Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Sandhya Mukhopadhyay

Sandhya Mukherjee: সন্ধ্যাদি আজীবন ‘সবার উপরে’, শেষ বয়সে কি এ সবের দরকার ছিল? প্রশ্নে শ্রাবন্তী মজুমদার

অবাক হয়েছিলাম, বাঙালি সত্যি এতটাই নীচে নেমে গিয়েছে! ওঁকে কটাক্ষ করছে ফেসবুকে?

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কলম ধরলেন শ্রাবন্তী মজুমদার।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কলম ধরলেন শ্রাবন্তী মজুমদার।

শ্রাবন্তী মজুমদার
শ্রাবন্তী মজুমদার
ডগলাস, আমেরিকা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫৩
Share: Save:

আমি সুদূর আইল অব ম্যান-এ। আমার অসুস্থ ‘মা’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কলকাতায়। আচমকাই মঙ্গলবার শুনলাম, তিনি নেই! অসংখ্য গুণমুগ্ধ শ্রোতার কথায়, স্বর্ণযুগ সত্যিই শেষ হল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি। আবার মাতৃহারা হলাম? গানে গানে কাকে বলব, ‘তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে?’ মা-ও আদর করে জবাব ফিরিয়ে দেবেন আমায়, ‘ওরে আমার মেয়্‌ আমার মিষ্টি সোনা মেয়ে...’। কিছুদিন আগেই হারিয়েছি খুব কাছের বন্ধু শাঁওলি মিত্রকে। তার পরেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বুধবার সকালে বাপ্পি লাহিড়ি। তার ৯ দিন আগে লতা মঙ্গেশকর। নিজের দেশে একের পর এক ইন্দ্রপতন। এত দূরে বসে আছি যে দৌড়ে যাব, তারও উপায় নেই। আমার কষ্টের কথা বলি কাকে?

আরও একটা বড় কষ্ট, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন কোভিডে। শুনেছি, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বাপ্পিদাও একই সংক্রমণে ভুগেছেন। আমাদের দেশের গুণীজনেরা কী ভাবে অতিমারির বলি হচ্ছেন! অথচ এখন আমি যেখানে থাকি সেখানকার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা কিন্তু যথেষ্ট নিরাপদ। তাঁরা কিন্তু কোভিডে চলে যাচ্ছেন না। এটা কি তা হলে আমাদের দেশের ব্যর্থতা?

গতকাল থেকে পুরনো দিনগুলো বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি তখন গান শিখতে যাই ওস্তাদ মুনাব্বর আলি খান সাহেবের কাছে। সন্ধ্যাদি ওই ঘরানার শিষ্যা। আমার ওস্তাদজির বাবা ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সাহেবের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। সেই অনুযায়ী, ওঁরা পরস্পর গুরু ভাই-বোন। আমিও ওঁর গুরুবোন। সেখানেই স্বর্ণকণ্ঠীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। বছর গড়িয়েছে। সেই আলাপ, সেই বাঁধন আরও পোক্ত হয়েছে। সারাক্ষণ আমায় আগলাতেন। কত পরামর্শ! আমি যেন ঠিকমতো রেওয়াজ করি। কী ভাবে গান গাওয়া উচিত। অনুষ্ঠানের সূত্রে বেশি কথা বললে রীতিমতো বকতেন! বলতেন, ‘‘গলা খারাপ হয়ে যাবে তো।’’ নিজেও গলার জন্য টক জাতীয় খাবার, দই, ঠান্ডা খাবার খেতেন না। ঘড়ির কাঁটা ধরে উঠতেন বসতেন। পই পই নির্দেশ ছিল, বিদেশে চলে গিয়েছি বলে যেন রেওয়াজ না ছাড়ি। সুন্দর করে চিঠি লিখেছিলেন। কলকাতায় গেলে দেখাও হত আমাদের। শ্যামলদা যখন চলে গেলেন, তখনও আমি কলকাতায়। খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলাম।

আমার মুষড়ে পড়ার পিছনে আরও একটি কারণ আছে। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে সন্ধ্যাদিকে পদ্মশ্রী দেওয়ার কথা ঘোষণা হয়েছিল। এবং দিদি তা প্রত্যাখ্যানও করেছিলেন। সে খবর পাওয়ার পরেই আমি ওঁকে ফোন করেছিলাম। ফোনটা বেজে গেল। দিদির গলা শুনতে পেলাম না। পরে জানলাম, ততক্ষণে দিদি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সেই যে যোগাযোগ ছিঁড়ল, একেবারেই তা ছিন্ন হয়ে গেল! আমার মায়ের বয়সি। দিদি বলে ডাকলেও আদতে উনি আমার মা ছিলেন। তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। খারাপ লেগেছিল, পদ্মশ্রী সম্মান এবং ওঁকে জড়িয়ে ফেসবুকে নানা কটাক্ষ। অবাক হয়েছিলাম, বাঙালি সত্যি এতটাই নীচে নেমে গিয়েছে! ওঁকে কটাক্ষ করছে ফেসবুকে? আগামী ১০০ বছরেও ওঁর সমান কেউ হতে পারবেন! আমার অন্তত মনে হয় না। পদ্মশ্রী দিয়ে কেউ কোনও দিন ছোটও করতে পারবে না। কেউ কোনও দিন বড়ও করতে পারবে না ওঁকে। কারণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আজীবন ‘সবার উপরে’।


কাছ থেকে দেখার সুবাদে ব্যক্তি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কেও খুব ভাল করেই চিনি। মুখে হাসি। নীচু গলায় সবার সঙ্গে কথা বলতেন। ভীষণ আন্তরিক। মাটির কাছাকাছি বাস। খুব ফুল ভালবাসতেন। এমন একজনকেও কটূক্তি করতে কারও বাধেনি! অথচ বাঙালির মননে এমন একটাও গান নেই, যে গানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নেই! সেই তালিকায় থাকবে আমাদের গাওয়া ‘তুমি আমার মা’ গানটিও।


১৯৮০ সাল আমার কাছে ঘটনাবহুল। ওই বছর আমার প্রথম লং প্লেয়িং রেকর্ড প্রকাশিত হয়। তারপর প্রকাশিত হয় পুজোর গান। ‘আয় খুকু আয়’-এর মতোই ‘তুমি আমার মা’ গানটিও আমার রেকর্ডের গান। গানটি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। পরিমল দাশগুপ্তের সুর। ‘আয় খুকু আয়’-এর পরে পুলকদাকে অনুরোধ করেছিলাম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যেমন বাবা-মেয়ের গান করেছিলাম তেমনই এবার মা-মেয়ের গান হোক। গাইব সন্ধ্যাদির সঙ্গে। শোনামাত্র পুলকদা গান লিখে ফেললেন। তার পরেই যোগাযোগ করলাম শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে। শ্যামলদা এক দিন সময় নিয়ে জানালেন, ‘‘হ্যাঁ, সন্ধ্যা গাইবে।’’ বাকিটা ইতিহাস।

বিশাল বড় গান। গোটা একটা দিন কেটে রাত গড়িয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ধৈর্য দেখার মতো। নিজে গেয়েছেন। আমায় আগলেছিলেন, যাতে আমি ভয় না পাই। এদিকে আমার হাত-পা ঠান্ডা! আমি ওঁর মতো গায়িকার সঙ্গে গাইছি। গান শেষ হতেই পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেছিলেন। কত আদর, কত প্রশংসা।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাওয়া আমার দুটো গান নিয়ে গল্পও প্রচুর। অনেকেই বলেন, গান দুটো নাকি যথাক্রমে রাণু আর ঝিনুকের গাওয়ার কথা ছিল। ওঁরা নাকি গাইতে চেয়েছিলেন। পুরোটাই কিন্তু রটনা। গান দুটো আমার জন্য তৈরি হয়েছিল। রাণুকে নাকি গাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। পরে আমার গান শুনে রাণু বলেছিলেন, ‘‘তুমি এত সুন্দর করে গেয়েছ যে শুনে মনে হচ্ছ্‌ আমিই গাইলে পারতাম।’’ একই ভাবে পরে নানা অনুষ্ঠানে সন্ধ্যাদির সঙ্গে গানটি গেয়েছে ঝিনুক। তখনও শ্যামলদা বলেছিলেন, শ্রাবন্তী তোমার গান আমার মেয়ে গাইছে। আমার জবাব ছিল, ‘‘মায়ের সঙ্গে মেয়ে মিলে ‘মা-মেয়ে’র গান গাইছে। এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sandhya Mukhopadhyay Singer Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE