Advertisement
০১ এপ্রিল ২০২৩

বিপ্লবী, তবু পিতৃতান্ত্রিক

গদারকে নতুন ভাবে দেখাল কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব। তাঁকে নিয়ে তৈরি ফরাসি  ছবিতেগদারকে নতুন ভাবে দেখাল কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব। তাঁকে নিয়ে তৈরি ফরাসি  ছবিতে

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

আগামী ৩ ডিসেম্বর তিনি ৮৭ বছরে পা দেবেন। তবু এই কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নিরুচ্চারে জাঁ লুক গদার-ই নায়ক। আজ সকালে নন্দনে দেখা যাবে তাঁর ছবি ‘গ্র্যাঞ্জার অ্যান্ড ডিকাডেন্স অফ আ স্মল ফিল্ম বিজনেস।’ ১৯৬৮ সালে গদারের জীবনের এক বিপর্যস্ত অধ্যায় নিয়ে নন্দন ও নজরুলতীর্থে ইতিমধ্যেই দেখানো হয়েছে ফরাসি ছবি ‘রি়ডাউটেবল’। সিনেমার বর্ষীয়ান কিংবদন্তির তৈরি ছবি এবং তাঁকে নিয়ে ছবি… এই মণিকাঞ্চন যোগ উৎসবে আগে বিশেষ ঘটেনি।

Advertisement

ফরাসি ছবি ‘রিডাউটেবল’ এক সংকটবিন্দু নিয়ে। ১৯৬৮। প্যারিসে ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রছাত্রীরা সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে স্লোগান লেখে, ‘উত্তিষ্ঠিত! জাগ্রত! হে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাঘরেরা।’ আরও লেখে, ‘শিখেছ যা, ভোলো সব। অভ্যাস কোরো স্বপ্ন দেখা।’ গদারও নেমে আসেন আন্দোলনের রাস্তায়। কেউ সেলেব্রিটিকে দেখে মুগ্ধ, ‘আচ্ছা, ব্রেথলেসের মতো ছবি আবার কবে করবেন?’ কিন্তু বিপ্লবী ছাত্ররা বলে, ‘চুলোয় যাক গদার।’ সিনেমার পরদায় স্ত্রী অ্যানে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ছাত্রদের সামনে এত ভেবড়ে যাও কেন?’ গদারের উত্তর, ‘কারণ ওরা তরুণ। তরুণরা সব সময়েই ঠিক। আমি তো গদার নামে এক সেলেব্রিটি পরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করছি।’ জাঁ লুক গদার মানে সিনেমা, নৈরাজ্য ও তারুণ্যের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।

’৬৮-র ওই সময়টায় প্রথম স্ত্রী অ্যানে কারিনার সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে, ঘর বেঁধেছেন আর এক নায়িকা অ্যানে উইজামেস্কির সঙ্গে। তাঁর নতুন ছবি মাওয়ের চিনে দেখানো হোক, চান গদার। কিন্তু চেয়ারম্যানের চিন বাতিল করে দিয়েছে সেই ছবি, ‘এই পরিচালক বুর্জোয়া অবক্ষয়ের প্রতিভূ। বিপ্লবের মানে বোঝে না।’ বিপ্লবের মানে? ধন্দে পড়েন গদার। সে তো চে গেভারা এক রকম বলেন, মাও আর এক রকম। ফ্রান্স এবং জাঁ লুক গদারের সংকট তখন প্রায় একাকার।

‘রিডাউটেবল’ ছবির দৃশ্য

Advertisement

সংকট তো দাম্পত্যেও! উইজামেস্কি গদারের ছবির বাইরে অন্য ছবিতে অভিনেত্রী হতে চান, গদার বোঝান, ‘অভিনেতা তো পুতুল। হাসতে বললে হাসে, কাঁদতে বললে কাঁদে।’ উইজামেস্কি অন্য পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করতে গেলে আউটডোরে সটান চলে যান গদার, ‘তুমি কি এই নায়কের সঙ্গে রাত কাটাচ্ছ?’ সিনেমার বিদ্রোহী শিশুর মধ্যেও কি থেকে যায় পিতৃতন্ত্রের অবশেষ?

কিন্তু ষাটের দশকের ওই সময়টায় নারীই কি ছিল না তাঁর বর্মহীন গোড়ালি? গদারের প্রথম স্ত্রী অ্যানে কারিনাকে নিয়েও চমৎকার একটি গল্প আছে। তরুণ পরিচালক গদার কারিনার কাছে গিয়েছেন, ‘ব্রেথলেস’ নামে একটি ছবি করবেন। কথায় কথায় পরিচালক জানালেন, ছবিতে একটি নগ্ন দৃশ্য আছে। কারিনা তখন প্রায় সদ্য তরুণী, তিনি বললেন, ‘আপনি পাগল? নগ্ন দৃশ্য আমি করব না।’ পরিচালক নাছোড়বান্দা, ‘কিন্তু সাবানের অ্যাডে তো বাথটবে আপনাকে ওই ভাবেই দেখি।’ কারিনা বললেন, ‘ওগুলোয় আমি বাথসুট পরে থাকি। সাবানের ফেনা আমার ঘাড় অবধি থাকে। আপনারা মনশ্চক্ষে আমাকে নগ্ন দেখেন।’ নারীর কাছে পাওয়া এই শিক্ষাই কি গদারকে শিখিয়েছিল, ‘‘সিনেমা আসলে মিথ্যা! নারীকে অনুভব করা যায়, সিনেমাকে নয়। সিনেমাকে তো চুমু খেতে পারবেন না।’’

এই সিনেমা আসলে ক্যামেরা এবং এডিটিং টেব্‌লে তৈরি রূপকল্প! আজ নন্দনে গদারের যে ছবি দেখানো হবে, তার বিষয়ও প্রায় একই। স্বাধীনচেতা এক পরিচালক সিনেমা করতে চান। টিভি কি সত্যিই সিনেমার চেয়েও শক্তিশালী মাধ্যম? না কি সিনেমার সব সম্ভাবনা এখনও আমাদের চোখে ধরা দেয়নি, জানতে চান তিনি। ‘‘গদার তো শুধু পরিচালক নন, সিনেমার দার্শনিক এবং ইতিহাসকার,’’ বলছিলেন ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।

প্রসঙ্গত, ‘রিডাউটেবল’ ছবিটি গদারের দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানে উইজামেস্কির স্মৃতিকথা থেকে তৈরি। ঘটনাচক্রে অ্যানে গত মাসে ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। কলকাতার উৎসব তাঁকে ফের পরদা-জীবন দিল। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়।

শাহরুখ, অমিতাভের ইন্ডোর-উদ্বোধনের পর যদি সিরিয়াস ছবি দেখতে হয়, কিংবদন্তিদের ‘ইররেভারেন্ট’ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করতে হয়, ফিল্ম উৎসব সেই সুযোগটাও করে দিচ্ছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.