যে কী সুন্দর...কথায় বোঝানো যাবে না। অত সবুজ, প্রকৃতির এত কাছাকাছি জায়গা আর কোথায়!

প্র: এখন মালদহে যান নিয়মিত?

উ: মা আমার আর দিদির বাড়ি মিলিয়েই থাকেন। ফলে দিদির কাছে থাকলে, মা মালদহেই থাকেন। তখন মাঝেমধ্যে যাই। আর অনুষ্ঠান থাকলে তো উত্তরবঙ্গে যাওয়াই হয়। তখন ফাঁকা থাকলে কয়েকটা দিন থেকে আসি।

প্র: উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ মানুষ। আপনার কী মত?

উ: সকলের সমস্ত দাবি মেনে চলাটা তো কঠিন বিষয়। তবে এটাও বলব যে, প্রশাসন চেষ্টা করছে সব দিক সামলানোর। এখন পরিস্থিতিও অনেকটা সামলে এসেছে। আশা করছি, সেই সুব্যবস্থাটা বজায় থাকবে।

প্র: মালদহের কী নিয়ে চিন্তা হয়?

উ: চিকিৎসা ব্যবস্থা। তবে আমি বলব, এটা শুধু মালদহ নয়, অনেক মফস্বলের ক্ষেত্রেই এই সমস্যাটা রয়েছে। মালদহে অনেক ভাল চিকিৎসক আছেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটা মেট্রোপলিটন সিটিতে যে সুব্যবস্থা পাওয়া যায়, সেটা মফস্বলে কোথায়? তাই ওটা নিয়ে চিন্তা হয়। সেই জোরটা আর পাই না। তবে এটা শুধু মালদহের সমস্যা নয়। সমস্যাটা কাঠামোগত।

প্র: এমন কোনও সুখস্মৃতি যা শুধু মালদহকে ঘিরেই আছে...

উ: আমি তখন সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতায় এসেছি। মালদহে সেসময় একটা সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সারা বাংলা থেকে প্রতিযোগীরা এসেছিলেন। কলকাতা থেকে অনেক গুণী মানুষ, উস্তাদ গিয়েছিলেন বিচার করতে। ওটাই ছিল আমার প্রথম গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। ফল বেরনোর পর দেখলাম আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এর পর এইচএমভি থেকে ক্ল্যাসিকালের ভোকাল রেকর্ড বেরোল। ফলে মালদহের মাটিতেই পেয়েছিলাম প্রথম জয়ের স্বাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE