ছবির একটি দৃশ্যে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়।
চিত্রকর
পরিচালনা: শৈবাল মিত্র
অভিনয়: ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, দেবদূত ঘোষ, শুভজিত দত্ত
সদ্য শেষ হয়েছে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসবে অন্যান্য অনেক ছবির সাথে ‘চিত্রকর’ ছবিটিও দেখানো হয়েছে। দেশে বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে এ রকম কঠিন বিষয়গুলি নিয়ে সমসাময়িক বেশ কিছু ছবি দেখানো হয়ে থাকে। সেগুলোর সাথে এবং বিশেষ করে এক ধরণের ইউরোপীয় ঘরানার ছবির সাথে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে ‘চিত্রকর’-এর অনেকটা যোগাযোগ আছে। ভারতীয় ছবিতে এই সময় এ রকম বিষয় নিয়ে ছবি খুব একটা দেখা যায় না। যদিও একদম যে নেই সে কথা হলফ করে বলা যায় না। কেরল ও মহারাষ্ট্র এই মুহূর্তে একের পর এক খুবই সিরিয়াস ও রিয়ালিস্টিক ঘরানার ছবি তৈরি করছে। সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা যেহেতু নেই, সেহেতু ‘চিত্রকর’ একেবারে ইউনিক ভারতীয় ছবি কিনা সেটা বলাটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বর্তমান অধিকাংশ বাংলা ছবির নিরিখে এই ছবিটি কিছুটা আলাদা। বিষয়বস্তুর পার্থক্য তো আছেই, তার সঙ্গে মানসিকতারও এক ধরণের পার্থক্য আছে।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: যৌনতা নিয়ে নতুন করে ভাবালেন বিদ্যা
অনেক কাল আগে ছাত্র অবস্থায় যখন চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করছি, তখন একটা ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল। ছবিটির নাম ‘ইনার আই’। চিত্রশিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের বানানো একটি তথ্যচিত্র। রায়বাবুর তথ্যচিত্র নিয়ে একেবারেই কোনও ধারণা তখন ছিল না। কিন্তু ছবিটি দেখার পর তা নিয়ে সেই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। পরবর্তী কালে বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু তথ্যচিত্র যখন দেখা হয়ে গিয়েছে, তখন উপলব্ধি করেছিলাম ‘ইনার আই’-এর মাহাত্ম। একজন শিল্পী যখন আর একজন শিল্পীকে দেখতে থাকেন, এবং তাঁর শিল্প মাধ্যমে (এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র) তাঁর দেখাকে প্রতিফলিত করেন, তখন তা একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। প্রসঙ্গত, বিনোদবিহারী মহাশয় বিশ্বভারতীতে সত্যজিৎ রায়ের শিক্ষক ছিলেন। ‘ইনার আই’ হয়ে উঠেছিল একজন মহান শিল্পীর প্রতি আর একজন মহান শিল্পীর এক ঐতিহাসিক শ্রদ্ধার্ঘ। পাঠকের মনে হতে পারে যে অন্য একটি ছবি নিয়ে এত কথা কেন বলছি। বলছি কারণ, ‘চিত্রকর’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক শৈবাল মিত্র একই সাথে সত্যজিৎ রায় ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের প্রতি তার মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। এর সাথে তিনি মিলিয়েছেন মার্কিন চিত্রশিল্পী (জন্মসূত্রে রুশ-ইহুদি) মার্ক রথকোর জীবনের একটি পর্যায়কে। ভারতীয় কনটেক্সটে যেহেতু মার্ক রথকোকে ধরাটা ডিফিকাল্ট, সেহেতু তাঁকে তাঁর সমসাময়িক এবং সমমনস্ক একজন ভারতীয় শিল্পীর (বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়) জীবনের একটা পরিসরের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার একটা ইন্টারেস্টিং প্রয়াস পরিচালক মশাই করেছেন। এখন সেই প্রয়াসে কতটা ভাল লাগা আছে আর কতটা মন্দ লাগা আছে, কতটা সফলতা আছে আর কতটা খামতি আছে, শিল্পের গভীর তত্ত্ব আছে নাকি শিল্পের কেন্দ্রে ঢোকার বিফল চেষ্টা আছে, সেটা আলোচনার বিষয়। আর সেই আলোচনা ও ভাবের আদান প্রদানটা গভীরভাবে করতে পারবেন তাঁরাই, যাঁরা চিত্রশিল্প নিয়ে রেগুলার বেসিসে চর্চা করে থাকেন। আমি এই বিষয়টা নিয়ে তেমন কোনও অ্যানালিটিকাল আলোচনা করতে পারব না। তবে সিনেমার ভাষা আর তার ব্যাকরণ যেহেতু শুধুমাত্র দেশকাল আর ছবির বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সেহেতু তা নিয়ে সামান্য কিছু কথা বলে সমালোচনার ইতি টানবো। তার আগে ছবির গল্পের একটা আভাস দেওয়ার দরকার আছে।
ছবির একটি দৃশ্যে অর্পিতা।
ছবিতে তিথি (অর্পিতা) একজন ইয়ং পেইন্টার। যার ছবি আর বিক্রি হয় না। সাফল্য বলতে যা বোঝায় সেটা তার জীবন থেকে সম্পুর্ণ বিদায় নিতে বসেছে। হতাশা তাকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। এমত পরিস্থিতিতে সে বিজন বোস (ধৃতিমান) নামক একজন সিনিয়র শিল্পীর সহযোগী হওয়ার কাজ পায়। বিজনবাবু ওরফে কত্তামশাই এক সময়ের একজন বিখ্যাত চিত্রকর। বর্তমানে সম্পূর্ণ অন্ধ এবং একা। তিনি শহুরে জীবন থেকে অনেক দূরে একলা (খানিকটা শান্তিনিকেতনের আশেপাশের কোনও একটি গ্রামের আদলে ক্রিয়েট করা) নামক একটি গ্রামে থাকেন। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি ম্যুরাল তৈরির একটি বড় কাজ করার অফার পেয়েছেন এবং রাজি হয়েছেন। সেই কাজের জন্যই তিনি তাঁর এক ছাত্রকে, (দেবদূত ঘোষ) যিনি বর্তমানে একজন সফল আর্ট কিউরেটর, একজন সহযোগীর ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। এই কাজটাই তিথি করতে আসেন। টাকার চাপে খানিকটা বাধ্য হয়েই আসেন। এর পর এই কাজকে কেন্দ্র করে দু’জন অসমবয়েসী শিল্পীর, অর্থাৎ আধুনিকতা বনাম পুরাতন ঐতিহ্যের, দন্দ্ব ও তর্ক চলতে থাকে। এবং একটা সময় গিয়ে এই তর্কের মাধ্যমে ছবিতে একটা অস্পষ্টতা তৈরি হয়। শিল্পের চিরন্তন অস্পষ্টতা। কিন্তু শিল্পে (এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রে) দু’ধরনের অস্পষ্টতা থাকে। ভাল অস্পষ্টতা আর খারাপ অস্পষ্টতা। এক ধরনের অস্পষ্টতার গভীরে কিছু লুকানো চৈতন্য থাকে। যা দর্শককে অনেক ক্ষণ ধরে অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করে। আর খারাপ অস্পষ্টতার ব্যাপারটা এ জন্যই অস্পষ্ট কারণ তার অবচেতনে এ রকম কিছু থাকে না। এর সাথে সম্পর্ক রেখে আর একটা বিষয় চলে আসে। সেটা হল সিনেমা হলে ছবি দেখতে দেখতে অনেক সময় দর্শক নিশ্চুপ হয়ে পড়েন। তারও ভাল, খারাপ দুটো দিক আছে। প্রথমটা হয় সম্পূর্ণ ভাবে ছবির সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাওয়ার ফলে। আর দ্বিতীয়টা হয় প্রধানত ছবির সাথে জড়িত হওয়ার চেষ্টা করে বিফল হওয়ার কারণে। এখন এই বিফলতার কারণ ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। আমি বিফল হয়েছি কারণ, ছবিটা দেখতে দেখতে আমার কখনও মনে হয়েছে আমি একটা বই (বুক) পড়ছি, আবার কখনও মনে হয়েছে সেমিনারে বসে শিল্পের উপর কোনও লেকচার শুনছি। আসলে যে একটা ছবি দেখছি সেটা খুব একটা মনে হয়নি। বই লেখা, আলোচনা করার সাথে চলচ্চিত্রের নিশ্চয়ই অনেক পার্থক্য আছে। চলচ্চিত্র তৈরির একটা বেসিক ধাঁচা বা ভিত আছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরিচালকরা সেই বেসিক ধাঁচাকে ফলো করেছেন, সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়েই তাকে নিয়ে ভাঙাচোরার খেলা খেলেছেন এবং খেলে চলেছেন। ফলে তিনটেকে এক করে দেওয়ার মধ্যে সেই বেসিক ধাঁচা সম্পর্কে এক ধরণের অজ্ঞানতার প্রকাশ পেয়ে থাকে এবং এই ছবিতে সেটা পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, খারাপ অস্পষ্টতার মূল কারণ হল ছবির লজিকাল মিস্টেক। একটা যুক্তি এস্টাব্লিশ করার পর শেষ পর্যন্ত তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়। একটা কন্টিনিউইটি বজায় রাখতে হয়। নইলে সেই বক্তব্য এক ধরণের সিদ্ধান্তহীন বীক্ষায় পরিণত হয়। যেটা কিনা এই ছবিতে খুব বেশি করে মনে হয়েছে। কঠিন বিষয় নিয়ে গম্ভীর ছবি ‘চিত্রকর’। আবার বলছি, এটা আমার মনে হয়েছে। অন্য কারও কারও মনে হতেও পারে, আবার নাও মনে হতে পারে।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: এত রিফ্রেশিং ছবি বলিউডে বহুদিন হয়নি
‘ইনার আই’ ছবিটি ছিল একজন মরমিয়ার অন্তর উজাড় করে দেওয়া একটি গান। আর ‘চিত্রকর’ হল একজন প্রবীণ শিল্প তাত্ত্বিকের আজীবন ধরে সংগৃহীত কিছু জ্ঞানের প্রকাশ। বাণী বাণী তোমার অন্তরকে দেখা যায় না কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy