ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার অধ্যাপক শান্তনু বসু ,আমার সহপাঠী, ছোটবেলা থেকে তৃপ্তি মিত্রের ছাত্র। এইমাত্র ফোনে গলা ভিজে এল ওঁর, ‘‘শাঁওলিদির কলকাতার বাইরে শো ছিল এক দিন ‘নাথবতী’র। আমাদের জেঠিমা (তৃপ্তি মিত্র) তখন খুব অসুস্থ। মেকআপ না তুলে ওই টানা কাজল চোখে চুলে জরির ফিতে বাঁধা অবস্থায় শাঁওলিদি চলে এসেছেন মায়ের সেবা করতে। সন্ধ্যায় আবার শো। মেকআপ তোলার সময়টুকু বাঁচে যে!’’
ছেলেবেলা থেকে অসুখ বিসুখ লেগেই থাকত। ‘রেডিয়োতে যখন অমল করতে হল, তখন আমি খুব অসুস্থ থাকতাম। প্রায় সময়ই বিছানায় শুয়ে বসে কাটত। তখন মা এক দিন রেডিয়োতে অমল করতে হবে বলে আবার পড়বার জন্য ‘ডাকঘর’ বইটা আমার বিছানায় দিয়ে গেল। সে দিন ‘ডাকঘর’ পড়ে আমি কাঁদতে লাগলাম, গোড়া থেকেই’ লিখছেন তিনি তাঁর ‘দিদৃক্ষা’ বইতে।
মনে পড়ছে, বিজয়ার পর ফোন করেছি। বললাম, ‘‘দিদি এ তো ‘রক্তকরবী’র সময়। আসবেন, নাটকটা পাঠ করতে?’’
‘‘আমি আর কোথাও বোধহয় যেতে পারব না রে’’, বলেই বিষাদ আড়াল করতেই বোধ হয় ‘‘হ্যাঁ রে, রাখি?’’ বলে ফোনটা ছেড়ে দিলেন। আর কেউ ফোনের রিং-এর উত্তরে নিখুঁত উচ্চারণে আর য ফলার মীড় আলতো ভাসিয়ে বলে উঠবেন না , ‘‘হ্যাঁ?’’ একই বছর না যেতে গৌরী ঘোষ আর শাঁওলি মিত্র আমাদের রিক্ত করে কোন পরপারে নিয়ে গেলেন স্পষ্টতম আর মিষ্টতম বাংলা বলাটিকে।
ওঁর ‘বিতত বিতংস’ নাটকের ‘নরেন’, ‘নাথবতী’র এক সময়ের জুড়ির দলের তবলাবাদক, অভিনেতা অধ্যাপক অপূর্ব সাহা একটু আগে স্মৃতিভেজা স্বরে আমায় বলল, ‘‘জানো, দিদির এক দিন মহলায় আসতে দেরি হয়েছে। তাও নিজের জন্য নয়। দিদি এসে দু’কান ধরে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দুবার হাঁটলেন।’’
নাট্যকার, অভিনেতা মণীশ মিত্র লিখছেন, ‘জীবনে প্রথম একটা নাটক পড়ে শোনাতে গিয়েছি ওঁকে। ঠিক আমার পড়ার উপযোগী করে সাজিয়ে রাখা একটি টেবিল। তাতে টেবিল ল্যাম্প। জলের গেলাসে জল। যেন এক পাথরের প্রতিমা স্থির হয়ে শুনছেন এক নতুন লেখা নাটক। আবার নন্দীগ্রামে গাড়ি যাওয়ার পথে বাধা। এক মুহূর্ত ভেবেই শাঁওলিদি উঠে বসলেন এক জনের বাইকের পেছনে।’
ভিন্ন প্রতিভা, নিখুঁত অভিনয়, শিক্ষা, অপরিসীম শ্রম ,গভীর সংযম , তীব্র শৃঙ্খলা, এই সব কিছুর বাইরে এক শাঁওলি মিত্র ছিলেন। একক। একা।
সে কি বারে বারে খুব নিজস্ব পরিসরে বিশ্বাস নিয়ে গড়া সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায়? সে কি গভীর সংবেদনশীল একটি মানবীর চোখে অপ্রত্যাশিত অপ্রেমকে পার করতে হওয়ায়?
কম্পিউটার খুলে বসেছি। শাঁওলিদির শেষ ই-মেল। কেয়া চক্রবর্তী বিষয়ক একটি লেখা। আমাদের নাটকের দলের পত্রিকার জন্য। অনেক না বলা কথার মধ্যে উঠে আসছে ওঁর ভালবাসার, কেয়াদির ‘অপমানিত মুখখানি’।
বাবার মতোই শেষ ইচ্ছাপত্রে নির্লিপ্ত, নিভৃত বিদায়ের অঙ্গীকার করে রেখেছিলেন মেয়ে। যাঁর অভিনয় বন্ধ করার জন্য এক সময় প্রেক্ষাগৃহে কোলাহল করার জন্য লোক ঢুকিয়ে দেওয়া হত, যিনি মূল মঞ্চ থেকে দূরে দর্শকের দানের বিনিময়ে অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন, তাঁকে নিয়ে কত সামান্য জনকে অসম্মানকর মন্তব্য করতে শুনেছি।
তিনি আজ সব গানস্যালুটকে নম্র আভিজাত্যে দূরে রেখে একা চললেন তাঁর রাজার কাছে। রানি সুদর্শনার মতো?
সেই রানি, যে রানি কিন্তু তথাকথিত রানি নয়!
প্রণাম।