ছবি: সুব্রত চৌধুরী
উদ্ধব একবার শ্রীকৃষ্ণের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, পুরুষ ও প্রকৃতি যদি জড়-চেতন রূপে পরস্পর আলাদা, তা হলে পরস্পরের আশ্রয় ছাড়া তাদের বোঝা যায় না কেন? উত্তরে, কৃষ্ণ কী বলেছিলেন তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমরা যদি কবি ও কবিতা বিষয়ে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি? জবাবে কে কী বলবেন, আমার জানা নেই কিন্তু শঙ্খ ঘোষ যে কাজুবাদাম খেতে বলবেন, তা বিলক্ষণ জানি।
জানি কারণ, ঠিক এই রকম একটা প্রশ্ন আমি ওঁকে করেছিলাম আজ থেকে ষোলো বছর আগের এক সন্ধ্যায় এবং ইউনিভার্সিটি ফেরত আমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আমার আসল প্রশ্নটা ছিল, ওঁর বসার ঘরের টেবিলে রাখা কাজুবাদামের ছোট্ট বয়ামটা আমি একাই সাবাড় করে দিতে পারি কি না।
‘তুমি কি আরও একটু কাজুবাদাম খেতে চাও?’ সব ক’টা কাজু খতম করে দেওয়ার পর শঙ্খবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন।
উত্তরে চক্ষুলজ্জার খাতিরে ‘না’ বলেছিলাম, কিন্তু একই সঙ্গে ধারণা করে নিয়েছিলাম যে শঙ্খবাবু বিরাট বড়লোক। আমাদের বাড়িতে দিদি-জামাইবাবু এলে ফ্রাইড রাইস হয় আর তখন দোকান থেকে একশো গ্রাম কিনে আনি; আর ওঁর বাড়িতে কি না বয়ামের পর বয়াম কাজুবাদাম! একটা শেষ করে দেওয়ার পরও আবার সাধছেন!
পরে যত বার ওঁর কাছে গিয়েছি, আমার মনে হয়েছে, সবটা দেওয়ার পরও আরও কিছুটা দিতে পারলে যে কতিপয় মানুষ অলৌকিক আনন্দ পান, শঙ্খবাবু তাঁদেরই এক জন। আর সে ক্ষেত্রে তিনি যা দিয়েছেন, দেন, তার নাম ‘সময়’। বাংলা ভাষার এক জন শীর্ষস্থানীয় কবি, নিজের জীবনচর্যার মধ্যে দিয়ে যিনি মূল্যবোধের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন, তাঁর কাছে যে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদরাও আসবেন, তাতে আশ্চর্য কী? কিন্তু তাঁদের বাইরে আরও কত মানুষকে, শঙ্খবাবু কতটা নির্ভরতা আর সাহস দেন, তার কোনও খবর আমরা রাখি কি?
এক দিনের কথা বলি। সে দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শঙ্খবাবুর বাড়ি পৌঁছে দেখি, এক ভদ্রমহিলা ওঁর সামনে বসে কেঁদে চলেছেন। মাঝে মাঝে কান্না থামিয়ে বলছেন, নিজের সাংসারিক সমস্যার কথা। কথায় কথায় যা বুঝলাম, প্রায় বছর কুড়ি আগে উনি শঙ্খবাবুর ছাত্রী ছিলেন। তার পর বিয়ে-থা হয়ে জব্বলপুরে চলে গিয়েছিলেন, ফিরেছেন বছর দুয়েক আগে। চাকরিবাকরি করেন না, গৃহবধূ। ওঁর শাশুড়ি কী রকম ভাবে জীবন ঝালাপালা করে দেন, শঙ্খবাবুকে সবিস্তার বোঝাচ্ছিলেন ভদ্রমহিলা। আর আমি অবাক হয়ে খেয়াল করছিলাম, আশি ছুঁই-ছুঁই শিক্ষক কেমন পিতার স্নেহে তাঁর এমন এক ছাত্রীর কথা শুনছেন, যাঁর সঙ্গে কবিতার কোনও সংযোগই নেই।
‘জানেন তো, রান্নার লোক ছাড়িয়ে দিয়েছে, আমি ভোর ছ’টায় রান্না শুরু করি। সব একা হাতে সামলে আটটা-সাড়ে আটটা বেজে যায়। তার পর আবার দশটার সময় শ্বশুরমশাই বাজার করে নিয়ে আসেন। তখন মেয়েকে স্কুলে দিতে যাব, নাকি আবার… তবু যদি রান্না পছন্দ হত!’ ভদ্রমহিলা বলে ওঠেন।
শঙ্খবাবু উত্তরে বলেন, রান্না পছন্দ হবে না কেন?
‘আমি নাকি বেশি ঝাল দিই।’
‘বুঝতে পেরেছি। শোনো তুমি বাটা লঙ্কা ব্যবহার করবে না, গোটা লঙ্কা দেবে। তাতে ঝালটা কম লাগবে…’ শঙ্খবাবু বলেন।
এই গল্প চলতে থাকে। সন্ধে সাতটা নাগাদ এক কবি-প্রাবন্ধিক আসেন। বসার ঘরটায় ঢুকে কিছু ক্ষণ পরেই তিনি অধৈর্য হয়ে ওই ভদ্রমহিলাকে বলে ওঠেন, ‘আপনার শেষ হল? আমার জরুরি কথা আছে, স্যরের সঙ্গে।’
কথাটা হাওয়ায় পড়ামাত্র মৃদু গলায় শঙ্খবাবু বলে ওঠেন, ‘ও যে কথাগুলো বলছে, সেগুলো কম জরুরি, এ রকম তোমার মনে হচ্ছে কেন?’
কবি-প্রাবন্ধিক আমতা আমতা করতে থাকেন। আর সেই ভদ্রমহিলা লজ্জা পেয়েই হয়তো বলে বসেন, ‘আমি আজ যাই স্যর।’
শঙ্খবাবু হাসিমুখে বলে ওঠেন, ‘তোমার কথা তো শেষ হয়নি। তুমি এখনই যাবে কেন?’
সে দিন রাতে বাসের জানলার পাশে বসে মনে হচ্ছিল, এই দুনিয়ায় যেখানে কালকের কথা আজ মনে রাখে না লোক, সেখানে কুড়ি বছরের পুরনো ছাত্রীর সাংসারিক সমস্যার কথা যে মানুষ এতটা যত্ন নিয়ে শুনতে পারেন, তিনি বোধহয় আমাদের এই সময়টারই শিক্ষক।
সময়ের অজস্র বাঁকে শঙ্খবাবুকে লেখার টেবিলে নয় রাস্তায় দেখতে পেয়েছি। নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় যে আসলে সূর্যাস্ত তা ওই মিছিলে হাঁটতে হাঁটতেই অনুভব করেছি। কামদুনির ঘটনার পর মিছিলে আসার জন্য আমাকে নিজে ফোন করেছিলেন উনি। সে দিন আমার একশো দুই জ্বর। গিয়ে পৌঁছতে এক বার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, কী বুঝলেন কে জানে, বললেন, ‘হাঁটতে হবে না তোমায়।’ আমি সারা রাস্তা হেঁটেছিলাম। আর মিছিলের প্রায় অর্ধেক সময় আমার হাতটা নিজের হাতে ধরে রেখেছিলেন স্যর। বাবা পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর, অতটা নিরাপদ আর কোনও দিন বোধ করিনি।
যে মানুষের নিরাপত্তা নেই, সে কি নিরাপদে থাকা মানুষের মতো শান্ত হয়ে কথা বলতে পারে? পারে যে না, সে কথা তো শঙ্খ ঘোষ-এর কবিতায় বার বার পেয়েছি। আর একটা কলকাতায় হেঁটে একটা প্রজন্ম দেখতে শিখেছে, দিনের রাতের মাথায় খুন ঝরছে। কিন্তু সেই রক্ত যখন হৃদয়েও ঝরে? ‘তুমি কোন দলে?’ প্রশ্নের মুখে অসহায় মানুষ যখন বলতে বাধ্য হয়, ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’? যখন মানুষ মানুষকে ফেসবুকের মতো ব্যবহার করে, ইচ্ছেমতো লগ-ইন করে আবার লগ-আউট হয়ে যায়, তখন চার পাশে শিকড়ের মতো নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়াটাই যে এক জন কবির কাজ, শঙ্খবাবুর লেখা আর জীবন যেন তারই বার্তা দিয়ে যায় বার বার।
সেই কোন যৌবনে ‘কবিতা পরিচয়’-এর পাতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর সঙ্গে তর্কের প্রেক্ষিতে শঙ্খবাবু লিখেছিলেন যে, মতান্তর মানেই যে দেশে ‘গূঢ় অভিসন্ধির সন্ধান’ সেখানে, ‘সুস্থ প্রত্যালোচনার প্রসারে খুশি লাগে’। আজ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পার করে এসেও তিনি রয়ে গিয়েছেন একদম একই রকম। বিরুদ্ধ মত নিয়ে তাঁর কাছে নিঃসঙ্কোচে যাওয়া যায়, কোনও একটি বিষয়ে সাহিত্যজগতের অধিকাংশ লোক একই ভাবে কথা বলছে বলে, সবাইকেই সেই সুরে সুর মেলাতে হবে, এমনটা তিনি মনে করেন না। বহু বার এমন হয়েছে যে তিনি একটা বিষয়ে এক রকম কথা বলছেন, আর সম্পূর্ণ অন্য মত নিয়ে হাজির হয়েছি আমি, নিজের মতটা পাঁচ মিনিটে বলে, আমার মতটা শুনেছেন পঁচিশ মিনিট ধরে। আর শোনার পর উড়িয়েও দেননি।
একটা উদাহরণ দিই।
স্যর ‘জ্ঞানপীঠ’ পাওয়ার পর আমি ওঁর বাড়িতে গিয়ে একটু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করায় আমায় বললেন, ‘পুরস্কার নিয়ে নিঃস্পৃহ থাকতে হয়।’
আমি উত্তরে বললাম, আপনার মতো এত পুরস্কার তো পাইনি। পেলে নিঃস্পৃহই থাকতাম।
অন্য কেউ হলে দিত তখনই ঘাড়ধাক্কা। স্যর আমায় অবাক করে বললেন, ‘খুব সত্যি কথা বলেছ। এত পুরস্কার পাওয়া আমার উচিত হয়নি। একটু কম পেলে খুব ভাল হত।’
ওই একটু কম পাওয়ার সাধনাই শঙ্খবাবু করে এসেছেন আজীবন। আর তাই ওঁর লেখায় বারে বারে ফুটে উঠেছে সেই বালিকার কথা, রিফিউজি ক্যাম্প থেকে রিফিউজি ক্যাম্পে যাত্রার মাঝেও যে একটু সেজে নেয়, সেই ছেলেটার কথা, যে সইতে সইতে এক দিন টের পায়, ‘মারের জবাব মার’। আসলে, এই আরও চাই আর আমার জন্যই চাই-এর জগতে শঙ্খবাবুর অস্তিত্বই, ক্ষীর-ননী নিজেদের আওতায় টেনে নেওয়া বাবুদের দিকে উদ্যত একটি তর্জনী। যা জানতে চায়, লজ্জা হল?
কলকাতায় বসে দিল্লি-গুজরাত-কাশ্মীর-আমেরিকার মুন্ডুপাত করার যে ধারা তা তো চিরকালই ছিল, কিন্তু কলকাতায় দাঁড়িয়েও কলকাতার শাসকদের কাছে ঘাড় হেঁট না করার সাহস ক’জনের থাকে? শঙ্খবাবুর অবস্থান এবং লেখা আমার মতো অনেককেই নিশ্চয়ই সেই সাহস দিয়েছে যেখান থেকে কেবলমাত্র পুতিন বা ট্রাম্প নয়, পাড়ার পুকুর বোজাচ্ছে যে লোকটা, তারও বিরুদ্ধাচরণ করা যায়। সব রকম ক্ষতির সম্ভাবনা মাথায় রেখেই।
বাঙালি কবিদের কাছে বিরাট ব্যাপার হল শঙ্খবাবুর স্বীকৃতি। আমারও গায়ে কাঁটা দিয়েছে যখন আমার কোনও লেখা পড়ে উনি নিজের ভাল-লাগা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে লজ্জাও পেয়েছি কারণ কীই বা লিখতে পেরেছি? আর তার চেয়েও বেশি খারাপ লেগেছে যখন শারদীয় ‘দেশ’ এ প্রকাশিত আমার একটি উপন্যাস পড়ে স্যর কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আগে কেউ ভাল লিখলে পাঁচ জনের মুখ থেকে সেটা শুনতে পেতাম, এখন কেউ বলে না কেন বলো তো?’
মাটিতে মিশে গিয়েছিলাম এটা ভেবে যে, আমি নিজে ক’বার ক’জনের ভাল লেখা পড়ে স্যরকে ফোন করে জানিয়েছি?
আজ এই লেখার ভিতর দিয়েই বা কতটা জানাতে পারছি শঙ্খ ঘোষ কী? এক বার একটা অভিমানে আমি ছ’মাস যাইনি ওঁর বাড়িতে, বইমেলায় দেখা হতে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ?’
কী করে ভুলব? ব্যক্তিগত হাজারও সঙ্কটে ছুটে গেছি যাঁর কাছে, মাথায় অভিভাবকের মতো হাত বুলিয়ে দিয়েছেন যিনি, তাঁর বাড়ি থেকে আনা খানদশেক বই ফেরত দিতে ভুলে যেতে পারি, তাঁকে ভুলব কী করে?
তবে অ্যাকিলিসের যেমন গোড়ালি ছিল, শঙ্খবাবুরও দুর্বল জায়গা আছে একটা। হাজার ঝগড়া করেও যাঁকে উত্তেজিত করতে পারিনি, তিনি এক দিন ট্যাক্সিতে আমার সঙ্গে উল্টোডাঙ্গা থেকে রবীন্দ্রসদন আসতে আসতে ট্যাক্সিচালকের রেডিয়ো শুনতে শুনতে কী উত্তেজিত। ঠিক রবীন্দ্রসদনের মুখে ইস্টবেঙ্গল দ্বিতীয় গোলটা দিল আর একটা স্বর্গীয় হাসি ভেসে উঠল ওঁর মুখে।
আচ্ছা, মোহনবাগান সমর্থকরা জানতে পারলে রাগ করবেন না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy