২৩তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাজে নন্দন। — নিজস্ব চিত্র।
কখনও কখনও নিজেকে...না, আগ্নেয়পাহার নয়...নাবিক মনে হয়। পৃথিবীর ক্যানভাসে রং, শব্দ আর দৃশ্য নিয়ে ফেরা এক নাবিক। মাঝেমধ্যে নোঙর ফেলি দেশে-বিদেশে, সিনেমার পসরা সাজিয়ে বসা কোনও এক মেলায়...নিজের ডালা সাজিয়ে বসি, নিজের সৃষ্টি দেখাই...অন্যের ডালায় কী পসরা তা-ও দেখি। তারপর একদিন আবার বেরিয়ে পড়ি। আর এক মেলার উদ্দেশ্যে।
আরও পড়ুন, সাহস জোগায় ‘একজন কবির মৃত্যু’
এই মেলারই আধুনিক নাম চলচ্চিত্র উত্সব, ইংরেজিতে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।
গত তিন বছরে ‘তিনকাহন’ আর ‘দ্য ভায়োলিন প্লেয়ার’-এর সুবাদে পৃথিবীর প্রায় আশিরও বেশি ছোট-বড় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিত্রোভিসা থেকে তুরিন, জুরিখ থেকে প্রত্যন্ত নীলাম্বুর, প্যারিস থেকে ঝাঁ চকচকে নিউ ইয়র্ক, দুবাই থেকে একদা সন্ত্রস্ত জাফনা, জোহানেসবার্গ থেকে প্রিয় মাদ্রিদ, শীতকাতুরে ধরমশালা থেকে ডারবান— কোথায় না গেছি ফিল্ম নিয়ে। খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নামক মহাযজ্ঞটি সম্পন্ন হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। কীভাবে সমমনস্ক কিছু মানুষ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে গড়ে তুলেছেন এক নিরপেক্ষ মঞ্চ হিসেবে। কীভাবে এই মঞ্চ হয়ে উঠেছে অকুতোভয়। কীভাবে ভীষণ যত্ন করে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে নতুন প্রজন্মের নতুন পরিচালকদের। পাল্টে যাচ্ছে সিনেমা নিয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণা। খুলে যাচ্ছে জানালা-দরজা। এর পাশাপাশি এ-ও দেখেছি, কী ভাবে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে উঠেছে সরকারি মুখপত্র। নিরপেক্ষতা ভুলে কণ্ঠরোধ করেছে বিপরীতধর্মী ছবির। বিভিন্ন লবির কাছে নতজানু হয়ে নিজের অস্তিত্বকে সঙ্কটাপন্ন করেছে।
আরও পড়ুন, ফেস্টিভ্যালের শুরুতেই ছন্দপতন, মাশুল গুনল বাংলা ছবি
এই হাজার ভাল-মন্দের মাঝেই গত বছর দ্য ভায়োলিন প্লেয়ার নিয়ে আমার তরী ভিড়েছিল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে। এটা এক অদ্ভুত হোমকামিং আমার। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার হাতেখড়ি কিন্তু এই কলকাতা চলচ্চিত্র উত্সবের হাত ধরেই। ১৯৯৭ সালে কেআইএফএফ-এর (তখন অবশ্য সিএফএফ) লোগো ফিল্মে এ কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার আর তারই ফলশ্রুতি সেই বছর গলায় ব্যাজ ঝুলিয়ে আমার ডেলিগেট হয়ে ওঠা। জীবনে প্রথম বার। তখন কিন্তু ভাবিনি কখনও যে একদিন এই মেলাপ্রাঙ্গনেই ফিরে আসব নিজের ফিল্ম নিয়ে।
২২তম কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নন্দন চত্বর। — ফাইল চিত্র।
আর ফিরে এসে যা দেখলাম তাতে ভাল লাগা বাড়ল বই কমল না।
আমি চিরকাল মনে করেছি যে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের একটা পার্মানেন্ট ভেন্যু হওয়া উচিত। যেমন হয় কানস বা বুসানে। শপিং মলের মাল্টিপ্লেক্সে আর যা-ই হোক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কিন্তু বেমানান। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল একটা মিলন মঞ্চ যেখানে উঠতে বসতে শুতে সিনেমা ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা হওয়া উচিত নয়, হতে পারে না। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন একটা পার্মানেন্ট ভেন্যু এই উত্সবের প্রাণকেন্দ্র হয়। অধুনা আমার শহর মুম্বইয়ের বিখ্যাত মুম্বই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বিরুদ্ধে এই এক বড় অভিযোগ আমার। আর এখানেই ধরমশালার মতো কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব বেশ খানিকটা এগিয়ে। এই যে নন্দন-শিশির মঞ্চ-রবীন্দ্র সদন ঘিরে উত্সবের প্রাণকেন্দ্র, এতে সিনেমা সংক্রান্ত কথোপকথন সহজেই হয়। কোন ছবি দেখব তা নিয়ে টানাপড়েন, একটা ফিল্ম শেষে হতে অন্য ফিল্মের লাইনে দাঁড়ানো, দুপুরের খাবার বাদ দিয়ে সদ্য দেখা সিনেমা নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক, দর্শক-নির্মাতার মুখোমুখি হওয়া, ভাবনার আদানপ্রদান— এটাই তো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আসল আনন্দ।
আর একটি দিক যেখানে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব বাকি সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে, তা হল ঘোষিত পুরস্কার অর্থে। স্বাধীন ফিল্মমেকার যাঁরা বাজারমুখী ছবি বানান না, আর যার ফলে হলে-বাজারে যাঁরা ব্রাত্য তাঁদের কাছে যে কোনও মূল্যের পুরস্কারই শিরোধার্য। কিন্তু সেটা যদি হয় ৫১ লক্ষ টাকার প্রথম পুরস্কার তাহলে তো আর কথাই নেই। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার পর, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে ঠাঁই পেয়েছে নতুন কিছু বিভাগ যা বিষয় বৈচিত্রের কারণে চমকে দেয়। মহিলা চলচ্চিত্রকারদের প্রতিযোগিতা, ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজের মতো একটি বিভাগ যেখানে সিনেমার ভাষা নিয়ে নতুন কিছু করার প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করা হয়, ভারতীয় সিনেমার প্রতিযোগিতা, NETPAC- কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের এই স্বীকৃতি প্রদান কিন্তু ফিল্মমেকারদের যথেষ্ট উত্সাহ প্রদান করে।
আরও পড়ুন, মেয়েদের অস্থিরতা ও নির্যাতনের ভিন্নরূপ নিয়েই মার্তার ছবি
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের আর একটি দুর্দান্ত দিক হল সদ্য শুরু হওয়া ‘পাড়ায় পাড়ায় সিনেমা’। এই প্রচেষ্টা বিদেশেও দেখেছি। সিনেমাকে এক শ্রেণির কুক্ষিগত করে না রেখে সর্বসাধারণের জন্য নিয়ে আসার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কসবা, টালা পার্ক, বেহালা, যাদবপুরে ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব— এই ভাবনার মধ্যেই একটা রোমাঞ্চ আছে।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ২৩তম কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন। ছবি: সুমন বল্লভ।
সব ভালর মধ্যে কিন্তু কিছু না-মনপসন্দ জিনিসও আছে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে। বলিউড তারকাদের উপর এই অতিনির্ভরতা ও তাঁদের নিয়ে এই আদিখ্যেতা আমায় যারপরনাই বিরক্ত করে। বলিউড প্রচার আর প্রসারের আলোয় বিরাজমান। কিন্তু স্বাধীন ফিল্মমেকাররা যাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছবি বানান তাঁরা কিন্তু কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের মঞ্চে আমন্ত্রিত হলে উপকৃত ও অনুপ্রাণিত বোধ করবেন। সেটা বড় একটা হয়ে ওঠে না। সত্ ভাই কিন্তু সত্ ভাই-ই থেকে যায়।
শুধু পুরস্কার অর্থের টানে কিন্তু সব ফিল্মমেকার ছুটে আসবেন না। তাঁদের আকৃষ্ট করতে গেলে প্রাইজমানির সঙ্গে সঙ্গে ফেস্টিভ্যালের সম্মান বাড়াতে হবে যাতে ফিল্মমেকারদের উইশলিস্টে কান, বার্লিন, ভেনিস, সানডান্স, টরন্টোর সঙ্গে কলকাতার নামও উচ্চারিত হয়। এটা তখনই সম্ভব যখন কোয়ান্টিটির বদলে কোয়ালিটিতে বিশ্বাস করবে ফেস্টিভ্যাল। আমাদের কিউরেটরদের যেতে হবে সারা বিশ্বের বহু ফেস্টিভ্যালে। দেখতে হবে ছবি, সেখান থেকে বাছতে হবে, নিমন্ত্রণ জানাতে হবে। অধিকাংশ ছবিই ফেস্টিভ্যালে দেখানোর জন্য একটা স্ক্রিনিং ফি চায়, সেটাও দিতে হবে।
আরও পড়ুন, ফিল্ম ফেস্টে যাচ্ছেন তো? আগে দেখে নিন এই ভিডিও ম্যানুয়াল
আতিথেয়তায় ত্রুটি রাখলে চলবে না। ম্যানেজমেন্ট টিমকে আর একটু প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দরকার হলে লোকবল বাড়াতে হবে। গত বছর ফেস্টিভ্যাল টিমের সঙ্গে যোগাযোগে আমাদের নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল। আমরা অবশ্য অত গায়ে মাখিনি। আফটার অল, নিজের শহর তো। কিন্তু বিদেশি ফিল্মমেকার বা প্রযোজকরা বা সেলস এজেন্টদের সঙ্গে এক জিনিস ঘটলে তাঁদের রুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কিন্তু প্রবল।
ফরেন ডেলিগেটদের আকৃষ্ট করতে হবে, আনতে হবে সারা পৃথিবীর ফিল্মমেকারদের। আমন্ত্রণ জানাতে হবে ওয়ার্ল্ড সিনেমার ক্রিটিকদেরও। যাঁরা ফিরে গিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখবেন কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব নিয়ে। আর সর্বোপরি তৈরি করতে হবে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবকে কেন্দ্র করে এক বাজার। যে বাজারে ফিল্ম কেনাবেচা হবে। মার্কেট আর কো-প্রোডাকশন ফোরাম হবে, বাংলা ছবির জন্য ফাইনান্সারদের আলাদা সুযোগ সুবিধে দেওয়া হবে। মার্কেট আর কো-প্রোডাকশন ফোরাম ছাড়া কোনও ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল জাতে উঠতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে হিসেবে চাইলেইকলকাতা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম মার্কেট হয়ে উঠতে পারে।
নন্দন-১-এ ছবি দেখার ভিড়। এ বারের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দ্বিতীয় দিন। — নিজস্ব চিত্র।
বাঙালি পরিচালক হিসেবে আর একটি জিনিস আমায় খুব কষ্ট দেয়। চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখেছি তামিল ছবির প্রতিযোগিতা হয়। পুণেতেও হয় মরাঠি ছবির, বেঙ্গালুরুতেও কন্নড়, কেরলে মালয়ালাম ছবির। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার এই যে খোদ কলকাতার বুকে অনুষ্ঠিত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে বাংলা ছবির জন্যে কোনও পুরস্কার থাকে না। দুর্ভাগ্যের, এর অন্যথা হলে হয়তো বাঙালি পরিচালক ও প্রযোজকদের একটু উত্সাহ দেওয়া যেত আর কে বলতে পারে, এতে হয়তো বাংলা ছবির গুণগত মানও বাড়ত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস এসবই হওয়া সম্ভব আর হয়তো একদিন সবই হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। ততদিন ফুলে ফলে বেড়ে উঠুক আমাদের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব। বাঙালির বারো মাসের চোদ্দোতম পার্বণ হিসেবে আর ডাক দিক পৃথিবীর সেই সব নাবিকদের যাঁরা নিত্যনতুন সিনেমার পসরা সাজিয়ে নতুন কোনও এক দেশের খোঁজে রওনা দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy