Advertisement
E-Paper

সারা জীবন ফাইট কেরই তো কেটে গেল

দু’বছর পরে তাঁর আগামী ছবি ‘ফোর্স’-এর জন্য সে দিন আবার ঢিসুম ঢিসুম করলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। গার্ডেনরিচের ওয়্যারহাউজে সেই শ্যুটিং করার ফাঁকে তাঁর জীবনের নানা ফাইটের গল্প বললেন। শুনলেন ইন্দ্রনীল রায় দু’বছর পরে তাঁর আগামী ছবি ‘ফোর্স’-এর জন্য সে দিন আবার ঢিসুম ঢিসুম করলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। গার্ডেনরিচের ওয়্যারহাউজে সেই শ্যুটিং করার ফাঁকে তাঁর জীবনের নানা ফাইটের গল্প বললেন। শুনলেন ইন্দ্রনীল রায়

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৪ ২১:২৭

পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তাঁর ‘বিট’কে নিয়মিত ফোন করা রুটিনের মধ্যেই পড়ে। সেদিন ফোন ঘোরাতেই অন্য দিক থেকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “অনেক তো রোম্যান্টিক গান আর সিনের শ্যুটিং কভার করলেন। ‘ফোর্স’-এর জন্য একটা ফাইট সিকোয়েন্স করছি গার্ডেনরিচে। এসে দেখেই যান এই বয়সেও কেমন ফাইট করছি।”

লোভটা সামলাতে পারিনি। তাঁর কথা অনুসারে পরের দিন দুপুরে পৌঁছেছিলাম গার্ডেনরিচের সেটে। তখন সবে, সেই ছবির পরিচালক রাজা চন্দ লাইটিং করছেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ভ্যানিটি ভ্যানে বসে আইপ্যাডে নতুন হিন্দি ছবির ট্রেলরগুলো দেখছেন। একটু পরেই শুরু হবে ফাইট সিকোয়েন্স। দু’ বছর আগে ‘বিক্রম সিংহ’ ছবিতে তিনি শেষ বার ফাইট সিকোয়েন্স করেছিলেন। তার পর এই ছবিতে। এই নিয়ে সে দিন সেটে সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

এত লজ্জা আমাকে আর কেউ দেয়নি

এর মধ্যে ফাইট মাস্টার জুডো রামু ঢুকলেন তাঁর ভ্যানিটি ভ্যানে। প্রসঙ্গত, এই জুডো রামু তিনশোর ওপর বাংলা ছবিতে ফাইট সিকোয়েন্স করছেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না, চেন্নাইতে কমল হাসন আর রজনীকান্তের সঙ্গে কাজ করার সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে আলাপ প্রসেনজিতের। এবং প্রসেনজিতের কথাতেই কলকাতায় আসেন বাংলা ছবির ফাইট সিকোয়েন্স পরিচালনা করতে। ভ্যানে তিনি জানালেন কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ফাইট। রামুর কাছে জানা গেল, তাঁর কেরিয়ারে সবচেয়ে বেশি লজ্জা দিয়েছেন যিনি, সেই মানুষটির নাম প্রসেনজিৎ।

“কত বার হয়েছে রাত তিনটের সময় প্যাক আপ করেছি। সাহস হয়নি বুম্বাদাকে বলতে যে সকাল সাতটায় আবার তাঁর কলটাইম। কিন্তু তাও সাহস করে গিয়ে বলেছি এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের, সকাল পৌনে সাতটার মধ্যে উইথ মেক আপ রেডি হয়ে সেটে ঢুকে গিয়েছেন তিনি। আমরা কিন্তু তখনও ঘুমোচ্ছি। এত লজ্জা আর কোনও স্টার আমায় দেয়নি,” নিজের সাউথ ইন্ডিয়ান অ্যাকসেন্টে বলছিলেন জুডো রামু।

তাঁর কথার মাঝেই প্রসেনজিৎও ফাইটের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। ঘর থেকে সবাইকে বের করে বেশ কিছুক্ষণ ওয়ার্কআউট করলেন।

“ফাইট সিকোয়েন্সের আগে জিম করা মাস্ট। এমনিতে রোজ দু’তিন ঘণ্টা ওয়ার্কআউট করি। আনফিট হয়ে ফাইট করলে শুধু খারাপ দেখাবে তাই নয়, বড় ইনজুরি আপনার কেরিয়ারও শেষ করে দিতে পারে,” বলেন তিনি। এর মধ্যেই তাঁর মেক আপ ম্যান সুভাষ এসে তাঁকে কস্টিউম দিয়ে গেলেন। অল্প মেক আপ করে ঢুকলেন সেটে।

“সিনেমায় ফাইট মানে কিন্তু পুরোটাই টাইমিং। এবং অনেকটা ভাগ্য। কত বার যে বড় অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আজ এত বছর পরে মাঝে মাঝে মনে হয়, সিনেমায় ফাইট আর জীবনের ফাইট পুরোটাই কপাল আর টাইমিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে,” সেটে ঢুকে চা খেতে খেতে বলছিলেন প্রসেনজিৎ।

এমনিতেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সেটে ঢোকা একটা অভিজ্ঞতা। তিনি ঢুকলেই সব বয়সের মানুষ এসে তাঁকে প্রণাম করেন। কখনও ইলেকট্রিশিয়ান, কখনও তাঁর ডামি, কখনও ক্যান্টিনের ছেলে। এই রকম ভালবাসা বোধ হয় গোটা টালিগঞ্জে আর কেউ পায় না। “এদের জন্যই তো বেঁচে আছি রে,” ধীরে ধীরে বলেন তিনি।

এর মধ্যেই শুরু হয় ফাইট। একটা জিপের দরজা খুলে গুলি করতে হবে প্রসেনজিৎকে। শুধু গুলি করলেই হবে না, এক হাত দিয়ে চলন্ত জিপটাকে কন্ট্রোল করতে হবে। প্রথম শট হল না। দ্বিতীয় শটে ডিরেক্টর খুশি। শট ওকে।

শুরু হল আড্ডা।

শরীরটাকে নিয়ে তছনছ করেছি

কথা বলতে বলতেই জানা গেল ‘দুটি পাতা’ ছবিতে থুতনি ভেঙেছিল তাঁর। আর তার পর তাঁর কেরিয়ারের প্রথম বড় হিট ‘অমরসঙ্গী’তেও হয়েছিল বিরাট অ্যাকসিডেন্ট।

“তখন আমি কিছুই জানতাম না। আমাকে ফাইট মাস্টার বলেছিল গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনে হাত ঢুকিয়ে সেটা ভাঙতে হবে। নিজেকে দাঁড় করানোর এমনই নেশা ছিল যে কিছু না ভেবেই হাত দিয়ে কাচটা ভেঙেছিলাম। তার পর রক্তারক্তি কাণ্ড!” বলছিলেন তিনি।

তার পর ফুলস্লিভ শার্টের হাতা ফোল্ড করে দেখালেন হাতে এখনও কাচ ঢোকার ক্ষতগুলো। “শরীরটাকে আমি তছনছ করেছি জানেন। আজ বুঝতে পারি,” গম্ভীর গলায় বলেন মি. টলিউড। কথায় কথায় নিজেই বললেন ফাইট সিকোয়েন্সে মারামারি করতে করতে তাঁর হাঁটুর জোর আজ প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। “এখনও জিম করি বলে চালিয়ে যাচ্ছি। না-হলে আমার হাঁটুর আর কিছু নেই। এ ছাড়াও বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল একটা,” চোখ টিপে বলেন তিনি।

সেটা কী রকম?

“হায়দরাবাদের রেড হিলস-এ শ্যুটিং করেছিলাম। প্রায় ১০-১৫ মিটার উপর থেকে নীচে পড়েছিলাম। পুরো ল্যান্ডিংটাই হয়েছিল পিঠে। সেই থেকে স্পন্ডিলোসিস। আজও পিঠে মাঝেমধ্যে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা হয়,” সেটের লাইটিং দেখতে দেখতে বলেন ‘অরুণ চ্যাটার্জি’।

আমরাও বাঘের সঙ্গে মারামারি করেছি ভাই, শুধু মিডিয়া ছিল না

এর মাঝখানে ‘আশা ভালবাসা’ ছবিতে বাঘের সঙ্গে শ্যুটিংয়ের কথা চলে এল। ওটা যে তাঁর জীবনের এক অন্যতম বড় ফাইট সিকোয়েন্স, সেটা নিজেও স্বীকার করলেন।

“বোটানিকাল গার্ডেন্স-য়ে শ্যুটিং হয়েছিল। বাঘের সঙ্গে অ্যাকশন ছিল আমার। সমারসল্ট ছিল। জড়িয়ে মারামারি ছিল। কিন্তু আমি কোনও বডি ডাবল নিইনি... শ্যুটিংয়ের এক মাস পরেও বাড়ি ঢুকলে সেই বাঘের গায়ের গন্ধ পেত মা। তাই বলি, আমরাও করেছি ভাই বাঘের সঙ্গে শ্যুটিং। শুধু লেখালিখি হয়নি। কারণ সেই সময় মিডিয়াকে সেটে ডাকলেও আসত না।” বোঝা যায়, সেই সময় মিডিয়ার আচরণে কোথাও একটা কষ্ট আর অনেকটা দুঃখ থেকেই গিয়েছে তাঁর।

এর মধ্যেই রাজা চন্দ এসে তাঁকে সে দিনের শিডিউলটা বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। ফাইট সিকোয়েন্সের মাঝেই বললেন বুম্বাদার সঙ্গে এই ছবি করতে গিয়ে কী কী শিখেছেন তিনি। “বুম্বাদার কাছে প্রোডাকশন ডিজাইন শিখেছি। শিখেছি কী ভাবে সব দিক সামলে টাকা খরচ করতে হয়। টলিউডের সবচেয়ে বড় প্রোডাকশন ডিজাইনার তো বুম্বাদা নিজেই। এটা অবশ্য ইন্ডাস্ট্রির সবাই মানে, স্পেশালি নিসপাল সিংহ রানে,” বলেন রাজা।

রাজার কথা শেষ হতেই নিজের ফাইটের আরও কথা বললেন তিনি। আড্ডা মারতে মারতে জানা গেল ‘প্রতিবাদ’ ছবিটির পরে প্রায় একশো ছবিতে কোনও ব্রেক ছাড়া তিনি ফাইট করে গিয়েছেন। “তখন আমার ছবি মানেই ফাইট সিকোয়েন্স। এক বার ভ্রু ফাটালাম, এক বার মাইসোরে ‘মিত মেরে মন কী’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময় বাঁ কাঁধটা ডিসলোকেট করলাম। আজও মাঝেমধ্যে সেই ব্যথাটা হয়। যদিও এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে,” বলেন প্রসেনজিৎ। নিজেই বললেন এত চোট সারানোর জন্য তাঁর ডাক্তার ছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। “তখন আমি আর শুভেন্দু জেঠু একটার পর একটা ছবি করছি। ফাইট করতে গিয়ে লাগলে শুভেন্দু জেঠু ওষুধও দিতেন।” বোঝা যায়, পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপে আজ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের।

এর পর রাত দশটা অবধি একটার পর একটা ফাইট সিকোয়েন্স করে গেলেন তিনি। এনার্জির কোনও খামতি একবারের জন্যেও বোধহয় চোখে পড়ল না। শুধু মাঝে মাঝে এক কাপ করে চা আর একটা বিস্কুট তখন তাঁর সঙ্গী। গার্ডেনরিচে তখন রাত। সেট থেকে বেরনোর আগে শুধু একটাই কথা বললেন প্রসেনজিৎ। “আমার জীবনে, মনের ভিতরের ফাইটের কথা অনেকেই জানেন। এই প্রথম বাইরের ফাইটের কথা বললাম। ফাইট করেই তো কেটে গেল জীবনটা।”

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

forcemovie prasenjit chatterjee prasenjit chattopadhyay indranil roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy