খুব সুন্দর ফুলের মালা গাঁথতে পারতেন জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়। আবৃত্তিতেও পারদর্শী ছিলেন। জয়শ্রীর গলায় ‘দেবতার গ্রাস’ শুনে চোখে জল আসত তাঁর ঠাকুরমার। উচ্চারণও স্পষ্ট। এই গল্পটি যত এগোবে, ততই জীবন্ত হয়ে উঠবে রবিঠাকুরের সেই পংক্তি, ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা’। দৈন্যদশা ঘোচাতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম গুণও আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর জীবনে। আজ তিনি ধারাবাহিকে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন। বিখ্যাত মুখ বলা যায় না। যে দিন শ্যুট থাকে, সে দিন টাকা। আর নয় তো সেই জমানো টাকা দিয়ে নিজের একার সংসার চালান অভিনেত্রী। দৈন্য কাটেনি। ৭০-এ এসেও লড়াই শেষ হয়নি। কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে খুশি জয়শ্রী। অভিনয়ের সুযোগ পেলেই আনন্দে থাকেন। আর এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অভিনয় জগতের সঙ্গে জড়িয়ে জীবন গড়ার গল্প শোনালেন তিনি।
১৯৫০-এ জন্ম জয়শ্রীর। পাইকপাড়ায় একান্নবর্তী পরিবারে। কিন্তু পারিবারিক সমস্যায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয় জয়শ্রীর পরিবারকে। এক দিন ট্রেনে করে বাড়ি ফেরার সময়ে দুর্ঘটনায় হাত-পা অচল হয়ে পড়ে বাবার। জয়শ্রী তখন ১৩। তাঁর পরে আরও ৪ ভাই-বোন। গোটা সংসারের ভার তাঁর কাঁধে আসে। পড়াশোনা থেমে যায়। কিন্তু কী করে খিদের জ্বালা মেটানো যায়? ফুলের মালা গাঁথতে বসলেন হীরা। জয়শ্রীর ডাকনাম। দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাজারে বসে মালা বিক্রি করে যা পেতেন, তা দিয়ে আধপেট খাওয়া হত পরিবারের। এক পাউন্ড পাঁউরুটিতে ৬ জনের রাতের খাওয়া। একটু জল আর চিনি মিশিয়ে নিতেন। মাঝেমাঝে রেশন কার্ডে ভাঙা গমের আধখানা পাওয়া যেত। তা দিয়ে আলু সিদ্ধ করে ভুরিভোজ হত কখনও। আর নয়তো মাঝে মধ্যে শাক তুলে সিদ্ধ করে খাওয়া।
ইতিমধ্যে পাইকপাড়ায় থাকাকালীন টুকটাক আবৃত্তির অনুষ্ঠান করে নাম করেছিলেন ছোট্ট জয়শ্রী। এক দিন এক নাট্য পরিচালক তাঁকে দেখতে পান মালা বিক্রি করতে। বলেন, ‘‘তুমি সেই অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছিলে না? রাস্তার ধারে মালা বিক্রি করতে হচ্ছে তোমাকে!’’ তাঁর অবস্থার কথা জানতে পারেন পরিচালক। সুভাষনগরে একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে ‘উত্তরা’ নাটক মঞ্চস্থ হবে বলে জানালেন পরিচালক। নায়িকার চরিত্রের জন্য ডাকা হয় জয়শ্রীকে। তাঁর অভিনয় দেখে পরিচালক বলতেন, ‘তুই এক দিন খুব বড় অভিনেত্রী হবি।’ প্রথম মঞ্চায়নের পরে ১০ টাকা ও এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছিলেন জয়শ্রী।