Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রঙ্গিলা বঙ্গালির শর্ট ইতিহাস

এই জাতি কেন বিলুপ্ত হল তা নিয়ে এখনও ঐকমত্যে পৌঁছনো যায়নি। সুন্দাগি বলেন, এক বৃহৎ ভূমিকম্পে গোটা পশ্চিমবঙ্গ লুপ্ত হয়। বুলুন্গাশের মতে, ভূমিকম্পটি হয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু তা প্রাকৃতিক কারণে নয়।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

যদিও রোহেনতাল বলছেন জাতটির নাম খুব সম্ভব ‘বঙ্গিলা’ বা ‘রঙ্গিলা’ (ওই জাতির বর্ণমালায় ‘ব’ ও ‘র’ কাছাকাছি ছিল, একটি ফুটকির এ-দিক ও-দিক মাত্র), তবু আমাদের দৃঢ় ধারণা, জাতটির নাম ছিল ‘বাঙালি’। দু’হাজার বছর আগে লুপ্ত ও কুঁকড়ে যাওয়া, শুখা, অন্ধকার একটি গুটলি-রাজ্য থেকে হকিং-রেডিয়েশন এবং চমসস্কি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটা পুচকে জাতি সম্পর্কে জ্ঞান সংগ্রহ এমনিতেই খুব কষ্টকর, তার ওপর ক্রমাগত আমাদের গোষ্ঠীর পণ্ডিতদের এই ব্যঙ্গের শিকার হতে হচ্ছে যে এমন অকিঞ্চিৎকর একটা জাতি নিয়ে আমরা একের পর এক পেপার প্রকাশ করে চলেছি শুধু মার্জিন ভনাত্লি পুরস্কার বাগাবার জন্য, তবু আমি বলব, বাঙালি বিষয়ে আমাদের জানার প্রয়োজন আছে। যেমন জীবজগতে পিঁপড়ে গুরুত্বহীন ছিল না, কিছু না হোক তারা নিরীহ মানুষের নিতম্বে কামড়ে এক প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করত, তেমনই বাঙালি জাতিটিও তার নিরন্তর ক্যাঁওক্যাঁও ও ঘ্যানঘ্যানে পৃথিবীকে তিতিবিরক্ত ও জাগ্রত রাখত। বলে রাখা দরকার, আমাদের গবেষণা শুধু পশ্চিমবাংলার বাঙালি নিয়ে, অন্যত্র এই জাতি কী করেছিল, তা নিয়ে অন্য গোষ্ঠী রিসার্চ করছে।

এই জাতি কেন বিলুপ্ত হল তা নিয়ে এখনও ঐকমত্যে পৌঁছনো যায়নি। সুন্দাগি বলেন, এক বৃহৎ ভূমিকম্পে গোটা পশ্চিমবঙ্গ লুপ্ত হয়। বুলুন্গাশের মতে, ভূমিকম্পটি হয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু তা প্রাকৃতিক কারণে নয়। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া সাড়ে ছ’শো ফুট উঁচু ফ্লেক্স গোটা রাজ্যে তিন পা অন্তর বসানোর ফলে, মোট ১১৭৬৩০৪৯২৫২১৩৪১টি ফ্লেক্সের ভার সহ্য করতে না পেরে রাজ্যটি হুড়মুড়িয়ে ধসে, গুঁড়িয়ে যায়। চন্দ্রযান স্পুফি-০২ থেকে তখন শুধু একটি ফ্লেক্সের ন্যাজে ‘তাঁর প্রেরণায়’ কথাটি পড়া যাচ্ছিল। মবিলু বলেছেন, এ সব কিচ্ছু ঘটেনি, এক দিন সহসা ঘর থেকে বেরিয়ে বেশ কিছু বাঙালি দেখতে পায়, রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। এতগুলি দশাসই ও তিনতেড়িয়া উন্নয়ন দেখে তারা হার্টফেল করে। উন্নয়নরা তখন সেই লাখ লাখ বাঙালির ঘরবাড়ি, দোকানপাট, চিলেকোঠা-গর্ভগৃহ দখল ও দাপিয়ে ভোগ করছে দেখে, বাকি বাঙালিরা ঈর্ষায় হাত কামড়ে মারা যায়। কেন্দ্র থেকে হাতের মলম সাপ্লাই হয়, কিন্তু সেই মলম তারা লাগাতে পারেনি, হাতই তো নেই। বিশিমপু বলেছেন, বাঙালি নিশ্চিহ্ন হয়েছে দানবিক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায়। কিন্তু ভুসুক গ্রোভিন দেখিয়েছেন, এই জাতি একটিমাত্র সোজাসাপ্টা বনাম-বাজিতে আটকে থাকার মতো পাতিকুচুটে নয়। এখানে শয়ে শয়ে দাঙ্গা একইসঙ্গে লেগে গিয়েছিল। হিন্দু বনাম মুসলিম, চাকুরে বনাম ব্যবসায়ী, আইপিএল বন্ধ করো বনাম আইপিএল চলুক, অটো ইউনিয়ন বনাম যাত্রিসমিতি, সিন্ডিকেট ক বনাম খ বনাম ঙ বনাম ছ বনাম ঘ বনাম ক্ষ, সৃজিত ফ্যান ক্লাব বনাম শিবপ্রসাদ অনুরাগী সংঘ, মাল্টিস্টোরি বনাম ঝুপড়ি, #মিটু বনাম শেরশভিনিস্ট, ফেসবুকে-আলাপ-হয়ে-বিয়ে বনাম বিয়ে-হয়ে-ফেসবুকে-আলাপ, কমোডপন্থী বনাম উবুসমর্থক— এমন সহস্র যদুবংশ-ছাপ্পা লড়াইয়ে রাজপথে কাটামুন্ডু গড়াগড়ি যেত। এই বিবদমান দলগুলি মাঝে মাঝেই ওভারল্যাপ করত, এমনকী দ্বন্দ্বমূলক খুনোখুনিরও জন্ম দিত, কেউ হয়তো অটোওলাকে গুলি করতে গিয়ে দেখল, আরে, গত বেস্পতিবার এরই পাশে দাঁড়িয়ে ‘ক্রিকেটার সৌরভ বড়’ মোর্চার পক্ষে ‘কুইজমাস্টার সৌরভ বড়’ ফ্রন্টকে কুচিয়ে কবন্ধ বানিয়ে এসেছে, তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু সে পেটে ছুরি হাঁকড়ে দিল কারণ দেখেছিল এই লোকটাকে ‘মিছিলে মেশিনগান নাচাও’ গ্রুপে, এ দিকে সে দৃঢ় ত্রিশূলবাদী।

জটজটিল এই জাতি কেমন করে নিকেশ হল, না ভেবে আমরা তাদের বেঁচে থাকার তরিকার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারি। কিন্তু সেও কম প্যাঁচালো নয়। তাদের যে ক’টি সিরিয়াল উদ্ধার করা গেছে তা থেকে জানা যায় তারা কোনও কাজ করত না, শুধু বিশাল বৈঠকখানায় সেমিসার্কলে দাঁড়িয়ে সারা দিন অন্যের নিন্দে করে যেত, তাদের মোক্ষ ছিল বিয়ে করা ও নতুন বউকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে অত্যাচার করা, নতুন বউরা হত মৃদুভাষী ন্যাকা ও বিলাপবাজ, পুরনো বউরা হত কুচক্রী ভিটভিটে রক্তখাকি, কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় নতুন বউ পুরনো হতে হতে ক্যালাকান্ত থেকে ভয়ভিলেনে রূপান্তরিত হত, জানা যায়নি। অবশ্য বুলিপান্টি তর্ক তুলেছেন, সিরিয়ালগুলির সঙ্গে বাঙালির বাস্তব জীবনের কোনও যোগ ছিল না, সিআইএ-র পয়সা খেয়ে কিছু লোক বাঙালিকে জড়বুদ্ধি ও ভোমভোঁদাই করে তুলবে বলে এগুলি বানিয়েছিল ও নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তা হলে অবাস্তব এই গোল্লাগুলি বাঙালি হেদিয়ে গিলেছিল কেন? তা ছাড়া সিরিয়ালে কখনও দেহঘনিষ্ঠতা দেখা যেত না, এবং আমাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে বাঙালি বাস্তবেও প্রায় কখনওই অঙ্গসঙ্গ করত না, শুধু মোবাইলে পর্নোগ্রাফি চাখত ও বাসেট্রামে অবলোকনকাম চরিতার্থ করত, সে ক্ষেত্রে তো সিরিয়াল জীবনকেই প্রতিফলিত করছে। টিভিতে নিউজ চ্যানেলের কিছু অংশ দেখে আমরা বুঝতে পারি অধিক বুদ্ধিমান বাঙালি গরমকালেও কোট পরত এবং তার চার পাশের লোক যখন পরস্পরের সঙ্গে এমন ইতর ও অনবরত ঝগড়া করত যে কারও কোনও কথা বোঝা যেত না, তখন সে ‘ব্রেএএক’ বলে চেঁচিয়ে উঠত। বোঝাই যাচ্ছে গাড়ির ব্রেক থেকে এই কথাটি এসেছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা যায়, বাঙালি ইংরেজি শব্দকে মান দিত বেশি। তারা পায়খানা না বলে ‘পটি’, অসামান্য না বলে ‘অসাম’ (আন্য-র শ্রমটা বেঁচে যেত) এবং ঠাকুর না বলে ‘টেগোর’ বলত। যদিও ‘দুর্গা টেগোর দেখে এলাম’ বললে চড়াং রেগে যেত।

গড় বাঙালি ছিল পয়সাহীন ও নাক খুঁটতে উৎসাহী। সে ত্রিফলা আলোর স্ট্যান্ডে টিকি বেঁধে পড়াশোনার চেষ্টা করত, কিন্তু অত কম পাওয়ারের আলোয় কিছু দেখতে পেত না বলে গ্যাদাড়ে ফেল মারত। আইএএস আইপিএস পরীক্ষায় আমল না পেয়ে সে হোয়াটস্যাপে চুটকি মুখস্থ করত এবং অন্য সম্প্রদায়কে ‘অশিক্ষিত’ বলত। নিজেকে সে ডাকত ‘বঞ্চিত’ এবং তাকে একটা নোবেল প্রাইজ দিলেও সে ‘দুঁটোঁ কেন দিলেঁ নাঁ’ মিড়ে ফুঁপিয়ে উঠত। সে আত্মকেন্দ্রিক ছিল না, সারা ক্ষণ প্রতিবেশী বা সহকর্মী কেমন জামা পরছে কী মাইনে পাচ্ছে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকত, এমনকী বাঙালি কবি ও সিনেমাকাররা নিজেদের কাজ চুলোয় দিয়ে অনবরত অন্য কবি ও সিনেমাকার কী খাচ্ছেন কোন পুরস্কার পাচ্ছেন কার সঙ্গে শুচ্ছেন সেই খবরে উপুড় হতেন। বাকি সময়টা বাঙালি নিজের কোষ্ঠকাঠিন্য বা আমাশার কথা ভাবত, জিজ্ঞেস করলেই বলত রবীন্দ্রনাথের কথা ভাবছি। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ছিল এক বৃহৎ শিল্প-সংগঠন, যা অসামান্য সাহিত্য ও সংগীত সৃষ্টি করে বাঙালির সংস্কৃতিকে এক ধাক্কায় অনেকটা উচ্চতায় নিয়ে যায়। যদিও রোহেনতাল বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ আসলে এক জন নির্দিষ্ট ব্যক্তি, কারণ তাঁর একটি সর্বজনস্বীকৃত দাড়িওলা ছবি পাওয়া গেছে, কিন্তু এই নামে প্রকাশিত রচনাগুলির স্রেফ পরিমাণ দেখলেই একটি শিশুও বলে দিতে পারবে, কোনও এক ব্যক্তির পক্ষে এত লেখাই সম্ভব নয়, আঙুলে পক্ষাঘাত হবে। আর, এক জন মাত্র মানুষকে যদি ওই তুঙ্গস্পর্শী ভাবনাগুলি ভেবে, তার পর তা অমন অতুলনীয় সুললিত ভাষায় লিখতে হয়, তা হলে, আমাদের কম্পিউটারের মতে, ন্যূনতম ১২৫৪৮ বছর লাগা উচিত। কিন্তু কেন যে গোটা বাঙালি জাতি মিলে একটি বৃহৎ সংগঠনকে এক জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দিল, এবং কেউ ভুলেও এক বারও মুখ ফসকে সত্য উদ্ঘাটন করে ফেলল না, সেই রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়নি। এও বোঝা যায় না, কেনই বা ১৯৪১ সালে সহসা সংগঠনটি সর্বৈব ভেঙে গেল।

অবশ্য তার পর আর এক সংগঠন বাঙালির মানস-গঠন ভেঙে গড়ার কাজে নিযুক্ত হয়, তার নাম সিপিয়েম। এরাও সাহিত্য রচনা করত এবং লাল সালু মোড়া দোকানে তা বিক্রি করত। লেনিন ও স্তালিন দুই ভাই এই দলের ম্যানিফেস্টো লিখে দেন। যদিও স্যুতিয়েন ৎঝ্যাং (সুতিয়াঁ ঝাউমাই নয়) বলেছেন, এঁরা সহোদর নন, মাসতুতো ভাই। অবশ্য তিনাত্রেক বলেছেন, মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন ও স্তালিন চার ভাই এক পরিবারের ছিলেন, সেই পরিবার জ্যোতি বসু নামক এক বাঙালিকে দত্তক নেয় ও তিনি সহসা রাশিয়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসে বাংলায় সিপিয়েম স্থাপন করেন, কিন্তু এই তত্ত্বে সন্দেহের অবকাশ আছে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কি রাশিয়া থেকে হিন্দুস্তান পার্ক হেঁটে আসা সম্ভব? অবশ্য ভূমিতপিষাণ জানিয়েছেন, ওই কঠোর পরিশ্রম ও অমানুষিক ঠান্ডায় আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলেই জ্যোতিবাবু কখনও কোনও বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারতেন না, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন, শুধু অসম্পূর্ণ বাক্য ব্যয় করে তিনি একটি গোটা সংগঠন গড়ে তুললেন, যা কিনা বাঙালি জাতিকে এই কথা বিশ্বাস করাতে পারল, প্রতিটি বাঙালির অন্তর্বাসের রং অবধি ঠিক করে দেওয়ার ঠেকা সিপিয়েম পার্টির নেওয়া উচিত? তারা পাড়ার ফুটবল খেলোয়াড় থেকে রক্তদান শিবিরের সুঁই-ফোঁড়ক, কলেজের ক্যান্টিনকর্মী থেকে ভাইস চ্যান্সেলর, দোকানের মুদি থেকে আলুর বস্তার আরশোলা, সকলের ঘিলুতে এই বাক্য সেঁধিয়ে দিতে পারল: তোমায় কাজ করতে হবে না, সিপিয়েম করতে হবে! আবার বুভুনদাস বলেন, বাঙালি চির কালই অকর্মা ছিল, এত দিন শুধু একটি তত্ত্বে হেলান দিতে চাইছিল যা তার অতিমানবিক আলস্যকে প্রশ্রয় দেবে, দিব্যি দিয়ে বোঝাবে, ফাইল ঠেলার চেয়ে ব্রিগেডে মিটিং ভরিয়ে ছোলাভাজা খেলে সমাজের অধিক উপকার হয়। কিন্তু যা উপেক্ষা করলে চলবে না, সিপিয়েম সত্যিকারের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। যখন এক প্রফেসর দেখতে পাবেন, তাঁকে পার্টির লোফার এসে কান ও কলার মুচড়ে হিড়হিড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, তখন তাঁর মাথায় ঢুকবে, তিনি ওই লোফারের তুলনায় এতটুকু উঁচু দরের মানুষ নন, তখনই মানুষের উঁচু-নিচু স্তরবিভাজনের প্রথাটির প্রতি তাঁর, ও তাঁকে থাবড়া খেতে দেখা মানুষের গভীর বিবমিষা উপস্থিত হবে। তখনই মানুষ সব মানুষকে সমান ভেবে ‘ভাই আমার’ বলে বুকে টেনে নিতে পারবে।

কিন্তু সিপিয়েমের বিরুদ্ধে কিছু ছাত্রযুব খেপে ওঠে। তারা বলে, নির্বাচনগন্তব্য পার্লামেন্টের চেয়ার অত্যন্ত নড়বড়ে, ওতে বসলে শিরদাঁড়া বেঁকে যায়। তারা এক জন চেয়ার-নির্মাতার বক্তৃতা ও তাঁরই লেখা ছোট একটি বইয়ের শ্লোক পড়ে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ হয়। আলসিমা-২২ বলেন, সিপিয়েমের পান্ডা হতে গেলে পড়তে হত চার খণ্ডের মোটা বই, যেখানে বিদ্রোহী নকশালদের পড়তে হত মাত্র একটা পাতলা লাল বই, সে জন্যই সে দল হইহই ভারী হতে থাকে। প্রচার হয়ে যায়, বিপ্লব এলে সিলেবাস বদলে যাবে, তাই পড়াশোনা চালাবার মানে হয় না। অনেকেই কলেজ ছেড়ে মহানন্দে গুলিগোলা হাঁকড়ায়, ‘এখন খুন করি, পরে পড়ে নেব’ বলে মা-বাবাকে প্রবোধ দেয়। উলবারেক অবশ্য সম্পূর্ণ উলটো মত পোষণ করে বলেন, উজ্জ্বল ছাত্রেরাই নকশাল হয়েছিল (মার্কশিটের ফোটোকপি না দেখালে দলে নেওয়া হত না), তাদের অনুপ্রেরক ‘চেয়ারম্যান’ আসলে চেয়ার তৈরি করা মানুষ নন, তিনি ঠিক করতেন সমাজে কে কোন আসনে বসবে, এবং তিনি চিন দেশের লোক। কিন্তু এখানে তর্ক আছে। এক দল লোক রাশিয়ার লোকের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হল, তাদের বিরোধী দলও চিনের লোক দ্বারা উদ্বুদ্ধ হল? বাঙালির নিজের এলাকায়, এমনকী নিজের দেশে, কোনও বড় মাপের চিন্তক পাওয়া গেল না, যাঁর ভাবনায় তারা উদ্বুদ্ধ হতে পারে? মিলতারেক অবশ্য এই তত্ত্বটিকেই আঁকড়ে ধরে বাঙালির ‘বাধ্যতামূলক পরনির্ভরতা ও সুতরাং অবধারিত আত্মগাড্ডু খাওয়া’ সূত্র এগিয়ে নিয়ে গেছেন, দেখিয়েছেন, অনেক পরেও বাঙালি সেঁকো-বিদ্বজ্জনরা স্রেফ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতামত ও বইয়ের ব্লার্ব ব্যাখ্যা করে নাম কিনতেন, নিজে কোনও তত্ত্ব বা মৌলিক চিন্তার জন্ম দেওয়া তাঁদের ক্ষমতার সাতশো মাইল বাইরে ছিল।

নকশালরা ত্রাসবিশাল হওয়ার উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে এন্তার খুনোখুনি লাগিয়ে দেয়, তখন সিপিয়েম তাদের ধরে বেধড়ক খুন করতে থাকে, আর কংগ্রেস নামে একটি সংগঠন দু’পক্ষকেই খুন করতে থাকে। মস্তাক্ষির বলেছেন, এ ছিল আসলে একটি সাংঘাতিক বেড়ে যাওয়া জনসমষ্টির নিজের সংখ্যা কমিয়ে আনার অবচেতন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ, মুস্তাচেড বলেছেন এ ছিল এই রক্ষণশীল জাতির অবদমিত যৌনতা থেকে উৎপন্ন প্রকাণ্ড হতাশা ও ক্রোধের অন্যত্র-পাইপ-লিক, প্লুহা-২৩ বলেছেন বাঙালির সাফল্যঘেন্না ও পরাজয়বিলাসের বুদ্বুদ-তোড় এই বাস্তবকে উৎপাদন করেছিল: ঢালাও শহিদের (‘পরাজিত অথচ বীর’ নকশালদের) জন্ম দেবে বলে। ভ্রংস্কির ধারণা, একটি ভিতু জাত নিজেদের হাতে পিস্তল দেখে আমূল রোমাঞ্চিত হয় ও সেই পুলক-দশায় আত্মগ্রস্ত হয়ে শেষ অবধি লক্ষ্যব্যর্থ হয় ও ৩২২৯ ভাগে ভেঙে যায়। বহু দিন আগে এক প্রভাবশালী মহিলার অঙ্গ টুকরো টুকরো হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে ও সবখানে একটি করে পীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। নকশালদের গনগনে ক্রোধের ফুলকিও সে ভাবেই এই যুগের বহু পরেও অনেক স্থানে ছিটকে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে, এমনকী বহু পালিয়ে-বাঁচা নকশাল সন্ধেবেলা বিদিশি মদ খেতে খেতে সমাজ-ব্যবচ্ছেদ ও ‘আগে কী সুন্দঅঅর বোম ফাটাইতাম’ জারি রাখেন। অবশ্য পন্তান দেখিয়েছেন, নকশালদের খুব বুদ্ধি ছিল এ কথা কখনওই বলা যায় না, কারণ তারা স্লোগান দিয়েছিল, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরব, কিন্তু কিলোগ্রাম তো গ্রামের চেয়ে বেশি।

সিপিয়েম এদের উপেক্ষা করে চমৎকার রাজত্ব কায়েম করে বসে, কিন্তু সহসা তারা ক্রোশ ক্রোশ জমি জুড়ে ধানের বদলে গাড়ির চাষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গাড়ি সোজা গজাবে না অষ্টব্যাঁকা এবং জলের বদলে পেট্রল সেচ করতে হবে কি না, সবচেয়ে বড় কথা গাড়ি ভেজে খেতে হবে না ডালনা করে, সে তর্কে খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায় ও পুলিশের সঙ্গে সিপিয়েমের ক্যাডারেরা হাওয়াই চটি পরে সাধারণ মানুষদের মারতে লাগে। হাওয়াই চটি দেখে সবার তখন এক বিশ্বখ্যাত বাঙালি অভিযাত্রীর কথা মনে পড়ে, যিনি ওই ফরফরে চটি পরে দার্জিলিং গেছেন এবং রোমে গিয়ে বাংলা গান প্রচলন করেছেন। তাঁর দল ‘তৃণমূল’কে তখন বাঙালি হইহই করে মসনদে বসায়। কিন্তু এই ব্যাপারে পণ্ডিতদের প্রকাণ্ড ধোঁয়াশা আছে। সকলেই একমত, মানুষটি এক মহিলা, এবং তিনি পুরুষপূজক এলিটপূজক সূক্ষ্মতাপূজক বাঙালি সমাজের পেট ফাটিয়ে বেরিয়ে তেজোদীপ্ত ভুল উচ্চারণে সিংহনাদ করেন, কিন্তু প্লটিসুম বলেন, তিনি আদৌ অভিযাত্রী ছিলেন না, অর্থনীতিবিদ ছিলেন এবং সিঙাড়া শিল্পকে হেভি ইন্ডাস্ট্রির মান দিয়ে দুরন্ত তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিলেন (যদিও অন্য এক বাঙালি লবি করে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে যান)। মনপদ্ম-৩৪ বলেন, একদমই না, তিনি আসলে ছিলেন এক অবিশ্বাস্য সাহিত্যিক, যিনি মিনিটে সাতটা বই লিখতে পারতেন এবং প্রতিটি ‘কলকাতা বইমেলা’র উদ্বোধনে হাতুড়ি হাতে আস্ফালন করতেন। ত্রংকৃত্য বলেছেন, তিনি ছিলেন অতুলন ভলান্টিয়ার, যিনি বনগাঁ-লোকাল মার্কা দমঠাস সমাবেশেও কে ডান কে বাঁ কে নৈঋত কোণ দিয়ে বেরবে তা নিখুঁত নিরূপণ করে মাইকে চাঁচাছোলা পরিচালনা করতেন। অবপ্লু বলেছেন তিনি পথনাটিকায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং কখনও অবিশ্রান্ত অনশন কখনও সিরিয়াল-স্টারের ডাঁই দেখিয়ে দর্শকদের সম্মোহিত রাখতেন (যদিও বাদল সরকার নামে এক জন লবি করে পথনাটকে নাম করে নেন, তবে তিনি সরকার স্থাপন করতে পারেননি)।

ব্লিংগোকেশর এক আশ্চর্য তত্ত্বের অবতারণা করে বলেন, এই সব ক’টি কথাই ঠিক, এক জনই নারী একা এই সমস্ত গুণেরই অধিকারী ছিলেন, শুধু তা-ই নয়, তিনি পিকাসোর চেয়ে ভাল ছবি আঁকতেন ও দুর্গার চক্ষুদান করতেন। ব্লিমদান এই মত উড়িয়ে দিয়ে বলেন, এ তো রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তি বলার চেয়েও হাস্যকর ও অবাস্তব। আমরাও ব্লিমদানেরই পক্ষে। তৃণমূলনেত্রী প্রকৃতপক্ষে একটি সুবিশাল বহুমাত্রিক তাকধাঁধানো সংগঠনের নাম এবং বাঙালি তার পুরনো অভ্যাসে ফিরে এটিকে ব্যক্তিমূর্তি দিয়েছে।

তৃণমূল ক্ষমতায় এসে, সবাইকে চূড়ান্ত চমকে দিয়ে, ভারতের প্রাচীন দার্শনিক শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ পুনঃপ্রচার করে। বাঙালি স্পষ্ট দেখছে ডেঙ্গি, কিন্তু আসলে নাকি ওটা হুপিং কাশি, দেখছে ধর্ষণ কিন্তু নাকি বড়লোকি ব্যাংবাজি, দেখছে রিপোর্টারকে ঠাটিয়ে রদ্দা কিন্তু আসলে উহা বিপুল শ্রদ্ধা। একইসঙ্গে তৃণমূল ডিকশনারির ওপর ঝাঁপিয়ে ‘প’ বর্ণের পাতাগুলো কুচিকুচি করে জানায়, ‘পশ্চিমবঙ্গ’ মানে চুটকিস্তান, ‘প্রফেসর’ মানে ‘আমার মাইনে খান’, ‘প্রবচন’ মানে: যে নয় আমার পক্ষে, তার মরা উচিত শক খেয়ে, এবং ‘পরিবর্তন’ মানে: মাল্টি-জেরক্স, অতীতের অবিকল অনুসরণ। স্তম্ভিত ভাষাবিদদের ননস্টপ হাঁ-য়ে মাছি ঢুকে গেলে তৃণমূল মাছিগুলোকে মাওবাদী বলে চিহ্নিত করে। তার পর, সিপিয়েমের সামনে হাঁটু গেড়ে, তাদের তাবৎ কর্মসূচির হুবহু টুকলি মেরে, যে-ছাত্র শিক্ষকের গালে চড় মারে তাকে বিদেশ-যাওয়া বিতর্ক-টিমে লুফে নেয়, গুন্ডাকে ক্যাডার বানায় ক্যাডারকে সর্বগুন্ডামির লাইসেন্স দেয়, উচ্চপদে দলদাস বসায়, বিরুদ্ধ-মত দেখলেই পিঠে ‘পয়সাখোর চক্রান্ত’ প্ল্যাকার্ড গেঁথে দেয়, বুথের সামনে সাধারণ লোককে ফেলে পেটায়, মনোনয়ন দাখিল-রত বিরোধীদের গালে থাবড়ে চিল্লায়: ‘নববর্ষের শুভ-মাম্প্‌স!’ তাদের গোষ্ঠী-ঝাড়পিটের মধ্যে পড়ে লোকে রাস্তা পেরতে পারে না, দু’ফুটপাতেই বাড়ি বানায়। সেই বাড়ির চুনবালি সিন্ডিকেটের কাছ থেকে না নিলে সপাট লাথি খায়। সিপিয়েম সতর্ক স্লো মোশনে যে স্বৈরাচার হাসিল করতে চেয়েছিল, তা উন্মত্ত গতিতে আয়ত্ত করে তারা বোঝায়: পেটে যখন খিদে, কামড়া 4G স্পিডে! ধ্রুবপিস্তি বলেন, তৃণমূল যদি ‘গণতন্ত্র’ বানান জানত তবে আধলা ইট ও বাটাম দিয়ে ‘ণ’-কে থেঁতলে ‘ন’ বানিয়ে ছাড়ত।

কিন্তু মানুষ আমোদে দুলতে থাকে। রাজ্যের সামগ্রিক ও চূড়ান্ত লুম্পেনায়নে আমজনতার মধ্যে উল্লাসের বান ডেকে যায়, তারা সস্তা লাইটিংঋদ্ধ রাজধানী ও সন্তোষী-মা’র পুজোয় ১৮২ দিন ছুটি দেখে বোঝে এই বার গোদা রুচি ও সোঁদা ব্রেনের প্রকৃত জয়কার। মুখ্যমন্ত্রীর অলৌকিক হাঁটুনি দেখে সর্বত্র ফিটনেসেরও হুপুই ওঠে, জিমন্যাস্টিক্‌সে এ রাজ্য প্রথম সারিতে চলে আসে এবং রাশি রাশি সিপিয়েম-পদ-প্রক্ষালক কবি নাট্যকার সিনেমাওলা এমনকী যুবনেতা নিপুণ সমারসল্ট খেয়ে তৃণমূল শিবিরে এসে ঘাড়েমোড়ে পড়তে থাকেন। দলের অনেককে কোটি কোটি টাকা মারার অভিযোগে কাঠগড়ায় তোলা হয়, কিন্তু তারা তাজ্জব ভল্ট আর্চ ও মসৃণ স্লিপ খেয়ে আদালতের বাইরে চলে আসে। তার পরে যে ঠিক কী হয়, তা আবছা, কারণ আমাদের রেডিয়েশন কিছু দিন হল কমজোরি ইমেজ পাঠাচ্ছে, কিন্তু আশা করা যায় যন্ত্র অচিরে ঠিক হয়ে যাবে। যদিও মহাপণ্ডিত ও রহস্যভাষী সু-কু রায়মা এক উদ্ভট বাক্যে বলেছেন: তার পর কী হইল, শ্যামলাল ছাড়া কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poila Baisakh Special Bengali New Year History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE