কালি-কলম-জলরঙে মিনিয়েচার ড্রয়িং-স্কেচিং ছড়িয়ে রয়েছে গোটা প্রদর্শনী জুড়ে।
সিঁড়ি বেয়ে চার তলায় উঠে ফ্ল্যাটের ভারী দরজাটা খুলতেই যেন অন্য এক জগৎ খুলে গেল!
ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া হলদেটে নরম আলোয় দেখা গেল পুরনো সময়ের গন্ধমাখা সাজঘরের আয়নাটা। তার পাশে প্রসাধনীর বদলে রাখা একগুচ্ছ তুলি। যা দিয়ে অন্য এক জগৎ ফুটে উঠেছে যোধপুর পার্কের অভিজাত পাড়ার একটি খোলামেলা ফ্ল্যাটে। দেবীর জগৎ। সেখানেই ১২ জুলাই থেকে চলছে তাঁর আঁকা ছবি, স্থিরচিত্র আর ভিডিয়োর একক প্রদর্শনী— ‘ইন দি ইন্টেরিম ২:১’।
ফ্ল্যাট জুড়ে সারি সারি বাঁধানো ফ্রেমে কালি-কলম-জলরঙে মিনিয়েচার ড্রয়িং-স্কেচিং। খোলা মাঠে ইতিউতি চরে ঘাস খাচ্ছে ভেড়ারা। এ ধার-ও ধার ঘাড় ঘুরিয়ে কাকের দল। ট্রেনের কামরায় সিলিং ফ্যানের সারি। কোথাও আবার জিরিয়ে নিচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের ক্লান্ত পা। রয়েছে একটি বিশাল ক্যানভাসে করা অ্যাক্রিলিক পেন্টিং। টার্কি যুগলের মিলন-তৃপ্তির ছাপ পড়েছে তাতে। আর একটা ইজেলের গায়ে রাখা ক্যানভাসে মোরগদের ঝগড়া। কয়েকটা দেশলাই বাক্সর নমুনা। এ ছাড়া, ক্যামেরাবন্দি রোজনামচার নানা ছবি-ভিডিয়ো-ও। একটা ঘরের দেওয়ালে ছায়া ফেলছে প্রায় সাড়ে তিন মিনিটের ভিডিয়ো। আগুনের গা ছেড়ে ধোঁয়া উড়ছে। এক বাসা ছেড়ে অন্য বাসার দিকে ডানা মেলছে পাখি। টিপ টিপ বৃষ্টি। তার পর একফোঁটা জল আটকে পাতার কোণে।
আরও পড়ুন
মুভি রিভিউ: পরতে পরতে ‘মাটি’র সোঁদা গন্ধ
মিনিয়েচার ড্রয়িং-পেন্টিংয়ের পাশাপাশি প্রদর্শ হিসেবে রয়েছে স্থিরচিত্রও।
মূলত সাদা-কালোয় হলেও খানিকটা লাল রঙেও খেলা করেছেন দেবী। ঘরের এক ফাঁকে রয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা-ক্যামেরা, ক্যাকটাসে ভরা টব। সবই এ প্রদর্শনীর অঙ্গ। এ ভাবেই কলকাতায় ওপেন স্টুডিয়ো কনসেপ্ট-এ তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী শুরু করলেন দেবী।
ওপেন স্টুডিয়ো কী? কথায় কথায় দেবী জানালেন, বিদেশে বহু দিন ধরেই এ ধরনের কনসেপ্ট চালু রয়েছে। সেই কনসেপ্ট-এ কলকাতায় এটাই তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী! তাঁর কথায়, “এটা আসলে কোনও একটা স্থায়ী গ্যালারিতে শিল্পকলার প্রদর্শনী নয়। বরং কোনও বসতবাড়িতে বা গ্যারাজের ফাঁকা জায়গায় একটা গোটা গ্যালারির আবহ তৈরি করা।” সেটা কী রকম? “আসলে এমন একটা স্পেস তৈরি করা যেখানে শিল্পীর কাজ তো থাকবেই। একই সঙ্গে মনে হবে সেটা তাঁর স্টুডিয়ো। তাঁর কাজের জায়গা। যেন একটা গ্যালারি। তবে তা অস্থায়ী ভাবে তৈরি করা। যেখানে শিল্পীর সঙ্গে দর্শকদের মতের আদান-প্রদানও হবে।”
নানা ধরনের গুল্মও ঠাঁই পেয়েছে এখানে।
কোনও একটা থিমের উপরে ভিত্তি করেই এই ধরনের স্টু়ডিয়ো গড়ে ওঠে। দেবীর এই প্রদর্শনীর থিম যেমন অবিরাম বয়ে চলা জীবনের ঘনঘটার ফাঁকে এক টুকরো সময়। খানিকটা এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনায় পা রাখার মাঝের সময়টা ছোঁয়া। যাকে পুরোপুরি তালুবন্দি করা যায় না।
প্রদর্শনীর নামটা ‘ইন দি ইন্টেরিম ২:১’ কেন? বিশ্বভারতীর কলাভবনের প্রাক্তনী বলেন, “ছোটবেলা থেকে আমি কখনও কোনও একটা বাড়িতে স্থায়ী ভাবে থাকিনি। চাকরির জন্য বাবার নানা জায়গায় বদলি হতে হত। ফলে একটা বাসা থেকে অন্য বাসা বদল করতে হয়েছে। মানে কখনওই কোনও এক জায়গায় থেমে থাকা নয়। সব সময়েই চলতে থাকা। আমার মনে হয়, বাসস্থানই হোক বা মানুষজন অথবা আর্ট— কোনও কিছুই স্থায়ী নয়। সবই ক্ষণস্থায়ী। নামটা ‘ইন দি ইন্টেরিম’, কারণ, আমরা সব সময়েই কোনও না কোনও কিছুর মাঝে রয়েছি। তা সে বাসস্থানই হোক বা সময়। কখনওই কোনও একটা বিশেষ জায়গায় আটকে নেই। সময়ের মতোই বয়ে চলেছি।”
জুন মাসে দেবীর শিল্পকলা প্রদর্শনীর প্রথম ভাগটা দেখা গিয়েছিল প্রতাপাদিত্য রোডের একটি ফ্ল্যাটে।
আর ২:১ কেন? দেবী জানালেন, গত জুনে এই প্রদর্শনীর প্রথম ভাগটা দেখা গিয়েছিল প্রতাপাদিত্য রোডের একটি ফ্ল্যাটে। সেখানে শুরুটা হলেও নানা কারণে তা মাঝপথেই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। প্রথমটায় ভেঙে পড়লেও দমে যাননি তিনি। ফের নয়া উদ্যমে প্রদর্শনীর জন্য জায়গা খোঁজা শুরু হয়। খোঁজ মেলে এই ফ্ল্যাটের। সেখানেই শুরু এর দ্বিতীয় পর্ব— ২:১!
আরও পড়ুন
বান্ধবীরা বলে আমার দ্বারা প্রেম হবে না, বলছেন আবীর
প্রদর্শনী দেখতে এসে আঁকতে বসে গেলেন এক দর্শক।
গ্যালারির একটা আস্ত চেহারাই দেখা গেল এই ওপেন স্টুডিয়োতে। তবে চিরাচরিত অর্থে দেখা গ্যালারি নয়। ঘুরে-ফিরে শিল্পীর কাজ দেখার ফাঁকে তেষ্টা পেলে দর্শকদের জন্য রয়েছে ঠান্ডা পানীয় বা চা-কফিতে গলা ভেজানোর বন্দোবস্ত। এক চিলতে বারান্দায় বসে একটু দম নেওয়ারও ফুরসত খুঁজে পাবেন ধূমপায়ীরা। বা শোনা যাবে গানও। চাইলে এই স্টু়ডিয়োতে বসেই তুলির টানে নিজের মনের রং দেখাতে পারবেন দর্শকেরা। সঙ্গে থাকবে বুক-রিডিং সেশন আর গান-বাজনার আসরও।
এ ভাবেই শিল্পীর পাশাপাশি দর্শকেরাও যেন নিজেদের খুঁজে নিতে পারেন এখানে!
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy