ওই পরিচালকদের একজন মানুষের প্রতি সাঙ্ঘাতিক দায়বদ্ধতা থাকত। সেটা প্রোডিউসর। ওঁদের ধ্যানজ্ঞান ছিল কী করে প্রোডিউসরের ঘরে টাকা ফেরত পাঠাব।
আগে ছবি না চললে পরিচালকরা এসে বলতেন, ‘‘বুম্বাদা, ওই প্রযোজকের আগের ছবিতে টাকা ফেরত দিতে পারেনি। আপনি আর একটা ছবি প্লিজ করে দেবেন। হিট হয়ে গেলে ওই মানুষটা আবার লগ্নি করবে।’’
আমি এ রকম প্রচুর ছবি করেছি যেখানে এক পয়সাও নিইনি। কিন্তু এই ব্যাপারটা ইনিশিয়েট করতেন পরিচালকরা নিজে। সেই দায়টা বোধহয় আজকে কমে গিয়েছে।
আমরা স্মার্ট কনটেন্ট, স্মার্ট কনটেন্ট বলতে বলতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি যে, মানুষ আর রিলেট করতে পারছে না।
আরে, আজ থেকে দশ বছর আগের সময়টা ভাবুন। তখন কমার্শিয়াল ছবিতে ‘...ফাটাকেষ্ট’ হচ্ছে, ‘সাথী’ হচ্ছে, ‘মায়ের আঁচল’ হচ্ছে... এই ছবিগুলো তো দেখত মানুষ। সুপারহিট ছবি। আর একটা কথা বলতে পারি?
সিওর...
আমরা জানতাম কলকাতায় ম্যাটিনি শো আর গ্রামের দিকে দুপুর দেড়টার শোটা হাউজ ফুল করে মা-বোনেরা। এবং রোববারের পরে যদি সোমবারও ওই দু’টো শো ফুল হয়, তা হলে চোখ বন্ধ করে বারো সপ্তাহ।
মানে পিওর অঙ্ক?
একদমই। আর এখানেই প্রশ্ন, স্মার্ট মেকিংয়ের চক্করে কি আমরা এত স্মার্ট হয়ে গেলাম, যে ওই দর্শকদের হারিয়ে ফেললাম?
হঠাৎ করে বড্ড বেশি বেলুনের মতো ফুলে গেলাম আমরা। আমার তো কষ্ট হয় সেই দর্শকদের হারিয়ে, আপনাদের হয় না? যে জায়গাটা রুল করতাম আমরা সেখানে ঢুকে গেল টেলিভিশন। টেলিভিশনের কনটেন্ট কী? সেই ফ্যামিলি ড্রামা, ইমোশনস। আগে তারা সিনেমায় সেগুলো পেত, আজ টিভি থেকে পাচ্ছে। পাচ্ছে বলেই সিনেমা থেকে সরে গিয়ে ওটা বেশি করে দেখতে শুরু করল আমাদের মা-বোনেরা।
এতটাই দেখতে থাকল যে আমি গ্রামেগঞ্জে গিয়ে বুঝতে পারি কী অসম্ভব জনপ্রিয় এই টিভির নতুন ছেলেমেয়েরা! সবার নাম হয়তো মানুষ জানে না, কিন্তু ওদের চরিত্রগুলোকে চেনে।
মানে, বাহা, মৌরি ফিল্মস্টারদের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাতে পেরেছে?
সাঙ্ঘাতিক ভাগ বসাতে পেরেছে। একবার গ্রামে গিয়ে দেখে আসুন না।
আমাদের, মানে সিনেমার স্টারদের শোগুলোতে তো লোক কম হচ্ছে না। হাজার হাজার লোক দেখতে আসছে। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? মানে দাঁড়াচ্ছে, ফিল্মস্টারদের দেখতে তাদের প্রচুর ইন্টারেস্ট, কিন্তু যে সিনেমাটা আমরা বানাচ্ছি সেটার সঙ্গে তারা রিলেট করতে পারছে না। কিন্তু এত কথার পর তাও বলছি একমাত্র রাজ (চক্রবর্তী)-ই পারে হার্ডকোর কমার্শিয়াল ঘরানার ছবি বানাতে। ওকে দেখে বুঝি ও ভীষণ রুটেড। এ ছাড়াও আর একটা প্রবলেম আছে।
কী সেটা?
রাজকে বুঝতে হবে সব রকম দর্শক ওর ছবি দেখবে না। আরে, স্বপন সাহা তো কোনও দিন ভাবেননি নন্দনে ওঁর ছবি চলবে। ঠিক যেমন ঋতুপর্ণ ঘোষ ভাবেনি ওর ছবি পানাগড়ে চলবে।
যে সময়ে স্বপন সাহারা একচেটিয়া কাজ করেছেন, সেই সময় থেকে আজকের গ্রামবাংলাও তো অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আজ স্বপন সাহা কি এই স্মার্টফোনের যুগে প্রাসঙ্গিক হতেন?
হ্যাঁ, গ্রাম বদলে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু স্বপন সাহা সেই সময়ের গ্রামের দর্শকদের ফাটিয়ে এন্টারটেইন করতেন। সেই মানুষগুলো, সেই দর্শককুল তো আজও আছে। মানছি সেই মানুষগুলোর হাতে আজকে স্মার্টফোন, কিন্তু তাঁরা তো আজও এন্টারটেন্ড হতে চান। সেই মানুষগুলোকে ভেবে কি আমরা কেউ বানাচ্ছি? কেউ বানাচ্ছি না।
স্বপন সাহা আর ঋতুপর্ণ ঘোষের মধ্যে যে বিভাজনটা ছিল, সেটা উঠে যাওয়ার জন্য কি মিডিয়া দায়ী?
কেন বলছেন বলুন?
এই জন্যেই বলছি মিডিয়া আজকে সৃজিত, কৌশিক, কমলেশ্বরের ইন্টারভিউ নিয়মিত ছাপে। কাগজ খুললেই তাঁদের ছবি দেখা যায়। আজকে রাজ, রাজীবের মনে হতেই পারে, আরে অন্য রকম ছবি বানালেই তো কাগজে ছবি বেরোবে, না হলে নয়!
খুব ভাল প্রশ্ন। এটা হতে পারে। কিন্তু আগে তো স্বপন সাহা, অ়ঞ্জন চৌধুরীদের কখনও মনে হয়নি কাগজে ছবি ছাপার কথা? আজকে...
...সময়টাও তো পাল্টে গিয়েছে। হয়তো স্বপন সাহাদের থেকে রাজদের লোভ বেশি ছবি ছাপানোর ক্ষেত্রে?
হ্যাঁ, কাগজে ছবি বেরোলে সবার ভাল লাগে। কিন্তু রোজ রোজ ছবি ছাপিয়ে কী হবে বলুন তো? দেখি তো সব ছবি। দইয়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, কেকের দোকানে দাঁড়িয়ে সব ছবি তুলছে। কী লাভ তাতে?
এত দেখা গেলে অভিনেতার স্টারডমটা তো চলে যাবেই। পরিচালককেও মানুষ সিরিয়াসলি নেবে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আজকালকার জেনারেশন কি শুভেন্দুজেঠুকে বলা উত্তমকুমারের সেই পেট্রোল পাম্পের গল্পটা ভুলে গেল নাকি? এরা কি উত্তমকুমারের থিওরি ভুল প্রমাণিত করবে? এটা একটু ভেবে দেখুক সবাই। মাঝেমধ্যে মনে হয় অভিনেতা, পরিচালক আর মডেলদের মধ্যে একটা বেসিক তফাত থাকবে রে বাবা।
এটা স্ট্রং স্টেটমেন্ট কিন্তু...
জানি অপ্রিয় হব, কিন্তু কাউকে তো বলতে হবে। আর একটা জিনিস, আজকাল শুধু দেখি সাকসেস পার্টি হচ্ছে। আরে কীসের সাকসেস পার্টি! সাংবাদিক হিসেবে তো যান ওই সব পার্টিতে। গিয়ে জিজ্ঞেস করেন তো প্রোডিউসারকে, আপনার পরের ছবি কী? দেখবেন প্রোডিউসার তাঁর ছবিরই সাকসেস পার্টিতে বলছেন, না আমি কোনও ছবি শুরু করছি না। তা হলে কীসের পার্টি হচ্ছে এ সব?