Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চাপের মুখে অবিচল, সাফল্যেও সুস্থির

তারকাসুলভ দম্ভ নেই, নীরবে কাজ করতে ভালবাসেন। মাঠের মধ্যেও আবেগে সংযত, আর মাঠের বাইরেও বরাবর মাটিতে পা রেখে চলা মানুষ। ঋদ্ধিমান সাহা তাঁর নিজের মতো।তারকাসুলভ দম্ভ নেই, নীরবে কাজ করতে ভালবাসেন। মাঠের মধ্যেও আবেগে সংযত, আর মাঠের বাইরেও বরাবর মাটিতে পা রেখে চলা মানুষ। ঋদ্ধিমান সাহা তাঁর নিজের মতো।

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৫৩
Share: Save:

ঋদ্ধিমান সাহার প্রিয় ঘড়ির ব্র্যান্ড? রোলেক্স বা টিসো হবে নিশ্চয়ই।

একেবারে ডাহা ফেল। ঋদ্ধির কোনও প্রিয় ঘড়ির ব্র্যান্ডই নেই।

ঋদ্ধিমান সাহার প্রিয় শার্ট ব্র্যান্ড? এড হার্ডি না আরমানি?

পুরো গোল্লা। শার্টের ক্ষেত্রেও ঋদ্ধির কোনও প্রিয় ব্র্যান্ড নেই!

আচ্ছা, ঋদ্ধিমান সাহার ঠিকানাটা কী? বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বা অডি দাঁড়িয়ে থাকবে নিশ্চয়ই। সেটা দেখে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-উত্তর যুগের তারকা বাঙালি ক্রিকেটারের বাড়ি পৌঁছে যাওয়া সমস্যা হবে না।

সম্পূর্ণ ভুল পথনির্দেশিকা হল। ঋদ্ধির একে তো কোনও প্রাসাদ-সুলভ বাড়ি নেই যে, গুগ্‌ল সার্চে দিলেই নিউজ আর ইমেজেস অপশন আসবে। তিনি থাকেন সাউথ সিটি কমপ্লেক্সে একটা ডুপ্লে নিয়ে। যেটা সফল ক্রিকেটারের পৃথিবীতে আহামরি কিছুই নয়। কলকাতায় খেলতে আসা অনেক বিদেশি ফুটবলারের ঠিকানাও ওটা।

এখনকার দু’তিন মরসুম আইপিএল খেলা ক্রিকেটারের গ্যারাজে যেমন বিএমডব্লিউ বা মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে, তাঁর তেমন নেই। টেস্টে ভারতীয় দলের এক নম্বর উইকেটকিপার (পণ্ডিতদের মতে, বিশ্বের সেরা কিপারও) হয়েও নেই। দিবারাত্র মার্সিডিজ বা বিএমডব্লিউ কেনার স্বপ্ন দেখেন বলেও কখনও শোনা যায়নি।

বরং তাঁর পৃথিবীটাই হচ্ছে বরাবর মাটিতে পা রেখে চলা এক নায়কের। যিনি মাঠে উড়ন্ত ক্যাচ ধরে ক্রিকেট বিশ্বকে মুগ্ধ করেন। কিন্তু তারকার রঙিন আকাশে ওড়েন না। ঋদ্ধিমান সাহাকে ক্রিকেটীয় মতে ব্যাখ্যা করতে হলে স্রেফ রবি শাস্ত্রীর মন্তব্য তুলে দেওয়া যায়। ‘দেখতে যত ছোটখাটো, ততটাই সিংহহৃদয় ক্রিকেটার,’ তাঁর ‘লাইক আ ট্রেসার বুলেট’ ভঙ্গিতেই বলেন ভারতীয় দলের প্রাক্তন টিম ডিরেক্টর শাস্ত্রী।

টেস্ট দলে তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উত্তরসূরি। মানসিকতার দিক থেকে দুজনের দারুণ মিল। ধোনি যদি ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হন, ঋদ্ধিমান হচ্ছেন ‘কিপার কুল’। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের মতোই আবেগের ওপর অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ ঋদ্ধির। টেস্ট সেঞ্চুরি করেও কখনও বন্য বিজয়োৎসব করতে দেখা যায়নি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সদ্য-সমাপ্ত টেস্ট সিরিজে এমন উত্তাপ ছিল। চেতেশ্বর পূজারার মতো ধীরস্থির ক্রিকেটার পর্যন্ত আবেগপূর্ণ সেলিব্রেশন করলেন। রাঁচিতে সেঞ্চুরি করে ঋদ্ধি শান্ত, সংযত।

ধোনির চালু করে যাওয়া ‘কুল’ ক্লাবের পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন ঋদ্ধি। দুজনের কারও মধ্যে কোহালিয়ানার তীব্র শরীরী ভাষা নেই। বরং নীরব ভঙ্গিতে নিজেদের কাজ সারতে ভালবাসেন। বাইরে জল, ভিতরে আগুন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে এমন গণ-স্লেজিংয়ের মধ্যেও ঋদ্ধি ছিলেন আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব। এক বারই শুধু জস হেজ্‌লউড-কে হাত নাচিয়ে বলেছিলেন, যাও যাও বল করো।

মাটিতে পা রেখে চলা তো বটেই। ঋদ্ধিমান সম্ভবত ভিড়ের মধ্যে পথ চলতে থাকা এক তারকাও। ‘নেক্সট ডোর হিরো’র মতো। পাঁচ তারা হোটেলে গিয়ে কন্টিনেন্টাল ডিশ অর্ডার না দিলে ডিনার সেলিব্রেশন হল না, এমন কোনও ব্যাপার নেই। বরং গুজরাতি থালি হলেই দিল খুশ!

ওয়েস্ট ইন্ডিজে জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, ইডেনে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার পরেও খোলা মাঠে মোহনবাগানের হয়ে ময়দানে স্থানীয় ক্রিকেটে খেলতে নেমে গেলেন। এবং, ফিল্ডিং করতে শুরু করে দিলেন কি না বাউন্ডারি লাইনে! হাসিমুখে ডেলিভারির ফাঁকে অটোগ্রাফ দিলেন ভক্তদের। কোথায় তারকাসুলভ দম্ভ! কোথায় বিশেষ নিরাপত্তার বলয়!

ঋদ্ধিমানের কোনও ইগোও নেই। অধিনায়ক হওয়ার পর কোহালি নতুন যে ‘টিম ইন্ডিয়া’ গড়ে তুলতে চাইছেন, তাতে ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকবে না। দেখা হবে শুধুই দলের স্বার্থ। নিজের সেঞ্চুরির চেয়েও বিরাট-যুগে ম্যাচ জেতানো ৪৫ বেশি মর্যাদা পাবে। বেশি প্রশংসিত হবে। সেই মডেলে ঋদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য। টিম কোহালির টিমম্যান।

গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই যেমন। টেস্ট ম্যাচের সকালে তাঁর কাছে গিয়ে কুম্বলে বললেন, ‘আমাদের একটু ব্যাটিং অর্ডারটা পালটাতে হচ্ছে। তোমার জায়গায় ছয় নম্বরে ব্যাট করতে যাবে অশ্বিন। তুমি যাবে সাতে।’ ঋদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলেন, তিনি যে কোনও জায়গায় নামতে তৈরি।

ধোনির মতোই চাপের মুখে অবিচল থাকতে পারেন। ব্যাটিং পারফরম্যান্স নিয়ে বার বার কথা উঠেছে। প্রত্যেক বারই প্রত্যাঘাত করেছে তাঁর ব্যাট। তা বলে বোকা বনে লাভ নেই। ঋদ্ধির বাড়ি গেলে টেস্ট সেঞ্চুরি বা উড়ন্ত ক্যাচের স্মারক না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ও সবে তাঁর আগ্রহ নেই। ম্যাচ হয়ে গেল মানে তিনি সেই স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। ঢুকে পড়তে পারেন প্লে-স্টেশনে। অথবা কলকাতায় থাকলে হয়তো আরামবাগ বেরিয়ে পড়লেন!

হ্যাঁ, আরামবাগ। সেখানে রিঙ্কু নামে একটি ছেলের বাড়ি। ক্রিকেট জীবনের শুরুতে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় আসা ঋদ্ধিমান থাকতেন কোলে মার্কেটের মেসে। কমন বাথরুম, ছোট্ট ঘরে তিন-চার জন উঠতি ক্রিকেটারের সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে দশ-বারো বছরের সেই পর্বটাই বাইশ গজে লড়াইয়ের মানসিকতাটা তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর মধ্যে। সেই মেসেই তাঁদের দেখাশুনা করত রিঙ্কু। বছরখানেক আগে রিঙ্কুর আরামবাগের বাড়ি ঘুরে গেলেন ঋদ্ধি। তত দিনে তিনি ভারতের এক নম্বর টেস্ট কিপার!

ব্যক্তিগত অতীত গৌরব নিয়ে আহ্লাদিত থাকতে চান না। তা বলে অতীতের বন্ধুত্ব, সমর্থনও ভোলেন না। রাহুল দ্রাবিড়ের মতোই দর্শন তাঁর যে, ‘মানুষ হিসেবে কেমন ছিলাম’ সেটাই লোকে বেশি করে মনে রাখবে। চলার পথে কিছু রান এবং ক্যাচ যুক্ত হবে তাঁর নামের পাশে। ঘর সাজানোর সময় সেগুলো দেখে হয়তো স্ত্রী রোমিকে বলে ফেলবেন গৃহকর্তা ঋদ্ধিমান সাহা— ওগুলো ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে টাঙানোর কী দরকার! শুধু শুধু জায়গা নষ্ট হচ্ছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE