‘সমান্তরাল’ ছবিতে ঋদ্ধি ও পরমব্রত। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
সমান্তরাল
পরিচালনা- পার্থ চক্রবর্তী
অভিনয়- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত, অপরাজিতা আঢ্য, তনুশ্রী চক্রবর্তী, ঋদ্ধি সেন, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোট থেকে অঙ্কের ভাষায় আমরা পড়ে এসেছি, একই সমতলে অবস্থিত দুটি সরলরেখাকে যে দিকে যতই বাড়ানো হোক না কেন, তারা যদি একে অপরকে কখনই ছেদ না করে তবে সে দু’টিকে সমান্তরাল সরলরেখা বলে। অভিধান ঘাঁটলে সমান্তরালের যে অর্থ পাবেন- ‘সর্বত্র সমান ব্যবধান বিশিষ্ট’। ছবির নাম ‘সমান্তরাল’। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গল্পের সরল রেখা ছকে বাঁধা কোনও সোজা পথে না গিয়ে, এবড়োখেবড়ো পথ ধরে চলতে চলতে শেষে একেবারে সীমারেখা অতিক্রম করে যায়। অভিনয়ের জোরে দু’-একবার সোজা হয়ে চলার চেষ্টা করলেও তা খুবই ক্ষণস্থায়ী।
‘সমান্তরাল’ ছবির একটি দৃশ্যে পরমব্রত। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
খোলসা হল না তো? দর্শকাসনে বসে একমনে ১ ঘন্টা ৫৪ মিনিট ধরে সিলভার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেও এই প্রতিবেদকের কাছে তা স্পষ্ট হয়নি, কেন তা সমান্তরাল। তাল কেটে, সুর ভুলে, লিরিকের আশপাশ দিয়ে না গিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে রকিং পারফরমেন্সের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু গল্পের। একে একে এসেছে উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবার, জেন ওয়াই প্রেম, ঢাকুরিয়া লেক, ভাই ভাই হাতাহাতি, মেজভাইকে (সুজন) বাড়িতে আটকে রাখা এবং এ ঘাট ও ঘাট ঘুরে শেষ পর্যন্ত জানা যায়— সুজন আদতে একজন রুপান্তরকামী। ছবির বেশ কিছু অংশের শুটিং হয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ছবির পরিচালনার গুণে তা এখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত হয়েই রয়েছে।
ছবির একটি দৃশ্যে সুরঙ্গনা, পরমব্রত ও ঋদ্ধি।
আসা যাক ছবির গল্প প্রসঙ্গে। ছোটবেলায় একটি দুর্ঘটনায় বাবা-মা’কে হারানোর পর হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করত অর্ক (ঋদ্ধি)। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে দাদুর অনুরোধে অর্ক আসে কলকাতায়। মামাবাড়িতে থেকেই শুরু হয় কলেজ পর্ব। তিন বছরের ভার্চুয়াল প্রেমিকার সঙ্গে মাখোমাখো প্রেম, পারিবারিক ঝামেলা, পড়াশুনো, গানবাজনা সব কিছুই চলে একসঙ্গে। এর মধ্যে অর্কর আগ্রহ তৈরি হয় ওর মেজমামাকে (পরমব্রত) নিয়ে। কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন, মুহূর্তে মনে হয় শিশু, আবার পর মুহূর্তে পারভার্ট। অন্য দিকে দুর্দান্ত ভায়োলিন বাদক, সুন্দর গান গায়, কবিতা পড়ে। পর পর কয়েকটি ঘটনার পর অর্কর মনে খটকা জন্মায়। এর পরই সুজনের অতীত খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এই কাজে তাকে সাহায্য করে সহপাঠী প্রেমিকা তিতলি (সুরঙ্গনা)। কথা হয় এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও। কিন্তু মেজমামার ঘরে এক দিন এক মহিলার অস্তিত্ব, একা ছদে তিতলিকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা, কুমোরটুলির অসমাপ্ত প্রতিমার গায়ে হাত বুলনো— এই ঘটনাগুলি তাকে অন্য রকম ভাবে ভাবায়। শেষে এক দিন মেয়ের সাজে সুজনকে দেখে তার ধারণা সত্যি হয়, এবং দাদুর কাছে সুজনের ছোটবেলার গল্প শুনে সেই ধারণা আরও স্পষ্ট হয়। ছবির শেষ দৃশ্যে দেখানো হয়, এই সমাজ সুজনের মত ‘প্রান্তিক’ মানুষদের চায় না। তাই তাকে বেছে নিতে হয় আত্মহত্যার পথ।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: যৌনতা নিয়ে নতুন করে ভাবালেন বিদ্যা
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: এত রিফ্রেশিং ছবি বলিউডে বহুদিন হয়নি
ছবির নামকরণ এবং বিষয়বস্তু থেকে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, শেষ পর্যন্ত যদি একজন রূপান্তরকামীর গল্প বলতে চাওয়া হয়, তা হলে কেন প্রথম থেকে তাকে বাড়িতে আটকে রেখে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী বানিয়ে অদ্ভুত আচরণ করে আলাদা খেতে দেওয়া হয়! ভোটার লিস্টেও নাম থাকে না। এমনকী মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হয়। তখন কিন্তু বাড়ির অন্য সদস্যদের কোনও প্রতিবাদ থাকে না, একমাত্র বড়বৌদি (অপরাজিত আঢ্য) ছাড়া। এ তো আর কোনও ছোঁয়াচে রোগ নয় যে সংক্রমণের ভয় থাকে। দ্বিতীয়ত, বার বার প্রায় খোঁচা মেরে বলা হয়, এরা সাধারণ মানুষদের থেকে ব্যতিক্রমী, সুন্দর মন এবং গুণের অধিকারী। সমাজে এদের প্রয়োজনীয়তা প্রায় নেই বললেই চলে। অতএব দাও ঠেলে অন্য গ্রহে। সুতরাং সমস্যার সমাধান হয় না। এক প্রকার জোর করেই সুজনেরা ‘প্রান্তিক’ মানুষের তকমাধারী হয়। শেষ পর্যন্ত সুজনের আনন্দের মুক্তি কিন্তু হয় না। হয় শান্তির মুক্তি। আর দর্শক হল থেকে বেরোনোর মুখে বলেন, এ তো ‘চিত্রাঙ্গদা’র গল্প।
এই ধরনের চরিত্রে প্রথম অভিনয় করলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। সুজন হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কতটা সফল হলেন সেই বিচারের দায়িত্ব রইল আপনাদের। চরিত্র অনুযায়ী যথাযথ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরঙ্গনার অভিনয়। কিছু দৃশ্যে বেশ সাবলীল অর্ক-তিতলির অভিনয়। রূপঙ্কর বাগচীর কণ্ঠে শুনতে মন্দ লাগে না ‘দ্যাখা হবে বলে’ গানটি। তবে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে ভায়োলিনের মায়াবী জাদু, যা সিনেমার একমাত্র উপভোগ্য।
তবে সমালোচনা, আলোচনা, তত্ত্বকথা এই দিয়ে তো আর ভাল, খারাপ সিনেমার বিচার হয় না। সিনেমা দেখে আপনি কতটা আনন্দ পেলেন, আপনার দিল কতটা খুশ হল সেটাই বিচার্য। বিনোদনের কোন স্রোতে গা ভাসাবেন সেটা না হয় আপনিই ঠিক করুন।
এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় ‘অর্ক’র মেজমামা ‘সুজন’কে তাঁর ছোটমামা হিসেবে লেখা হয়েছিল। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy