Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

‘এই গ্রামই আমার সব, আমার দেশ’

স্বাধীনতা ও সাম্য কি সমার্থক শব্দ? যদি তাই হয়, তবে এটা ঠিক, বিশুদ্ধ স্বাধীনতা এ দেশ এখনও পায়নি। লিখছেন সৌমিত্র দস্তিদারস্বাধীনতা ও সাম্য কি সমার্থক শব্দ? যদি তাই হয়, তবে এটা ঠিক, বিশুদ্ধ স্বাধীনতা এ দেশ এখনও পায়নি। লিখছেন সৌমিত্র দস্তিদার

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

নামটা আজ আর মনে নেই। কিন্তু মুখচোখের অভিব্যক্তি কোনও দিন ভুলব না। প্রবীণ মানুষটি এক হাতে জাতীয় পতাকা উচুঁ করে অন্য হাত দিয়ে কালো লোহার দরজাটা সমানে ধাক্কা দিচ্ছেন। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডেকে যাচ্ছেন। এ পারে আমরা যাঁরা স্বাধীনতা দেখতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সীমান্তবর্তী এই চ্যাংড়াবান্ধায় চলে এসেছি, প্রবীণের ডাকের লক্ষ্য সেই আমরাই।

উত্তরবঙ্গের এই আপাত অখ্যাত জনপদের ও পারে বাংলাদেশ। দিনটা ১৫ই অগস্ট। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। ও পার আর এ পার। কত ভাগাভাগি, কত শব্দ, কত কথা, কত যন্ত্রণা। রাজনীতি আমাদের ভাগ করে দিয়েছে। কাঁটাতারের ও পারে বেশ কিছু অঞ্চল ভারতীয় জমি। এ পারের কৃষক বিএসএফ জওয়ানের অনুমতি নিয়ে জমির আবাদে ব্যস্ত। কাঁটাতারের মধ্যবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মূল ভারতের যোগাযোগের পথে মস্ত বাধা ওই লোহার দরজাটা। যা নির্দিষ্ট সময় মেনে দিনে, ২৪ ঘণ্টায় মাত্র তিন বার খুলে দেওয়া হয়। অন্য সময়ে কে বাঁচল, আর কে মরল তা নিয়ে রাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই। প্রবীণ লোকটি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। পিছনে আরও কয়েক জন নারী-পুরুষ। তাঁরাও দরজাটা ধাক্কাচ্ছেন। ‘খুলে দাও, একবারটি খুলে দাও, আমরাও এ দেশের লোক। পতাকা তুলব। মিছিল করব।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। অদ্ভুত এক স্বাধীনতা দিবস দেখেছিলাম সেই সকালে।

এখন দাঁড়িয়ে রয়েছি পদ্মার পাড়ে। সূর্য ডোবার সময় হয়ে এসেছে। এ জায়গা মুর্শিদাবাদের শেখপাড়া। জলঙ্গি ডোমকলের কাছে। জলের স্রোত বড় নীরব। দুটো-একটা জেলে নৌকা তখনও বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছে মাছ ধরার। অন্ধকার নামল। ও পারে আলো জ্বলে উঠল। এক জন বললেন, নদী পার হলেই রাজশাহী শহর। চোখ বন্ধ করে ও পারের শহরে চলে গেলাম। কল্পনায়। কত বন্ধু ওপারে। কয়েক মাস আগে ও পার থেকে এ পারের আলো দেখেছিলাম। পদ্মার গান শুনতে শুনতে হৃত্বিক ঘটককে মনে পড়ে গিয়েছিল। রাজশাহী, নাটোর, পুটিয়া একদা বিখ্যাত সব অজস্র জনপথ। একদিন মুর্শিদাবাদের এ তল্লাটের লোকজন বহরমপুর যেত না। তাদের সদর ছিল রাজশাহী। ছিল আর ছিল। যা ছিল তা আজ নেই। যা আছে তা খণ্ডিত, বর্ণহীন। জেল্লা বড় কম। তাও পুরোপুরি সত্যি নয়। এই তো রাজশাহীর এক বন্ধু ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছিল সারা আকাশজোড়া রামধনুর। কী তার রং, কী বাহার, বুঝলাম আকাশের কোনও ভাগাভাগি নেই। টাকি, হিঙ্গলগঞ্জের ইছামতী আগের মতোই বয়ে চলে। জলেরও গতি রোধ করা কাঁটাতারের সাধ্য নয়!

রাজশাহীতে আমাদের এক সিনেমা পরিচালক বন্ধু হাসতে হাসতে একটা গল্প বলেছিল। তার মেয়ে তখন খুব ছোট। তাকে বলা হল কয়েক দিন বাদে আমরা বিদেশে বেড়াতে যাব। সে মহা খুশি। সীমান্তে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকে তাকে বলা হল, এই তো আমরা বিদেশে এসে গিয়েছি। সেই বাচ্চা তখন এ দিক-ও দিক তাকিয়ে কাঁদতে লাগল। তার ধারণা, বাবা-মা তাকে ঠকিয়েছে। এতো আমাদের মতোই দেখতে। একই ধরনের বাড়ি, গাছ-রাস্তা, ভাষা, গরু-ছাগল, ভ্যান-রিকশা তা হলে কেমন ফরেন! ওর কাছেও স্বাধীনতার কোনও ভূগোল নেই।

এক এক সময় নিজেও বুঝতে পারি না ঠিক কাকে বলে স্বাধীনতা? কীসের মুক্তি সে নিয়ে আসে? স্বাধীনতা কার? ব্যাক্তির? পুঁজির? গোষ্ঠীর? সমাজের? আমাদের সংবিধানে লেখা আছে ব্যক্তির ধর্মীয় মতপ্রকাশের কথা, বাক স্বাধীনতার কথা। কিন্তু যদি ছত্তীসগঢ়, কাশ্মীর, মণিপুর, নাগাল্যান্ড নিয়ে নিজের মতো করে ছবি করি তা হলে তা দেখাবার অনুমতি পাব না। তার মানে রাষ্ট্রের, সরকারের চোখ দিয়ে তোমাকে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রই ঠিক করে দেবে আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা। হিলি সীমান্তে এক সমাজকর্মী জানিয়েছিলেন, সীমান্তে চোরাচালান নিয়ে এত কথা বলা হয়। সিনেমায় স্মাগলারদের চেহারা যা দেখেন তা এখানে খুঁজেও পাবেন না। এখানে স্মাগলার ওই যে গেঞ্জি গায়ে রোগা হিলহিলে কিশোরটি। ও পেটের দায়ে এ পারের চিনি ও পারে পৌঁছে দিলে খুব বেশি হলে পাঁচশো টাকা পাবে। ওর মতো অসংখ্য কিশোর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সামান্য ক’টা টাকার জন্য এই ‘চোরাচালান’ করে যাচ্ছে। তারাই আবার মাঝেমধ্যে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে। কাগজের শিরোনাম হচ্ছে, সীমান্তে সন্ত্রাসবাদীর মৃত্যু। আমাদের দীর্ঘ সীমান্তে আজ কাঁটাতার। সবই নাকি জঙ্গি দমনে বাধ্য হয়ে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক কথায় কথায় সখেদে বলে উঠেছিলেন, প্রতিবেশী বন্ধুকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দিলে আর যাই হোক বন্ধুত্ব হয় না।

ভগবানগোলায় আখরিগঞ্জেও ভাঙন মারাত্মক হয়ে উঠছে। এ পার ভাঙলে ও পারের চর জেগে উঠবে। ভিটে হারানো মানুষজন চরে নতুন বসতির স্বপ্ন নিয়ে ভিত তৈরিতে সক্রিয় থাকবেন। এই চরের বাসিন্দারা কোন দেশের নাগরিক হবে? সে কি জানে আমাদের স্বাধীনতার অর্থ?

দেশভাগ আমাদের স্বাধীনতাকে খণ্ডিত করে দিয়েছে। তার ফল এত বছর বাদেও আমাদের, বিশেষ করে সীমান্ত সংলগ্ন জনসাধারণকে ভোগ করতে হচ্ছে। লেখালেখি, সেমিনার, ছবি সে যন্ত্রণা-বিষাদকে দেখতে বা দেখাতে পারে না। আত্মীয়স্বজন ভাগ হয়ে গেছে। দাদু, মাসি, কাকার মৃত্যুতেও ছুটে আসার পথে অন্তরায় ভিসা, পাসপোর্ট, কাঁটাতার, সভ্যতার নানা অনুষঙ্গ। যে কোনও সীমান্তে যান, চোরাচালান, জঙ্গি অনুপ্রবেশ এত সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি জনমনের যে নীরব কান্না তার কোনও ঘোষণা নেই, অনুভব করতে হয়।

কয়েক দিন আগে মুর্শিদাবাদ সীমান্তের এক স্কুলে ক্লাস নাইন-টেনের ছেলেমেয়েদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তোমাদের কাছে স্বাধীনতা কী? প্রায় সবাই বলল— পতাকা নিয়ে মিছিল করা, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, মাস্টারমশাইদের ভাষণ শোনা, তারপর অনন্ত ছুটি, পিকনিক, খেলা, হুটোপাটি। ইচ্ছে করে এক ছুট্টে ও পারে যাই, দেখে আসি সেখানে কী হচ্ছে আজকের দিনে।

জেএনইউ-এর ছাত্রেরা দাবি করেছে অন্য এক আজাদির। গরিবি থেকে জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা থেকে আজাদি বা মুক্তির। স্বাধীনতা ও সাম্য কি সমার্থক শব্দ? যদি তাই হয়, তবে এটা ঠিক, বিশুদ্ধ স্বাধীনতা এ দেশ এখনও পায়নি। ভবিষ্যতেও পাবে কি না বলা কঠিন।

কী বিপুল দারিদ্র কালাহান্ডি, ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্র, বিহারের গ্রামে গ্রামে। মাওবাদী এক নেতা জানতে চাইলেন, ‘দাদা কভি পলামু গিয়া?’ হ্যাঁ, বেড়াতে গিয়েছি বলতেই ও হো হো করে হেসে উঠে জানিয়েছিল, ‘ও তো ট্যুরিস্ট লোগোকি পলামু। আসল পলামু দেখতে হলে গরমের দিনে যেও। দেখবে ভোর রাত থেকে গাঁয়ের মেয়েরা মাইলের পর মাইল হেঁটে এসে নদীর বালি খুঁড়ে পানীয় জল নিতে যায়।’

কালাহান্ডি তবু খবরে এসেছে, বিদর্ভর কৃষক আত্মহননও কিছুটা জানা। কিন্তু ওড়িশা, ছত্তিশগড়ে বর্ষায় খাবার না পেয়ে কোলের শিশুর কান্না থামাতে মা অজান্তে মাটি খুঁড়ে তার মুখে যখন বিষাক্ত আলু দেন, ও তাঁর কোলেই যখন সন্তান নেতিয়ে পড়ে, তার খবর শহরে এসে পৌঁছয় না। আমার মনে হয় না সেই মায়ের কাছে স্বাধীনতা কোনও আলাদা তাৎপর্য নিয়ে আসে।

কিংবা বর্ষার সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে উথালপাতাল জলে যে জেলে নৌকাটি প্রাণপনে ডাঙা খুঁজতে ব্যস্ত, তাঁর কাছেও স্বাধীনতার কোনও আলাদা মানে নেই।

স্বাধীনতা কি ব্যক্তির? ব্যক্তি মানে তো তার মননেরও। আপাত আধুনিক, ফ্যাশনদুরস্ত যে তরুণ-তরুণীটি একই সঙ্গে বিজ্ঞান ও জ্যোতিষে মগ্ন সে-ও কি সংস্কারের কাছে অনৃত্যের কাছে বন্দি নয়? তার স্বাধীনতা কবে আসবে? আসলে স্বাধীনতার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না। নানা ভাবে আমরা বন্দি। ব্যক্তি সম্পর্কই বলুন বা সামাজিক বিধি-নিষেধই বলুন, আমাদের নানা বাঁধন। নানা লাল চোখ সব সময় আপনাকে পাহারা দিচ্ছে। আর এখন তো কে কী খাবে না খাবে, তা নিয়েও আসছে নানা ফতোয়া। তা ছাড়া নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, নাটক, ভাস্কর্য, সিনেমার যেমন কোনও নির্দিষ্ট ভূগোল নেই। সে অনন্ত আকাশে পাখির মতোই সর্বত্রগামী, স্বাধীনতার আসল রূপটিও তাই। সীমান্তে কাঁটাতার, রাইফেল, সতর্কতা সব পেরিয়েও তাই লোকে এ পার-ও পার করে। স্বজনের টানে, অর্থনৈতিক তাগিদেও।

কয়েক বছর আগে ডকুমেন্টারি করতে ছিটমহল গিয়েছি। তখনও তার সমস্যার সমাধান হয়নি। বিচিত্র ভূগোল। চারপাশে হয় বাংলাদেশ বা ভারত। মাঝখানের গ্রামটুকু শুধু অন্য দেশের। আক্ষরিক অর্থেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের অবস্থা তখন ছিল অত্যন্ত সঙ্গিন। সর্বগ্রাসী অভাব। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ন্যূনতম সুযোগ নেই, মর্যাদাও নেই নাগরিক হিসেবে। ছিটটার নাম ভুলে গিয়েছি। ভারতীয় ছিট। চারপাশে বাংলাদেশ।

অন্ধকার নামবে নামবে করছে। প্যাক আপ ঘোষণা করাটুকু বাকি। এক বুড়ি দেখি, ঠুকঠুক করে লাঠি নিয়ে এগোচ্ছেন। আমাদের মতো শহুরে লোকজন দেখেই সম্ভবত ঈষৎ থমকালেন। ভুরু কুঁচকে চোখের উপর হাত নিয়ে ঠাওর করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কারা এই অজানা আগন্তুকেরা? অন্ধকার নামার আগে আকাশে এক অন্য রকম আলো দেখা দিল। লোকে যাকে ‘কনে দেখা আলো’ বলে। এই আলোয় বুড়িকে রানির মতো লাগছে। তাঁর চলন, মেজাজ, গাম্ভীর্য বুঝিয়ে দিচ্ছে তাঁর দীর্ঘ দিনের রাজপাটে আচমকা এই অজানা ব্যক্তিদের উপস্থিতি তাঁর পছন্দ নয়। ক্যামেরা চলছে। প্রশ্ন করলাম, এই জায়গাটা কী? কাদের? ভারত না বাংলাদেশের?

জীবনে যেন এত মজার কথা শোনেননি এমন ভাব করে বুড়ি হাসলেন। ফোকলা দাঁতে তাঁর হাসি উপছে পড়ছে। আলো কমে আসছে। চরাচর ডুবে যাবে অন্ধকারে। বুড়ি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘‘ধুর বোকারা, এ সব তো যারা ভোট-টোট চাইতে আসে তারা জানে। আমি কি ছাই জানি এ ভারত না বাংলাদেশের? এখানে আমি জন্মেছি। এখানেই মরব। শুধু জানি এটাই, এই গ্রামই আমার সব, আমার দেশ।’’

স্বাধীনতার মানে ওই বুড়ি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন। তার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কোনও ভূগোলও নেই!

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Soumitra Dastidar independence day 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE