Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

সন্ন্যাসী গণিতজ্ঞ

গণিতের যুগান্তকারী বহু ধারণার উৎসভূমি যে ভারত, সেই ভারতই একুশ শতকে বিশ্বকে উপহার দিল গণিতের আকাশে একটি নক্ষত্র। বিমূর্ত গণিতের দুরূহ রহস্যে মজে আছেন গেরুয়াবসন ব্যতিক্রমী সন্ন্যাসী মহান মহারাজ।গণিতের যুগান্তকারী বহু ধারণার উৎসভূমি যে ভারত, সেই ভারতই একুশ শতকে বিশ্বকে উপহার দিল গণিতের আকাশে একটি নক্ষত্র। বিমূর্ত গণিতের দুরূহ রহস্যে মজে আছেন গেরুয়াবসন ব্যতিক্রমী সন্ন্যাসী মহান মহারাজ।

পথিক গুহ
ছবি: সুব্রত চৌধুরী শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০১:১৯
Share: Save:

অগস্ট, ২০১০। হায়দরাবাদ শহর। ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথমেটিশিয়ানস। চার বছর অন্তর গণিতজ্ঞদের বিশ্বসম্মেলন। যা উদ্বোধন করেন আয়োজক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তিন বা চার জন নবীন গণিতজ্ঞের হাতে তিনি তুলে দেন সেরা শিরোপা। ফিল্ডস মেডেল। ‘গণিতের নোবেল’। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাক্ষী কয়েক হাজার গণিতজ্ঞ। রাজসূয় যজ্ঞ।

ন’দিন ব্যাপী সম্মেলনে পৃথিবীর রথী-মহারথীদের ভিড়ে এক ভারতীয়ের দিকে নজর পড়ল ডেলিগেটবৃন্দের। কারণ দুটি। প্রথম অবশ্যই তাঁর বেশভূষা। তিনি সন্ন্যাসী। গেরুয়াবসন। ব্যতিক্রমী বেশ যদি নজরে পড়ার তুচ্ছ কারণ হয়, তবে দ্বিতীয় অজুহাতটি গূঢ়। যে ভারত একদা ছিল গণিতচর্চার পীঠস্থান, যার উর্বর ভূমিতে জন্মেছিল শূন্য বা ‘জিরো’-র মতো যুগান্তকারী ধারণা, সে দেশ গণিতশাস্ত্রকে একবিংশ শতাব্দীতে উপহার দিচ্ছে এক জন স্টার। তিনি ওই গেরুয়াবসন সন্ন্যাসী।

নাম? স্বামী বিদ্যানাথানন্দ। নাহ্, সন্ন্যাস-নামে তেমন পরিচিত নন ওই গণিতজ্ঞ। ১৯৬৮ সালে জন্মসূত্রে যিনি ছিলেন মহান মিত্র, তিনি এখন সবার কাছে মহান মহারাজ। বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এখন তাঁর স্থায়ী ঠিকানা মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ।

ক্লাস টেন এবং টুয়েলভ সেন্ট জেভিয়ার্সে। আইআইটি এনট্রান্স। র‌্যাংক ৬৭। কানপুর আইআইটি-তে ভর্তি ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। কিন্তু, মহান যে স্কুলেই ভালবেসে ফেলেছেন এক বিষয়। গণিত। তাঁর পড়া শেষ বহু গণিতজ্ঞের জীবনী। এবং, ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি-র লেখা ‘আ ম্যাথমেটিশিয়ান’স অ্যাপোলজি’। থার্ড সেমেস্টারে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং অসহ্য মনে হল মহানের। কারা যেন বলেছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও গণিত আছে। তা আছে, তবে তাতে মন ভরে না যে।

থার্ড সেমেস্টারেই বিদ্রোহ করলেন মহান। জানালেন, ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়েছেুড়ে কানপুর আইআইটি-তেই গণিত নিয়ে পড়তে চান। বাড়িতে সবার মাথায় হাত। মহান নাছোড়। বহাল রইল তাঁর জেদ। নিয়ম অনুযায়ী বিভাগ বদলের সুযোগ মেলে সেকেন্ড সেমেস্টারের শেষে। মহান যে তৃতীয় ষাণ্মাসিকের পর বিষয় বদলের অনুমতি পেলেন, তা তাঁর পছন্দের গুণে। কে আর ইলেকট্রিকাল ছেড়ে ‘কম দামি’ গণিতে আসতে চায়?

১৯৯২। কানপুর আইআইটি থেকে গণিতে এমএসসি। তার পর পিএইচ ডি করতে বার্কলে শহরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় জ্যামিতি। ১৯৯৭ সালে পিএইচ ডি।

বিদেশবাসকালে জীবনের আর এক সিদ্ধান্ত। আসলে ডাকটা মনের মধ্যে ছিল আইআইটি-তে ছাত্রাবস্থাতেই। আহ্বান আধ্যাত্মিকতার। স্বামী বিবেকানন্দের। সন্ন্যাস জীবনের। দেশে ফেরার পর মাত্র কয়েক মাস চেন্নাইয়ের ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিকাল সায়েন্সেস-এ। ১৯৯৮ সালে মহান যোগ দিলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। ২০০৮-এ পুরোদস্তুর গেরুয়াবসন সন্ন্যাসী। পরিবারের সায় ছিল না। জ্যামিতি আর আধ্যাত্মিকতা? তেল আর জল? মহান তা মনে করেন না। মিশন দুই শিক্ষা দেয়। সেবা এবং সন্ধান। সেবা হল পড়ানো। জ্যামিতির জ্ঞান ছাত্রদের বিলিয়ে দেওয়া। আর সন্ধান? তা আত্মিক প্রচেষ্টা। ক্রমাগত সত্যের খোঁজ। গভীরে, আরও গভীরে।

মহানের সত্যসন্ধান গণিতের যে শাখায়, যেখানে বীজগণিত হাত ধরেছে টপোলজি-র। বীজগণিত নিজে হজম করেছে পাটিগণিত। মাইনাস ১-এর বর্গমূল কত, তা পাটিগণিত বলতে পারে না। সে ব্যর্থতার তোয়াক্কা না করে বীজগণিত এগিয়ে যায় অনেক দূর। আবিষ্কার করে নতুন ভুবন। আর টপোলজি? তাকে এক কথায় বলে ‘রাবারশিট জিয়োমেট্রি’। মানে, রবারের চাদরে আঁকা নকশা। চাদরটাকে বাঁকালে বা মোচড়ালে নকশার চেহারা বদলায়, চরিত্র নয়। আসলে, টপোলজি হল জ্যামিতির সেই উন্নত রূপ, যা থেমে থাকে না মাত্র তিন মাত্রায় (ডান-বাম, উপর-নীচ, সামনে-পেছনে), কাজ করে পছন্দমত অনেক মাত্রা নিয়ে। সে সব মাত্রায় বিন্দু রেখা ত্রিভুজ বা বহুভুজ ধারণ করে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর আকৃতি। এমন সব আকার, যা কেবল বিরাজ করে মনের আকাশে। ও সব কাল্পনিক আকার সৃষ্টির চর্চা মোহময় করে তোলেন সেই আদিগুরু ইউক্লিড। নাহ্, ভুল হল। বরং বলা উচিত ছিল, জ্যামিতি এগোয় সেই আদিগুরুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণায়। ইউক্লিড তাঁর শাস্ত্র গড়ে তুলেছিলেন পাঁচটি দাবিকে সত্যি ঘোষণা করে। প্রথম চারটে নিয়ে ঝামেলা নেই। কিন্তু, পঞ্চমটা একটু নড়বড়ে। কী সেটা? কোনও বিন্দুগামী নির্দিষ্ট সরলরেখার সমান্তরাল একটা মাত্র সরলরেখা সম্ভব। ওই দাবি অগ্রাহ্য করলে গড়ে ওঠে যে জ্যামিতি, তা প্রসব করে হরেক সম্ভাবনা। টপোলজির খেলা সেই অমিত সম্ভাবনা নিয়ে।

প্রয়াত মার্কিন গণিতজ্ঞ উইলিয়াম থার্সটন চার দশক আগে পেশ করেছিলেন এক অনুমান: ‘থার্সটন জিয়োমেট্রাইজেশন কনজেকচার’। সে অনুমান অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন মহান। দেখিয়েছেন, তা প্রয়োগ করা যায় অনেক ক্ষেত্রে। মহানের সাফল্যকে বিশ্ববরেণ্য গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস বরাদান বলেছেন ‘ইম্পর্ট্যান্ট মাইলস্টোন’। কৃতিত্বের জন্য মহান ২০১১ সালে পেয়েছেন শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার। ভারতে বিজ্ঞানের সেরা শিরোপা। ২০১৫ সালে ইনফোসিস প্রাইজ। অর্থমূল্য ৬৫ লক্ষ টাকা।

সে অর্থ মহান দান করেছেন ত্রিবেণী ট্রাস্টকে। যে ট্রাস্ট গড়েছেন পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর সংগ্রহে বহু প্রাইজের অর্থ (বেশ কয়েক কোটি টাকা) ঢেলে। ট্রাস্টের উদ্দেশ্য? হিতকর শিক্ষাপ্রসারে অনুদান।

মহান দুঃখিত— হয়তো বা ক্রুদ্ধও— এক ব্যাপারে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভারতে বহু জায়গায় গণিতের বস্তাপচা সিলেবাসে। দশকের পর দশক একই চ্যাপ্টার পড়ান যে শিক্ষক, তিনি তো ছাত্রের সর্বনাশই করেন। তবু এটা কেন চালু? মহানের সোজাসাপটা ব্যাখ্যা: জাতি হিসেবে আমরা কুঁড়ে, তাই।

শিক্ষক হিসেবে? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক শুভব্রত দাস পিএইচডি করেছেন মহানের কাছে। ‘প্রথমে মনে হয়েছিল স্যর কড়া। পরে বুঝেছি, সেটা আমার ভালর জন্য। এটা ওঁর ছাত্র হওয়ার প্রাপ্তি।’

আর ছাত্র মহান? কানপুর আইআইটি-তে ওঁর অধ্যাপক ছিলেন বরুণেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মন্তব্য: ছাত্র হিসেবে ও আমাদের নজর কেড়েছিল। শুধু রেজাল্ট ভাল করার জন্য নয়। স্পষ্ট কথা বলার জন্যও। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট-এ ছিলেন এক দূরদর্শী শিক্ষক। ফাদার বুশে। স্বল্পবাক ওই শিক্ষক মহান সম্পর্কে ছিলেন খুব আশাবাদী। ওঁর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE