Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মোজাম্মেল কাকা আর বাবা, একরাশ কান্নাও

আর একবার বাবার সেই কষ্ট দেখেছি— মুক্তিযুদ্ধের আগে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খান সেনাদের অত্যাচার যখন চলছে, বাবা ঘুমোননি রাতের পর রাত। বাবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকরির সূত্রে আমরা তখন মুম্বইয়ে। গানের স্কুল থেকে গান গেয়ে টাকা তোলা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

স্বাধীনতা দিবসের আগে কলকাতায় জাতীয় পতাকা বিক্রি করছে এক খুদে। (ইনসেটে) মধুলিকা গুহঠাকুরতা।

স্বাধীনতা দিবসের আগে কলকাতায় জাতীয় পতাকা বিক্রি করছে এক খুদে। (ইনসেটে) মধুলিকা গুহঠাকুরতা।

মধুলিকা গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০১:০৫
Share: Save:

১৫ অগস্ট, দেশ, দেশপ্রেম— কথাগুলো নিয়ে অনেক দিন, অনেক দিন আলাদা করে ভাবিনি।

ফ্লরিডায় ‘নাসা’র সূর্যযান পার্কার-এর উৎক্ষেপণ কর্মসূচি থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফেরার পরেই ফোনটা এল। আর ফোনে যখন ভেসে এল উপরের এই শব্দগুলো, বলেছিলাম, ‘দিস ইজ হার্টরেঞ্চিং সাবজেক্ট ফর মি, আই ক্যান টক, টক অ্যান্ড টক’!

সত্যিই হৃদয়মথিত করা আবেগ, অনুভূতি, স্মৃতি, অনুভব। কত গান, কবিতা, মোজাম্মেল কাকা আর আমার বাবা। একরাশ কান্নাও বটে। ঝাঁপিয়ে এল।

মোজাম্মেল কাকা! মোজাম্মেল হক। আমার বাবার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। বরিশালে বি এম কলেজে পড়তেন দু’জনে। স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে ছিলেন দু’জনেই। ১৯৪৮ সালে বাবা কলকাতায় চলে আসেন। মোজাম্মেল কাকা থেকে যান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। পরে মন্ত্রীও হন বলে জানি। আর কলকাতায় বাবার চাকরি, বিয়ে। ১৯৬০ সাল নাগাদ, যতদূর মনে পড়ছে, খবর এল, মোজাম্মেল কাকা তাসখন্দ যাবেন
সম্মেলনে। বাবার সঙ্গে দেখা করে যাবেন কলকাতায়। আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়িতে চাপা উত্তেজনা। যথেষ্ট নিরাপত্তায়, গোপনীয়তায় দেখা হয়েছিল দুই বন্ধুর, কত বছর পরে! তার পরে কাকা চলে গেলেন তাসখন্দে। সেই চলে যাওয়া। আর ফেরেননি। বাবার কষ্ট
বুঝতে পারতাম।

আর একবার বাবার সেই কষ্ট দেখেছি— মুক্তিযুদ্ধের আগে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খান সেনাদের অত্যাচার যখন চলছে, বাবা ঘুমোননি রাতের পর রাত। বাবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকরির সূত্রে আমরা তখন মুম্বইয়ে। গানের স্কুল থেকে গান গেয়ে টাকা তোলা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। এই আবেগ, বাংলায় আমার শিকড়, বাংলা ভাষা সব কিছু নিয়েই বড় হয়ে ওঠা। আমার দেশপ্রেম এই ভাষা, কবিতা, গান সব কিছু নিয়েই গড়ে উঠেছে। যে জন্য ফোন পাওয়ার পরই মনে এল ক্ষুদিরাম বসুকে নিয়ে লেখা গানটা, ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’— বড় প্রিয় গান আমার।

কলকাতা ছাড়লেও বাংলা যাতে না ভুলি, সে কথা মাথায় রেখেই বাবা এমন স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন যেখানে বাংলা দ্বিতীয় ভাষা। গান গাইতাম, আবৃত্তি করতাম— ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত!’ অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, নজরুল ইসলামের লেখা আমাকে শক্তি দিয়েছে। গাঁধীজির কথা, মত, পথ উপলব্ধি করেছি বড় হয়ে। আর অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ!

দেশপ্রেম, আবেগ শব্দগুলো বারবার বলছি। সত্যিই এগুলো কী আমার কাছে? সকলের প্রতি ভালবাসা, সকলের জন্য স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায়কে দেশপ্রেম বলে বুঝি, সামাজিক অত্যাচার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আমার ‘পেট্রিয়টিজম’। অথচ ভারত বা আমার ‘অ্যাডপটেড কান্ট্রি’ আমেরিকা, দু’দেশেই এই অন্যায়, নিরীহ মানুষকে বিভিন্ন অজুহাতে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেই চলেছে চোখের সামনে। এখন চারপাশটা দেখি আর ভাবি, মোজাম্মেল কাকা আর আমার বাবার যে বন্ধুত্ব, সে তো দুটো মানুষের সম্পর্ক, ধর্মের কথা সেখানে আসেনি তো। রবীন্দ্রনাথ তো এই সম্পর্কের কথাই বলেছেন বারবার। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক।

এই লেখা, গান, কবিতার শক্তিই আমাকে দিয়েছিল সেই জেদ, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস, যে সাহসে ভর করে একদিন এসেছিলাম আমেরিকায়, সূর্যের ‘করোনা’ নিয়ে গবেষণা করতে। তার পরে কাজ, বিয়ে। কর্মসূত্রে যখন আমেরিকার নাগরিকত্ব নিতে বাধ্য হলাম, (ভারতের পাসপোর্টটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি কিন্তু), সেই সময়টা ‘ট্রমাটিক’! ভারতের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে? কেন আমাকে বেছে নিতে বাধ্য করা হবে একটা দেশের নাগরিকত্ব? আমার মতো কত কোটি কোটি লোককে? পরে অবশ্য ‘ওভারসিজ সিটিজেন অব ইন্ডিয়া’ হয়েছি।

কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়। রবীন্দ্রনাথের লেখা লাইনগুলো খুব সত্যি বলে মানি নিজের জীবনে, আমেরিকাতেও একাধিক অনুষ্ঠানে, ‘কনভোকেশন স্পিচ’এ পড়েছি—

‘জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী

বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,

যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে

উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে

দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়...’

ওই যে কথাগুলো... বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি।

বা জ্ঞান যেথা মুক্ত...

সূর্যবিজ্ঞান নিয়ে কাজ আমার। সে তো সকলের। বিশ্বজনীন। দেশ দিয়ে তার মাপ হয় কি?

(মধুলিকা ‘নাসা’র সূর্য সংক্রান্ত গবেষণা, ‘লিভিং উইথ দ্য স্টার’-এ লিড প্রোগ্রাম সায়েন্টিস্ট ছিলেন, বর্তমানে ‘নাসা’র এমস রিসার্চ সেন্টারে নিউ ইনিশিয়েটিভ-এ
লিড সায়েন্টিস্ট)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mahulika Guhathakarta Independence Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE