Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সে দিনের ‘স্বাধীনতা’ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল কি?

শাসনক্ষমতা হস্তগত করতে গিয়ে আমরা আমাদের জন্মভূমি দ্বিখণ্ডিত করেছিলাম। মনে করেন তিলোত্তমা মজুমদারশাসনক্ষমতা হস্তগত করতে গিয়ে আমরা আমাদের জন্মভূমি দ্বিখণ্ডিত করেছিলাম। মনে করেন তিলোত্তমা মজুমদার

রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে শরণার্থী শিবির।—আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে শরণার্থী শিবির।—আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

সত্তর বছর আগে পনেরোই অগস্ট মধ্যরাত্রে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। কে আমাদের সেই স্বাধীনতা দিল? স্বাধীনতা কি কেউ কাউকে দেয়? গচ্ছিত ধনের মতো অবয়ব ও ওজনদার কোনও বস্তু কি এই স্বাধীনতা, যার বিনিময় সম্ভব?

নাকি স্বাধীনতা একটি ধারণা মাত্র, একটি নির্ধারিত পরিসরে, কিছু বিধিবন্ধন সাপেক্ষে তার অস্তিত্ব! স্বাধীনতা আসলে ঠিক কী! স্বেচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই কি স্বাধীনতা? প্রতিষ্ঠান যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার পশ্চাতে থাকে মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিক বা গোষ্ঠীগত ইচ্ছার প্রকাশ! তা যেমন নির্বাধ হতে পারে না, তেমনই ব্যক্তির আত্মঘাতের মতো স্বেচ্ছাসিদ্ধান্তকেও আমরা স্বাধীনতার অধিকার হিসেবে মেনে নিতে পারি না। সুতরাং ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাই হোক, স্বাধীনতাকে একটা খোলা মাঠের সঙ্গেও তুলনা করা যায়, যার সীমা আছে। আবার পরিসরও আছে।

স্বাধীনতা আসলে সেই আশ্চর্য পুতুল, যে মেলায় ঘুরে ঘুরে খেলা যখন দেখায়, আলোআঁধারিতে তার নড়াচড়া স্বেচ্ছাকৃত মনে হয় এবং দর্শক এক কাহিনির মধ্যে ঢুকে পড়েন। সেই পুতুলের প্রত্যেকটি নড়াচড়া তৈরি হয় অন্তরালে বসে থাকা কোনও ব্যক্তির হাতে বাঁধা সুতোর টানে। আপাতদৃষ্টিতে যা চোখে পড়ে না।

এখানে সুতো নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি প্রতীক মাত্র। তাঁর জায়গায় আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বসিয়ে দিতে পারি, সমাজ, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং জাতীয় ঋণ বা গড় জাতীয় আয়কেও বসিয়ে দিতে পারি। এমনকী, রাষ্ট্রপরিচালনাকারী দল প্রেম-প্রণয় বিষয়ে কোন নীতি বিশ্বাস করে, তাই দিয়েও স্বাধীনতার সুতো তৈরি করা যায়।
তা হলে পনেরোই অগস্ট আমরা কী পেলাম? সে দিনের সেই স্বাধীনতার নাম আসলে ক্ষমতার হস্তান্তর। ভারত ভূখণ্ড শাসনের ক্ষমতা। এক রাষ্ট্রের জন্ম, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই ভূখণ্ডজাত মানুষ। সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতবাসী এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাদের দেশ আমরাই শাসন করতে চাই। এরই নাম স্বাধীনতা। এখানে দেশিক এবং রাষ্ট্রিক ধারণা একাকার।

কিন্তু সে দিনের ‘স্বাধীনতা’ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল কি? রাজনীতির কুটিল প্রয়োগ কি সে দিন দেশ সম্পর্কে ধারণাটি ছিন্নভিন্ন করে দেয়নি? এমনকী, শাসনক্ষমতার হস্তান্তর এবং স্বাধীনতার অর্থ যে এক নয়, সদ্যোজাত ভারত স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই বুঝতে শুরু করেছিল। দেশ সম্পর্কিত বোধ, স্বাধীনতার ধারণা, ন্যায়-নৈতিকতা বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন আজও নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য উপসংহারে পৌঁছতে পারেনি। শাসনক্ষমতা হস্তগত করতে গিয়ে আমরা আমাদের জন্মভূমি দ্বিখণ্ডিত করেছিলাম।


ছিন্নমূলের যাত্রা। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

সদ্যপ্রসূত দেশের প্রতিটি কোণায় গর্ব, আবেগ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে যখন পতাকা উড়ছিল তখন বিভক্ত দেশের এক প্রান্ত থেকে পৃথকীকৃত ভূখণ্ডের অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ উত্‌পাটিত হয়ে, নিঃসম্বল অবস্থায়, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে, চূড়ান্ত অসহায়তায় এক রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছিলেন, আর সেখানে ‘স্বাধীনতা’-র বোধ এবং আবেগ থাকা বা প্রত্যাশা করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। কে কোন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে ধরবেন, তার নির্বাচনের অধিকার ছিল না তাঁদের।

স্বাধীনতার মূল্য হিসেবে সেই সব মানুষকে যে ভূখণ্ড থেকে উত্‌খাত করা হল, সেই মাটিতেই তাঁদের জন্ম হয়েছিল, সেখানেই ছিল তাঁদের পিতৃপুরুষ ও মাতৃকুলের চিহ্ন, সেখানের জমি, ফসল, রোদ, বায়ু এবং সংস্কার নিয়ে বংশপারম্পর্যে যে জীবন প্রোথিত ছিল সেই ছিল তাঁদের ‘দেশ’। ‘স্বাধীন দেশ’ সম্পর্কিত গর্বের কিন্তু যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির গ্রাহ্যতা তাঁদের ক্ষেত্রে অন্তত সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল কি? তাঁরাও নিশ্চয়ই ব্রিটিশের অধীনতা চাননি। কিন্তু দেশাত্মবোধ পাল্টাতেও কি চেয়েছিলেন?

এই প্রসঙ্গ নতুন নয়। আবার আলোচনার ঊর্ধ্বেও নয়। বরং প্রতি বার স্বাধীনতা দিবস সমাগত হলে এই যন্ত্রণার কথা স্মরণ করা উচিত। স্বাধীনতার নানাবিধ সংজ্ঞা এবং প্রকৃতি ওই ঘটনার মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছিল। পরাধীন ভারতবর্ষে মনে হয়েছিল রাষ্ট্রিক স্বাধীনতাই নাগরিকের সার্বিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে। কিন্তু দেশভাগজনিত মর্মান্তিক পরিণতি সমূহ দেখিয়ে দেয়, স্বাধীনতার চেতনা রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিমানসে সর্বত্র এক বিন্দুতে মেলে না।

রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নাগরিকের জীবন এবং ভূখণ্ড রক্ষা করে। সেই ভূখণ্ড দেশ, সেই নাগরিকবৃন্দও দেশ। সেই দেশের মধ্যে আছে সমাজ, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি। আছে নিয়ত বিবর্তনশীল মানবিক সত্তা। যা সমাজের প্রতিটি দিক, প্রতি ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মানুষের নৈতিকতা ও আচরণবিধির মধ্যে পরিবর্তন ঘটায়।
অর্থাত্‌, দেশ সম্পর্কে ধারণার মধ্যে রাষ্ট্র সর্বত্র প্রবেশাধিকার পায় না। কারণ রাষ্ট্র সম্যক বিধি ও নিয়মকানুন তৈরি করে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে। সেটা বাইরের কাজ। বোধ ও বিশ্বাসে তার হাত নেই। সেখানে চিত্তবৃত্তির স্বাধীনতা। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা।

একজন ব্যক্তি প্রাথমিক ভাবে একজন একক সত্তা। তারপর সে সামাজিক সত্তা। এরপর সে এক রাষ্ট্রীয় পরিচিতি, যাকে প্যান কার্ড, পাসপোর্ট বা আধার নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সেই ব্যক্তি ছবি আঁকবে কিনা, গান গাইবে কিনা, আমিষ ভোজন করবে কিনা, ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে কিনা ইত্যাদি বহুতর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজও তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হ্রস্বতর করেছে। শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ।

অর্থাত্‌ একজন ব্যক্তির সাপেক্ষে স্বাধীনতা বর্তমানে ত্রিস্তরীয় কাঠামো। ব্যক্তি, দেশকাল সাপেক্ষে সমাজ, সমষ্টিগত ভাবে ব্যক্তি ও সমাজ সাপেক্ষে রাষ্ট্র।

রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের গুরুত্ব সমান। কারণ রাষ্ট্র নৈর্ব্যক্তিক। একটি কাঠামো মাত্র। দেশবাসীর অধিকারগুলি সুরক্ষিত করার বিধিবন্ধন। সমাজের প্রয়োজনে নিয়ম সৃষ্টি করা হয়, সমাজ তার রক্ষক সৃষ্টি করে, শৃঙ্খলার নির্ণায়ক এবং পরিচালক। তাকে আমরা বলছি ‘সরকার’ বা গভর্নমেন্ট। যে পরিকাঠামো অবলম্বন করে শাসনপ্রক্রিয়া চালায় ‘সরকার’ সেই হল রাষ্ট্র। প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের অধীন, এবং রাষ্ট্রের অংশ। রাষ্ট্র নাগরিকবৃন্দের স্বাধীনতা, জীবন, অধিকার এবং নিরাপত্তার রক্ষক। অর্থাত্‌ দেশ ও দেশবাসীর জীবনের ও স্বাধীনতা রক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান।

অনেক সময় রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো নাগরিক অধিকার হরণ করতে থাকে। অর্থাত্‌, এই দেশেরই কতিপয় নাগরিক, যাঁরা শাসনপ্রণালীর পরিচালক, ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন। সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর স্বাধীন থাকতে পারে না। রাষ্ট্রীয় নীতি, সর্বজনস্বীকৃত সংবিধান ও আইন একটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তা হল মানবিক সততা। যে মুহূর্তে কোনও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়, রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তার অপব্যবহার ঘটতে থাকে, নাগরিকবৃন্দও আর স্বাধীন থাকেন না। তখন আসে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। অধিকার বোধের সঙ্গেই তাদের উদ্ভব। কারণ স্বাধীনতা মানে কেবল শাসন প্রক্রিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তর নয়, স্বাধীনতা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া যা সচেতন নাগরিককে অর্জন করে চলতে হয়।


পুনর্জন্মের প্রতীক্ষায়। শিয়ালদহ স্টেশনে। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

স্বাধীন দেশে আমরা ভোটাধিকার পাই এবং শাসনকার্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করি। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশচালনার যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু শুধুমাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নাগরিকের কর্তব্য শেষ হয় না। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নজরদারিও তার নিজের অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এই চেতনা যত বেশি করে উত্‌সারিত হয়, তত সমাজের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল।

রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সীমা কতদূর, নাগরিক সমাজের তা ভুললে চলে না, ব্যক্তিজীবনে সমাজের নাসিকা প্রতান অধিকার বহির্ভূত হচ্ছে কিনা তা-ও নাগরিক সচেতনতাই নির্ধারণ করে।

কর্তব্যের অঙ্গীকারে স্বাধীনতা প্রতি মুহূর্তে অর্জন করতে হয়, প্রতি ক্ষেত্রে, জীবনে এর চেয়ে বৃহত্‌ সত্য আর কিছু নেই।

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tilottama Majumder independence day 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE