অসামান্য অভিনয়ে সৌমিত্র ফুটিয়ে তোলেন বিশ্বনাথের অপ্রতিভ অসহায়তা, লুকোনো ঈর্ষা ও দুঃখ, এবং গভীর প্রেমে সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এই ভাবনায়, যদি ওই অতীন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি যাওয়া যায় ওই সুদূর ফরিদপুরের গ্রামখানিতে, বাল্যের স্মৃতিপথে আরতি বর্তমানে ফিরে আসতেও তো পারে।
মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে যাওয়া হল। সপরিবার। দেখা হল সেই অতীন্দ্রদার সঙ্গে। সেই পুকুর, যেখানে মাছের চার ফেলে বলা হতো, মাছের পোনা আইসো, মাছের পোনা যাইয়ো না।
আরতি চরিত্রে স্বাতীলেখা সরল বাল্যে অনবদ্য ফিরে যান। যে বড় জামাই অতীন্দ্রদা ও শাশুড়ি সম্পর্কে সামান্য সন্দিহান ছিল, সে, অন্যদের সঙ্গে উপলব্ধি করে, ওই দেশের বাড়ি, উঠোন, মাছ ধরা, নৌকার গান,শান্ত জল আর সুদর্শন বরের অপেক্ষায় থাকা বালিকার চিরমধুর সম্পর্ক শুধু অতীন্দ্রদা নয়, সেই কালখণ্ড, সেই গন্ধ, শব্দ, স্বপ্ন, সত্তা, সমস্তটুকুর সঙ্গে। জীবনের এক সরল, মিঠে, ঝিকিমিকি আনন্দময় সময়ের সঙ্গে বাকি জীবনের অবিচ্ছেদ্য প্রেম, যার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না স্মৃতিগ্রাসী সুকঠোর স্নায়ুরোগ। প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়েই কি থাকে না এমন এক আগলে রাখা বেলা? যে কোনও সময়েই কি তার আশ্রয়ে চলে যেতে চায় না ব্যথাতুর, যন্ত্রণাবিধুর, ক্লান্ত হৃদয়?
জীবনের শেষবেলায় আরতি মাতেন ব্যাখ্যাতীত স্বপ্নিল স্মরণ ও বোধাতীত বিস্মরণের লীলায়। বড় জামাইকে তিনি গুলিয়ে ফেলেন যা নয় তাই, অথচ বিচ্ছেদ নিয়ে যাওয়া পুত্রবধূকে কাছে পেতে চান। বিশ্বনাথ শুরু করেন এমন এক প্রেমাবিষ্ট দায়িত্ববোধপূর্ণ জীবন, যেখানে সব দেওয়া-নেওয়া, সব স্বার্থ জলবিন্দুতে বিলীন। প্রেমের এই নিঃস্বার্থ আবহ চেতনায় ধরা দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই গানের সুরে সুরে, যেখানে বলা আছে “হৃদয় আমার চায় যে দিতে, কেবল নিতে নয়,” অথবা, প্রেমের অন্যতর চেতনার ধারক যে মেজজামাই, যে তার সমকামিতার কারণে বিবাহিতা স্ত্রী মিলির সঙ্গে নানাবিধ সংঘাতের পর এক সময়ে যৌথ ভাবে এই উপলব্ধিতে পৌঁছয়, দাম্পত্যর ভিতর যৌনতার বাইরেও আছে এক অমূল্য অর্থ। জগতে সেগুলি সুলভ নয়, সেই সব হল বিশ্বাস, নির্ভরতা ও বন্ধুত্ব। এই বোধ তার হাতে বাজিয়ে তোলে সেই সুর, “রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে”।
আরতির ভুলে যাওয়ার রোগ এই চলচ্চিত্রে গভীর বিশ্লেষণাত্মক। আগাগোড়া উদ্বেগ তৈরি না করে মাঝে মাঝে তা হাসি ও সরসতা রচনা করে। বড় মেয়ে ও জামাই, অভিনয়ে অপরাজিতা আঢ্য ও খরাজ মুখোপাধ্যায়, যাদের সম্পর্ক সরল ও নির্ঝঞ্ঝাট, এই সরসতার বাহক। মেজো মেয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনয়ে সুপরিমিত ও সুপরিণত। সার্বিক ভাবে, সৌমিত্র ও স্বাতীলেখার অভিনয় ছাড়াও অন্য চরিত্রগুলিতে অভিনয়গুণ এই সিনেমার এক সম্পদ। বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত কুশীলবের সঙ্গে সম মাত্রায় একেবারে ঝরঝরে অভিনয় করেছেন ছোটমেয়ে ও জামাইয়ের ভূমিকায় মনামী ঘোষ ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
রবি ঠাকুরের দু'টি গানের সুর ছাড়াও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং অনুপম রায়ের রচিত ও গীত সঙ্গীতগুলি মন-কাড়া। আরতির দেশের বাড়িতে, নৌকায় বসে গান গায় এক বালক, ক্যামেরা তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপ্ত করে বাংলার শ্যামল সজল রূপ। সেই গানখানি বাংলার চালচিত্র রচনা করে যায়।
মেধাবী গল্প, টানটান সংলাপ, বিষয়, দৃশ্য, গান, অভিনয়, সব মিলিয়ে 'বেলাশুরু’ সমাদৃত হওয়ার যোগ্য, এই পরিচালকদ্বয়ের আরও অনেক ছবির মতোই।
বিশেষত উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর শেষ অভিনয়ের ধারক। এই দুই নক্ষত্রবিহীন অভিনয়ের বেলাও বাংলার নাট্য ও চলচ্চিত্রাভিনয়ের জগতে শুরু হল এই বেলা।