ধরা যাক, আপনাকে বলা হল ১ থেকে ৫ গোনার মধ্যে নিজের একটা নাম বানিয়ে বলুন। ভেবেচিন্তে দেখবেন, যে নামটা আপনি বলেছেন, তার সঙ্গে আপনার কোনও একটা যোগ আছে। হতে পারে ওটা আপনার একটা প্রিয় শব্দ, প্রিয় চরিত্র, কোনও অতীত অনুষঙ্গ বা বর্তমানের কোনও রেফারেন্স...যা কিছু! কিন্তু এমন কোনও শব্দ নয়, যার সঙ্গে আপনার ভাবনার কোনও রকম তরঙ্গ যুক্ত নেই।
কেন বলছি কথাটা? কারণ বানানো কথাও পুরো বানানো হয় না আসলে। মিথ্যে কথার মধ্যেও থেকে যায় সত্যির দানা। এবং কখনও কখনও মিথ্যেরা সত্যির চেয়েও বেশি সত্যি হয়ে যায়। ।
পাঠক ভাবছেন, এ আবার কী ‘তামাশা’? সিনেমার রিভিউ লিখতে বসে সত্যি-মিথ্যের সন্দর্ভ কোথা থেকে আসছে! সমালোচক নিমিত্তমাত্র। যা বলার ইমতিয়াজ আলি বলছেন। আমি ইস্কুল-বেলার প্রশ্নপত্রের মতো কবির কথাটি নিজের ভাষায় লিখলুম কেবল।
কর্সিকায় বেড়াতে গিয়ে রণবীর আর দীপিকার যখন আলাপ হল, ওরা ঠিক করল, কেউ নিজেদের সম্পর্কে সত্যি কথা বলবে না। কর্সিকার গল্প কর্সিকায় তৈরি হবে, কর্সিকাতেই থেকে যাবে। এবং গোটাটা স্রেফ গল্পই হবে। পরের ক’দিন প্রজাপতির পাখায় ভর করে কেটে গেল। প্রেমের যাবতীয় লক্ষণ গুটিবসন্তের মতো ফুটে উঠল।
‘তামাশা’-র ট্যাগলাইনে বলা ছিল, একই গল্প আবার কেন? ছোট্টবেলায় রণবীর এক বুড়োর কাছে গল্প শুনতে যেত। বুড়োর গল্পে কখনও রামায়ণের সঙ্গে ইলিয়াড, কখনও লয়লা-মজনুর সঙ্গে রোমিও-জুলিয়েট মিলেমিশে যেত। রণবীর জিজ্ঞেস করত, অন্য গল্পে চলে গেলে যে? বুড়ো বলত, গল্প বলে চলাটাই আসল কথা। মিশে তো যাবেই, সব গল্পই যে এক। অনেক অনেক বছর পরে যুবক রণবীর, দিশাহারা রণবীর আরও এক বার তার কাছে ফিরে যায়। বলে, ‘‘এ বার আমার গল্পটা বলো।’’ বুড়ো যেই কিছু দূর এগোয়, রণবীর বাধা দিয়ে বলে, আরে ওটা তো মজনু্! এটা তো হীর-রঞ্ঝা! বুড়ো খেঁকিয়ে ওঠে এ বার। নিজের গল্প নিজে বলার ক্ষমতা নেই তোমার? আমার কাছে শুধোতে এসেছ? ‘তামাশা’ ছবিটা তাই গল্প বলারও গল্প।
দুঃখের কথা একটাই, গল্পস্বল্প শেষ অবধি তেমন জমল না। কাহিনি আর কথকতার মধ্যে ভারসাম্য রইল না যে। প্রেমের কাঠিতে রাজপুত্রের ঘুম ভাঙল— এই সহজ গল্পটা খুব সহজ করেও বলা যায়। আবার জটিল করেও বলা যায়। ইমতিয়াজ দু’টো একসঙ্গে করতে গেলেন। ফলে ছবিটা না হল যথেষ্ট সহজ, না হল যথেষ্ট জটিল। পুরাণের গল্প, সিনেমার মিথ, বিহেভিয়েরাল ডিজঅর্ডার, পরিবারের চাপে ভুল কেরিয়ারের অভিশাপ— এই সব কিছু একসঙ্গে রাখতে গিয়ে গুরুপাক হয়ে গেল। ‘জব উই মেট’ বা ‘হাইওয়ে’-তে যে ম্যাজিকটা খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তৈরি হয়েছিল, পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়েও ‘তামাশা’য় সেই স্বাদটা এল না। এ আর রহমানের গান শুনতে খুবই ভাল। কিন্তু এত গান ছবিতে দরকার ছিল না। বহু দৃশ্য দেখে ইমতিয়াজের ঘাড়ে বনশালী ভর করেছেন বলে মনে হল। যে ইমতিয়াজ পারতপক্ষে লোকেশনকে পিকচার পোস্টকার্ড হয়ে উঠতে দিতেন না, কর্সিকার বেলায় ঠিক সেটাই করে বসলেন।
কিন্তু ইমতিয়াজ নিশ্চয় জানেন, দর্শক কর্সিকা দেখার জন্য তামাশা দেখতে যাবেন না! দর্শক যাবেন রণবীর আর দীপিকাকে একসঙ্গে দেখতে। তাঁরা জানতে চাইবেন, ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’তে যে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী বর্ষণ চাক্ষুষ করা গিয়েছিল, সেই ‘এনকোর’ ‘তামাশা’-য় আছে কি না। নাহ, ‘ইয়ে জওয়ানি’-র হাবুডুবু আবেগ এ ছবিতে নেই। দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়ালেই যেখানে তীব্র ঝিলিক তৈরি হয়, সেখানে এত উপচারের দরকার কি? অথচ ‘বেশরম’, ‘রয়’, ‘বম্বে ভেলভেট’— ফ্লপের হ্যাটট্রিকের পরে রণবীরের জন্য ‘তামাশা’ হিট করা খুব দরকার। উল্টো দিকে দীপিকা পরপর হিটের মধ্যেই রয়েছেন। তবু রণবীরের সঙ্গে
জুটি বাঁধাটা তাঁর জন্যও নিশ্চয় স্পেশ্যাল। ওঁদের হাঁটাচলা-হাতপা নাড়ার মধ্যেও পারস্পরিক ছন্দ এত চমৎকার যে, বাস্তবে যা-ই হোক, পর্দায় দু’জনে মেড ফর ইচ আদার! নেপোলিয়নের রাজ্যে অ্যাসটেরিক্স-ভক্ত দীপিকা আর দেব আনন্দ-রূপী রণবীরের খুনসুটি দেখলে কথাটা মানতেই হবে। আর আলাদা করে বললে, রণবীরকে শো-কেস করার জন্য তিনি যে অন্যতম সেরা পরিচালক, সেটা ‘রকস্টার’-এর পরে ইমতিয়াজ আবার প্রমাণ করলেন। দীপিকা নিজেকে রোজই ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। ‘লভ আজ কাল’ থেকে ‘তামাশা’র দূরত্ব যেন ছ’বছর নয়, ছ’হাজার মাইলের। কিন্তু ভাল দুধ আর ভাল চাল মেশালেই তো আর ভাল পায়েস হয় না!