মাধুরী দীক্ষিত
এ যেন বলিউডের তিন দিনের দুর্গাপুজো।
পুজোর মতো বাইরে থেকে লোক আসা রয়েছে। রয়েছে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ। রয়েছে রাত অবধি আড্ডা, দেদার খানা-পিনা। আছে মধ্যরাতে লং ড্রাইভ। আর সঙ্গে লেটেস্ট সব ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
রয়েছে পুরনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া (এক সময় অমিতাভ বচ্চন ছিলেন আইফা-র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, আজকে আইফা-র ত্রিসীমানায় তিনি নেই)। রয়েছে নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হওয়া (যেমন, শাহিদ কপূর আর ফারহান আখতার, যাঁরা এ বারের আইফা-র মূল অনুষ্ঠানের হোস্ট)। বাড়ির বড় দাদার মতো রয়েছেন অনিল কপূর, যিনি একাই চারদিক সামলাচ্ছেন। আর রয়েছে বাড়ির ‘হাই প্রোফাইল’ মেয়েকে নিয়ে সবার আগ্রহ। যেমন, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া। আইফা-র সব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি তিনি।
তবে অন্য দুর্গাপুজোর সঙ্গে এই পুজোর তফাৎ একটাই। পৃথিবীর কোনও এক শহরে সীমাবদ্ধ নয় এই দুর্গাপুজো। কখনও তা সিঙ্গাপুরে। কখনও টরোন্টোয়। তো কখনও আমস্টারডামে।
প্রথমবার এই বলিউডের দুর্গা উৎসব ‘আইফা’ হচ্ছে মার্কিন মূলুকে। ফ্লোরিডার ট্যাম্পা বে শহরে। যেখান থেকে গাড়িতে মায়ামি যেতে লাগে চার ঘণ্টা, আর নিউ ইয়র্ক থেকে প্লেনে আড়াই ঘণ্টা। আর হ্যাঁ, এই বছর ১৫তম আইফা-তে রয়েছে আনন্দplus-ও। এই অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার হয়ে।
চেক ইন কাউন্টারে মাধুরী, শ্রীদেবী আর হৃত্বিক
তবে এই দুর্গাপুজোর শুরু কিন্তু যে শহরে হচ্ছে, সেখানে পৌঁছনোর পর থেকেই শুরু হয় না। শুরু হয় মুম্বইয়ের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেই। এ বার যেমন তার যাত্রা শুরু হল মুম্বইয়ের নতুন চোখ ধাঁধানো টার্মিনাল থেকে।
একে একে তাঁরা এয়ারপোর্টে পৌঁছচ্ছেন। চেক ইন কাউন্টারের সামনে কখনও শ্রীদেবী, কখনও করিনা কপূর তো কখনও হৃত্বিক রোশন। শুধু বড় বড় তারকাই নন, রয়েছেন রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা আর রাজু হিরানির মতো পরিচালক। রয়েছেন প্রসুন যোশীর মতো গীতিকার। সেই সঙ্গেই সোনাক্ষী সিংহ আর বিপাশাও। সবাই চলেছেন ট্যাম্পা।
এ বারে আসার সময় এয়ারপোর্টে যেমন দেখা হল সঙ্গীত পরিচালক প্রীতমের সঙ্গে। “এখন আর তিন-চারদিন কোনও কাজ নেই। চলো ট্যাম্পা,” একগাল হেসে বললেন প্রীতম।
বাবা প্রকাশ পাড়ুকোনকে নিয়ে শপিং মলে দীপিকা
অত বড় এয়ারপোর্টে যদি স্টারদের খুঁজে বার করতে অসুবিধে হয়, প্লেনে সেই অসুবিধে নেই। তারাদের কেউ কেউ ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। তিরিশ ঘণ্টা তো প্লেনেই কাটাতে হবে! কেউ বা পরিচালকের কাছে শুনে নিচ্ছেন নতুন ছবির চিত্রনাট্য। অন্যদিকে এটা আবার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সেরা সময়। যেমন? যেমন, দীপিকা পাড়ুকোন। বাবা প্রকাশ পাড়ুকোন ও মাকে নিয়ে দীপিকা হাজির আমেরিকায়। কখনও তাঁরা শপিং মলে, আবার কখনো একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট সারছেন। হাজির হর্ষ নেওটিয়া। বিদেশে ছুটি কাটানোর ফাঁকে আইফা-র ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য এখানে। সে দিন দেখলাম ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী মধু নেওটিয়ার সঙ্গে হাঁটছেন।
বলিউডের এই দুর্গাপুজোয় আমেরিকাতেও অবশ্যই আছে পাগলামি। না হলে, রাত সাড়ে বারোটায় সময় আমেরিকার এক পুলিশ হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন? “সকাল থেকে ডিউটি করছি। দেখুন না মেয়ের জন্য যদি হৃত্বিকের একটা অটোগ্রাফ পাওয়া যায়,” অনুরোধ সেই পুলিশের।
বলিউডকে কেন্দ্র করে এ রকম ব্যবসা আর গ্ল্যামারের ককটেল বোধহয় দু’টো নেই পৃথিবীতে।
তবে এ বার আইফাতে কিন্তু শুরু থেকে রয়েছে নানা বিতর্ক। বুধবার সন্ধ্যেবেলা এখানে পৌঁছোনোর পর থেকেই দেখি হিলটনের লবি যেন থমথমে। সে দিনই ছিল মুম্বইতে ভোট। মুম্বইতে ভোট না দিয়ে যে স্টারেরা আইফাতে এসেছেন তাঁদের নিয়ে চলছেই বিতর্ক। এ বার যেমন হল শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার বা অনুপম খেরকে নিয়ে। বিতর্ক এতটাই দানা বেঁধেছিল যে হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে জাভেদ আখতার আনন্দplus-কে বললেন, “আমি লজ্জিত ভোট দিতে পারিনি বলে। কিন্তু আমার আর শাবানার কোনও উপায় ছিল না। প্রায় সাত-আট মাস আগে থেকে আমাদের ডেট দেওয়া ছিল আইফাকে,” বললেন জাভেদ আখতার। বোঝা যায় ট্যাম্পাতে আইফা শুরু হওয়ার আগেই ধিকি ধিকি করে জ্বলছে ভোট না দেওয়ার বিতর্ক।
সামনাসামনি জন ট্রাভোল্টা আর প্রিয়ঙ্কা চোপড়া
ভোট বিতর্ক যাই হোক না কেন গ্ল্যামারের দিক থেকে আমেরিকার প্রথম আইফা আগের অনেক বছরের আইফাকেই পেছনে ফেলে দেবে। শুধু দর্শকদের ফ্যাশন দেখার জন্যই আরও একটা টেলিভিশন-শো করা যায়। তা কীসের জন্য ট্যাম্পা বে-র এই আইফা এত স্পেশাল? হলটা কী এখানে? হল এমন কিছু যা দেখে বলিউডের অনেক বড় নামই বেশ চমকে গিয়েছেন।
না হলে বলিউডের কোনও অ্যাওয়ার্ড শো-তেই হলিউড ও বলিউডের তফাত বোঝাতে আপনার সামনে আসেন না জন ট্রাভোল্টার মতো মেগাস্টার। কোনও অ্যাওয়ার্ড শো-য়ের ভেনুতে মিকা সিংহের ‘তু মেরা হিরো’ বা ফারহান আখতারের ‘সেনোরিটা’র সাত দিনের মাথায় গান গাইতে আসেন না ব্রুস স্প্রিংস্টিন। কোনও অ্যাওয়ার্ড ফাংশানে প্রায় একশো জন স্টারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না নামীদামী গাড়ি। কোন অ্যাওয়ার্ড শো-তেই বা দেখা যায় মাধুরী দীক্ষিতকে দেখা যায় আমেরিকার তাঁর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে। কোন অ্যাওয়ার্ড শোয়ে দেখা যাবে দীপিকা পাড়ুকোনকে তাঁর বাবা প্রকাশের জন্য টি-শার্ট কিনতে?
এ সব দৃশ্য আইফাতে ছড়াছড়ি। এবং এখানেই হয়তো আইফার সবচেয়ে বড় জয়।
“আইফার বিগেস্ট কনট্রিবিউশন হল পৃথিবীর যে দেশেই ভারতীয় আছে তাঁদের কাছে বলিউডকে পৌঁছে দেওয়া। এই কাজটা আইফার থেকে ভাল কেউ করে না। ডিপ্লোম্যাসিতে যাকে বলে ‘সফ্ট পাওয়ার’ সেটাই করে আইফা,” সে দিন ডাউনটাউন ট্যাম্পা হিলটন হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন অনিল কপূর।
এত বড় একটা বিয়েবাড়ির আয়োজন কিন্তু মোটেই সস্তা নয়। এক এক জনের টিকিটের দাম মাথাপিছু পনেরোশো ডলার। মানে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় নব্বই হাজার টাকা।
মালাইকা
বিপাশা বসু
এতেও টিকিটের জন্য রয়েছে হাহাকার। ধনী গুজরাতি বা পঞ্জাবী ব্যবসায়ী শোয়ের আগে অবধি হন্যে হয়ে খুঁজেছেন টিকিট। এতটাই আইফার আবেদন। এমনকী এখানকার স্থানীয় খবরের কাগজের প্রথম পাতায় শুধু বলিউড আর আইফা। শুধু ট্যাম্পা বে-তেই আইফা কভার করতে এসেছেন প্রায় একশোটা দেশের প্রতিনিধি। শুধু মিডিয়া সেন্টারেই সারাদিনে পাঁচ হাজারের বেশি কফি কাপ শেষ হচ্ছে। এই বছরের এই পুরো অনুষ্ঠান আয়োজন করার পেছনে সরাসরি বা পরোক্ষ ভাবে কাজ করছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি মার্কিন নাগরিক। এবং শুধু আমেরিকা নয়। যে দেশেই আইফা হয় সে দেশে প্রায় এই রকম সংখ্যক স্থানীয় মানুষই আইফার জন্য কাজ করেন।
সাধে কি আর সবাই বলে ব্র্যান্ড বলিউডের আজ যে বিশ্বজোড়া খ্যাতি, তার পেছনে হয়তো সব চেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে আইফার।
এবং ট্যাম্পা বে, ফ্লোরিডাতে আইফার এই রমরমার শেষ কথাটা বোধ হয় বলছেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া।
“আইফা তো ট্যাম্পা বে দিয়ে সবে আমেরিকাতে পা রাখল। মানুষের মধ্যে যে পাগলামো দেখছি খুব শিগগিরই দেখবেন নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে আইফা হচ্ছে এবং সামনের রো তে বসে সেলফি তুলছেন বলিউড ও হলিউডের তারকারা,” হাসতে হাসতে বলেন প্রিয়ঙ্কা।
আইফার দৌলতে সেই দিন বোধ হয় সত্যি বেশি দূরে নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy