কৃষ্ণনগরের গোয়াড়ি গ্রামে জন্ম। অল্প বয়সে বাবা মারা গেলে মাকে নিয়ে কলকাতায় আসেন। সেই থেকে সংগ্রামী জীবন। মদের দোকানে চাকরি থেকে সার্কাসে জোকারের কাজ করেছেন। ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ করেছেন। অভিনয় করবেন বলে সব কাজ ছেড়ে সামান্য বেতনে স্টার থিয়েটারে যোগ দেন। দারিদ্রকে সঙ্গী করে সারা জীবন অভিনয় জগতেই কাটিয়েছেন এর পর। অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। গাইতেন ভাল। তবলা, পাখোয়াজ বাজাতে পারতেন। নাচের তালিমও ছিল। স্টার, মনমোহন থিয়েটার, মিনার্ভা, রংমহল থিয়েটারে ৪০টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। পরিচিতি তৈরি হলে চলচ্চিত্রে ডাক পান। ১৯২০ সালে প্রথম নাটক ‘দুর্গেশনন্দিনী’। ১৯৩২-এ প্রথম চলচ্চিত্র ‘পুনর্জন্ম’। পরবর্তী কালে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে খ্যাত হলেও প্রথম দিকে তিনি কিন্তু সিরিয়াস চরিত্রেই অভিনয় করতেন। বেশ কয়েকটি ছবি করার পর শ্রীচৈতন্যের শিক্ষাগুরু অদ্বৈতাচার্যের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নিয়মিত অভিনয় করলেও এই বাণিজ্যিক দুনিয়ায় কী ভাবে নিজের দর বাড়ানোর খেলায় শিক্ষিত হতে হয়, সে কথা তাঁর জানা ছিল না সম্ভবত। নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে প্রথম তিনি মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবিটি কিংবদন্তি উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম ছবি হলেও আজও মানুষ ছবিটি উপভোগ করেন তুলসী চক্রবর্তী- মলিনা দেবীর জুটির জন্যেই।
দৈনন্দিন বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতে অজস্র ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন তুলসী। সে সব চরিত্র দর্শকের চোখে পড়ার মতো নয়,কিন্তু অভিনয়ের নিজস্বতায় সর্বত্রই তিনি সামান্য সময়ের জন্য পর্দায় এলেও অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। অভিনয়ই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। নির্লোভ, আমুদে মানুষটি চরিত্রাভিনেতা হিসেবে সামান্য পারিশ্রমিক যা পেতেন তাতেই খুশি থাকতেন। বঞ্চনার বোধ তাঁর ছিল না। অনুপকুমার, উত্তমকুমাররা তাঁকে ভক্তি করতেন। তাঁরা নানা সময়ে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলেও প্রবল সংবেদনশীল মানুষটি তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছেন বার বার। শোনা যায়, একটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য এক মহানায়কের কথায় তাঁকে বেশি পারিশ্রমিক দিতে চাইলেও তিনি কিছুতেই তা গ্রহণ করেননি। এক বেলা অভিনয়ের জন্য যে দর পেতেন, তাই-ই নিয়েছিলেন। এমনই বিপন্নতা ছিল যে, সত্যজিৎ রায় তাঁকে যখন ‘পরশ পাথর’ ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের আমন্ত্রণ জানালেন, তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন এই সম্মানে। সত্যজিৎ রায় তাঁকে বেশি সাম্মানিক দিতে চাইলে তিনি জানিয়েছিলেন, বেশি টাকা থেকে নিলে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ না-ও পেতে পারেন আর। সবাই মনে করতে পারে, তাঁর দর বেড়ে গেছে। স্বল্প পারিশ্রমিকে দৈনন্দিন কাজ তাঁর আহার জোগায়, তা যদি বন্ধ হয়ে যায়, হঠাৎ একটি ছবির জন্য বেশি পারিশ্রমিক নিয়ে তাঁর কী লাভ? তুলসী চক্রবর্তীর এই বিপন্নতার কথা ভাবলে আজ শিহরণ হয়, লজ্জা হয়। তাঁকে শ্যুটিং স্পটে নিয়ে যাওয়ার জন্য সত্যজিৎ গাড়ি পাঠালে তিনি বিশ্বাসই করতে চাননি যে, কোনও পরিচালক তাঁর জন্য গাড়ি পাঠাতে পারেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সত্যজিৎই একমাত্র তুলসী চক্রবর্তীর সঠিক মূল্যায়ন করেছিলেন। একটি বিশ্বমানের ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁকে। সাংবাদিক রবি বসুর লেখায় উঠে এসেছে দিকপাল এই অভিনেতার সারল্যের কথা, 'পরশপাথর ছবি রিলিজের সময় তুলসীদা কেমন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। একদিন আমাকে বললেন, এইবারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনও এত বড় বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। ... এ আমি কী হনু রে!”
তুলসী চক্রবর্তী নিজেকে কমিয়ে দেখতেন, যা মহৎ শিল্পীর লক্ষণ। নিজেকে তিনি বলতেন ‘ রান্নাঘরের হলুদ, যেখানে সেখানে কাজে লেগে যাই'। তিনি নিজেকে কমিয়ে দেখলে কী হবে, জাঁদরেল সব অভিনেতারা তাঁকে সমঝে চলতেন। একটা গল্প শোনা যায়। মেজাজি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস সাধারণত এক বার স্ক্রিপ্টে চোখ বুলিয়েই ছেড়ে দিতেন, অভিনয় নিজের মতো করতেন। একটি ছবির শ্যুটিংয়ে যথারীতি মেকআপ নিয়ে ছবি বিশ্বাস পায়চারি করছেন। হঠাৎ সেখানে মেকআপ নিয়ে হাজির হলেন তুলসী চক্রবর্তী। তাঁকে দেখেই ছবি বিশ্বাস প্রোডাকশনের একজনকে ডেকে বললেন, “শিগগির স্ক্রিপ্টটা নিয়ে আমার ঘরে আয়।” পৌঁছে দেওয়া হল তাঁকে স্ক্রিপ্ট। একজন পরিচিত পরম কৌতূহলে ছবি বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এত মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়ছেন, কারণটা কী?” মুচকি হেসে ছবি বিশ্বাস বললেন, “তুলসী রয়েছে যে! কী জানি, কখন কোন প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়!”
যে অভিনেতার অভিনয় প্রসঙ্গে চার্লি চ্যাপলিনের কথা আসে, স্বয়ং সত্যজিৎ রায় যাঁকে ভারতের ‘মরিস শিভ্যালিয়র’ মনে করেছেন, তাঁর মূল্যায়ন আজ বড় জরুরি। ১২২তম জন্মদিনে হাওড়ার কৈলাস বোস থার্ড বাই লেন-এর বাসিন্দারা সঠিক দাবি তুলেছেন, হেরিটেজ ঘোষণা করে সংস্কার করা হোক নিঃসন্তান তুলসী চক্রবর্তীর পোড়ো বসতবাড়িটিকে। মুখর হয়েছেন সাহিত্যিক শংকর, শিশুসাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গুণী মানুষ। টলিউডও সেই দায় এড়াতে পারে কি?