Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Saswata Chatterjee

Review of Tokhon Kuasha Chilo: সৌমিত্রের ছত্রছায়ায়, শাশ্বতর নেতৃত্বে যেন রাজনৈতিক আয়নার কাজ করে গেল ‘তখন কুয়াশা ছিল’

ভাল আর খারাপের দ্বন্দ্ব এখানে আর নেই, বরং ‘বেশি খারাপ’ আর ‘কম খারাপ’-এর দৌড়ই এখানে চিরকালের। ‘তখন কুয়াশা ছিল’ আক্ষরিক অর্থে একটা রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি বললে ভুল হবে না।

ফ্যাসিজমকে বাড়তে দেখে মুক্তমনার তীব্র বিহ্বলতার প্রতিচ্ছবিই যেন পাওয়া যায় ‘তখন কুয়াশা ছিল’-তে।

ফ্যাসিজমকে বাড়তে দেখে মুক্তমনার তীব্র বিহ্বলতার প্রতিচ্ছবিই যেন পাওয়া যায় ‘তখন কুয়াশা ছিল’-তে।

শ্রয়ণ চন্দ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২১ ১৫:৩৮
Share: Save:

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক। প্রুশিয়া-অস্ট্রিয়ার যুদ্ধের রেশ অনুভব করছে গোটা ইউরোপ। ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, রাশিয়া, আর প্রুশিয়া জুড়ে তখন ইউরোপীয় আধিপত্যের হাতছানি। অস্ট্রো-প্রুশিয়া যুদ্ধের শেষ বড় যুদ্ধ কনিগগ্রাটজ়ের যুদ্ধে হার হয় অস্ট্রিয়ার। সেই যুদ্ধ জয়ের স্মরণে একটি সুর লিখেছিলেন জোহান গটফ্রেইড পিফকে। পরবর্তীকালে জার্মান সেনার মার্চিং সঙ্গীত হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই সুর। জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা থেকে শুরু করে সঙ্গীত, থিয়েটার, সব কিছুতেই একটা তীব্র নাৎসি গন্ধ পাওয়া যায় । ‘ডের কনিগগ্রাটজ়ের মার্শ’ আদতে নাৎসিদের সৃষ্টি না হলেও, নাৎসিদের মার্চিং সঙ্গীত হিসেবে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই সময়ে।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ফ্যাসিজমের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, উঠছে, উঠবে চিরকাল। কিন্তু তবুও, কোথাও গিয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বের ইংরেজ-মার্কিন ইতিহাসের পক্ষপাতিত্বের ফলে হোক, বা ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার আরেকটি প্রভাব হোক– ফ্যাসিজম বলতে যার মুখ বারবার দেখা যায় ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে, সে অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার-পরবর্তী বিশ্বে যে কোনও ফ্যাসিস্ট শাসকের স্বৈরাচারকে তুলোধনা করার সময় তর্কে, আলোচনায়, শিল্পে, রাজনীতিতে বারবার ফিরে এসেছে হিটলার।

কিন্তু স্বৈরাচার বহুরূপী, বহুমাত্রিক, অনেক সময়েই তাকে চেনা যায় না। একবিংশ শতাব্দীর ক্রমাগত ভাঙতে থাকা এই পৃথিবীতে, যেখানে প্রতি পদে অসহিষ্ণুতা, জগৎ জুড়ে একের পর এক মানবিকতার স্খলনের দৃষ্টান্ত, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত রাজনৈতিক চক্র বিভিন্ন ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিভিন্ন প্রান্তে–

এই চরম দুর্যোগের মুহূর্তগুলো বিহ্বল করে দিতে পারে যে কোনও মুক্তমনা মানুষকে।

সেই ফ্যাসিজমকে বাড়তে দেখার তীব্র বিহ্বলতার প্রতিচ্ছবিই যেন পাওয়া যায় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উপন্যাস অবলম্বনে শৈবাল মিত্রের ছবি ‘তখন কুয়াশা ছিল’-তে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই দু’ ঘন্টা তেরো মিনিটের আখ্যান অনেক সময়েই মনে হয় যেন একাধিক অনুভূতির তোলপাড় করা সংমিশ্রণ। আমাদের ভাবতে শেখায়। এনে দাঁড় করিয়ে দেয় বাস্তবের সামনে। সেখানে খানিক বিহ্বলতা, খানিক অস্থিরতা, খানিক দুঃখ, রাগ, আবার খানিক বিরক্তিও সামিল।

‘পুটু’র বিভিন্ন স্তরের অনুভূতিকে অনায়াসে ফুটিয়েছেন শাশ্বত।

‘পুটু’র বিভিন্ন স্তরের অনুভূতিকে অনায়াসে ফুটিয়েছেন শাশ্বত।

গল্পের প্রেক্ষাপট বেগমপুর, যেখানে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবাই সন্ত্রাসের ভয়ে গুটিয়ে আছে বাড়ির মধ্যে। ভয়ের মধ্যে দিন কাটান অখিলবন্ধু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। ‘মাস্টারমশাই’ ‘অখিল’-এর সঙ্গে থাকে তাঁর নাতনি ‘মৌ’ (বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়)। অখিলের এক ছাত্র ‘পুটু’ (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)। ‘পুটু’ এক সময়ে রাজনীতি করলেও, সেখানকার মতাদর্শের শিরদাঁড়ার অনিশ্চয়তা তার রাজনীতির প্রতি ভালবাসার ছন্দপতন ঘটিয়েছে। এখন সে চাকরি খুঁজে বেড়ায়। আর এক ছাত্র ‘শচীন’ (বরুণ চক্রবর্তী), ‘গলা-কাটা-শচীন’-এর নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায় বেগমপুরে। গুন্ডা, খুনি হলেও বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে। ‘অখিলবাবু’র নাতনিকে বিয়ে করতে চায় ‘শচীন’, ভীত সন্ত্রস্ত দাদু তাই নাতনিকে বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নেন ‘পুটু’র, যে নিজে আবার ‘মৌ’কে ভালবাসে। কিন্তু এ দিকে ‘শচীন’-এর ত্রাসে তখন গোটা বেগমপুর ত্রস্ত। আসে নির্বাচন, দল বদলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এই ছবি দর্শকদেরও যেন চেনা। আক্ষরিক অর্থেই চেনা প্রেক্ষাপটে এগোতে থাকে গল্প। ছবির রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থান নিয়ে কোনওরকম আপসের দিকে যাননি পরিচালক। বেগমপুরের টালমাটাল পরিস্থিতি, স্বৈরাচারকে মধ্যমণি করে ক্রমাগত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ফেটে পড়া মফস্সলের রাজনীতি দেখাতে গিয়ে একাধিক বার নাৎসি জার্মানির ফুটেজ ব্যবহার করেছেন শৈবাল মিত্র। এক দল আরেক দলের সঙ্গে নির্বাচনে লড়ে ঠিকই, কিন্তু নিজেদের অজান্তেই ধ্বংস হয়ে যায় সাধারণ মানুষ। কখন তারা এই চক্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে, সেইটা বোঝার আগেই তাদের বেরোনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ‘তখন কুয়াশা ছিল’ আক্ষরিক অর্থে একটা রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি বললে ভুল হবে না। ভাল আর খারাপের দ্বন্দ্ব এখানে আর নেই, বরং ‘বেশি খারাপ’ আর ‘কম খারাপ’-এর দৌড়ই এখানে চিরকালের। চরিত্রদের মধ্যেই সেই একই অদ্ভুত দ্বন্দ্বের ছাপ। এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এমন সাহসী এবং সচেতন সামঞ্জস্য রাখার জন্য কুর্নিশ শৈবাল মিত্রকে।

পৃথিবীর স্বৈরাচার এবং স্বৈরাচার-বিরোধী সঙ্গীতের এমন সুচারু ব্যবহার কোনও কোনও দৃশ্যের মূল্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘পুটু’-কে কেন্দ্র করে ‘ডের কনিগগ্রাটজ়ের মার্শ’-এর ব্যবহার বেশ কিছু জায়গায় অন্য মাত্রা দিয়েছে ‘পুটু’র চরিত্রকে। সিনেমা জুড়ে বারবার নানা রূপে বেজেছে ‘বেলা চাও’, যার প্রতিবাদী সত্ত্বা নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে কারও মনে কোনও প্রশ্ন না ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই সঙ্গীতের বাড়তি ব্যবহার এক একটি দৃশ্যকে বেশি মেলোড্রামার দিকে ঠেলে দিয়েছে কী না, সেই বিষয়ে দর্শকের মনে ধন্দ জাগতেই পারে। ক্যামেরার কাজ কিছু কিছু জায়গায় এক কথায় অসাধারণ, বিশেষ করে কম আলোর দৃশ্যে ক্যামেরার কাজ যে কোনও দর্শককে অভিভূত করতে পারে। কিন্তু হাতে ধরা ক্যামেরার কাজগুলো এক এক জায়গায় দৃশ্যকে আরও অনেক বেশি কাছের করে তুলেছে। মদ্যপ ‘শচীন’-এর ‘কমন ম্যান’ হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশের দৃশ্যতে ক্যামেরাকে হাতে ধরা, এবং দৃশ্যত সেই অস্থিরতার ছবি মনের মধ্যে যেন সেই অনুভূতিকে গেঁথে দিয়েছে।

একদিকে বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অন্যদিকে ছোট পরিধিতেও নজর কাড়লেন বাসবদত্তা।

একদিকে বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অন্যদিকে ছোট পরিধিতেও নজর কাড়লেন বাসবদত্তা।

এই ছবিতে অনেকটা জায়গা পেয়েছেন শাশ্বত। প্রথমে খানিকটা অলস, নিজের মতো থাকতে চাওয়া, চাকরির জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ানো যুবক, তারপর শচীনের আতঙ্কে এবং মৌয়ের প্রতি ভালবাসার টানের দ্যোতনায় বিহ্বল প্রেমিক, ধীরে ধীরে মিষ্টি ভালমানুষ থেকে ভাল মন্দ মেশানো রক্তমাংসের মানুষ হয়ে ওঠার যাত্রা— এই সবকিছু ‘পুটু’র মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন শাশ্বত।
অন্য দিকে ছবিতে বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিছু কিছু দৃশ্যে তাঁকে দেখে এবং তাঁর কথা শুনে অতিরিক্ত বয়স্ক আর ক্লান্ত মনে হলেও, তা একেবারেই আপেক্ষিক। অতটা জায়গা না পেলেও, সীমিত পরিধিতে ‘মৌ’-এর চরিত্রে অনায়াসেই অভিনয় করে গেলেন বাসবদত্তা। ছোট চরিত্রে যথাযথ লেগেছে অঙ্কিতা মজুমদার, অরুণ গুহঠাকুরতা, মায়া ঘোষ, পারমিতা মুখোপাধ্যায়কে। কোথাও গিয়ে বরুণ চক্রবর্তীর ‘শচীন’কে একটু যেন আড়ালে রেখে দিলেন পরিচালক। তাঁর চরিত্রকে ঘিরে যেই ত্রাসের সৃষ্টি করলেন, সেই অনুযায়ী তাঁকে অত বেশি জায়গা দেননি তিনি। সেই একই চিরাচরিত ভিলেন হয়েও আবেগের জায়গা থেকে একটা দৃশ্যে দেখানো ছাড়া, একটু যেন আড়ালেই থেকে গেল শচীনের চরিত্রটা।

যখন দেশের মধ্যে স্বৈরাচার জাঁকিয়ে বসে, তখন তার ছাপ শিল্পের উপর পড়তে বাধ্য। জন্ম নেয় একের পর এক সরকার বিরোধী, স্বৈরাচার বিরোধী গান, নাটক, সিনেমা। বাংলা সিনেমায় সেই মতাদর্শের ছবি ইদানিং কালে খুব একটা হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। কিন্তু নাটক হয়েছে অনেক। কিছুটা এখনকার রাজনৈতিক নাটকের সেই একই ধাঁচের ছক পাওয়া গেল এইখানেও।

এছাড়াও, নারীর সঙ্গে দেশমাতৃকার সমান্তরাল তৈরি করার সেই চিরপরিচিত ঢঙে দেখানো কোথাও গিয়ে ক্লান্তিকর মনে হতে পারে। দেশ ‘নষ্ট’ হয়ে গিয়েছে দেখানোর জন্য তার সঙ্গে মৌ-এর চরিত্রকে ‘নষ্ট’ বলে বর্ণনা করার প্রয়োজন ছিল কী? এই প্রশ্নটা হয়তো থেকে যাবে। কিন্তু সমস্যা থাকলেও, আজকের দিনের রাজনৈতিক চিত্রটাকে এতটা সততার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এখনকার বাংলার রাজনীতির দিক থেকে কেমন যেন একটা আয়নার কাজ করে গেল ‘তখন কুয়াশা ছিল’। একদিকে প্রতিবাদের আকাঙ্খা, অন্যদিকে ক্ষমতার আসনকে মাঝখানে রেখে সাধারণ মানুষকে দিয়ে তাসের দেশের ঘুঁটি সাজানো– ‘গণতন্ত্র!’ ‘গণতন্ত্র!’ বলে চিৎকার করে ‘পুটু’র সামনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়া মদ্যপ রাজনৈতিক কর্মীটিও বোধহয় পরিহাস করছে আজকের এই পৃথিবীকে। হয়তো এটাই ভবিতব্য ছিল। ইতিহাসে স্রোতের পর স্রোত আসে, জোয়ার ভাঁটা খেলা করে ক্রমাগত। এটা হয়তো তেমনই একটা জোয়ার, বা ভাঁটা– যে যেমন ইচ্ছে নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করে নিতে পারে, ঠিক যেমনটা রেখে দিয়েছেন শৈবাল মিত্র ‘তখন কুয়াশা ছিল’-এর শেষ ফ্রেমে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE