Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ব্যাঙ্ক বাঁচাতে গোপনে ২৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন রামদুলাল

নবজাগরণের ঢের আগে থেকে এই সমাজে আছে কপট ভাঁড়ুদত্ত। শাসকের অত্যাচারে কবিকে কী ভাবে গ্রামছাড়া হতে হয়, স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল মধ্যযুগেই। সেই কথা স্মরণ করেই নববর্ষের এই সঙ্কলন। কেউ লিখেছেন বাঙালির বাণিজ্যের অতীত গরিমা নিয়ে। কেউ বোঝার চেষ্টা করেছেন, কেন যথার্থ নাগরিক চেতনার বদলে দলতন্ত্রই হয়ে উঠল বাঙালির অভ্যাস। কেউ জানালেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূল ধারাটি তবু অক্ষুণ্ণ। মোবাইল-বন্দি রবীন্দ্র বা শরৎ রচনাবলিতে কেউ খুঁজে পেলেন মুক্তির আশ্বাস। কেউ বা পৌঁছে  গেলেন ৩৪২৫ বঙ্গাব্দে। তখনকার সভ্যতা কী ভাবে দেখবে এই বঙ্গজনদের? রক্তাক্ত এই সময় জানে, মঙ্গলকাব্যেই ছিল ছা-পোষা বাঙালির চিরন্তন আর্তি, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’  কয়েক দিন আগে এক মাঝারি সাইজের বাঙালি ব্যবসায়ী দুঃখ করছিলেন, ফুটবল, ক্রিকেট, সিনেমা, সঙ্গীত, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ভোটাভুটি ইত্যাদি নিয়ে যত আগ্রহ, তার এক-দশমাংশও নজর নেই ছোট বা বড় ব্যবসায়ের প্রতিবেদনে।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী।

শংকর
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০২
Share: Save:

বাংলা নববর্ষের ক’দিন আগে থেকেই মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায়, এক সময় এপার-ওপার মিলিয়ে বৈশাখই ছিল নিখিল বাঙালির বৃহত্তম উৎসব। কেনাবেচা চালু রেখেই ব্যবসায়ী বাঙালি অনেক দেনাপাওনা মিটিয়ে নিয়ে বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিত, কেন এই জাত সম্পদলক্ষ্মীর প্রিয়তম।

বাঙালি ব্যবসায়ী এক বিশেষ লাল রঙের কাপড়ে বাঁধানো বিভিন্ন সাইজের হিসেব-খাতায় সগর্বে তার বাৎসরিক হিসেব রাখার সূচনা করত। বুক বাইন্ডাররা এই খেরোর খাতা আজও সীমিত সংখ্যায় তৈরি করে, কিছু খুচরো দোকানদার আজও পাঁজি দেখে উপবাস করে, নদীতে স্নান শেষে নতমস্তকে এই খাতা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে, একটা রুপোর টাকা লাগিয়ে ব্যবসাস্থলে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু এ কালের বঙ্গীয় তরুণদের মনে আজ তার কোনও স্থান নেই। যদিও এক সময় এই খেরোর খাতায় নিজের বিস্ময়কর রচনাগুলি লিপিবদ্ধ করে সত্যজিৎ রায় খেরোকে আবার ফ্যাশন-আঙিনায় ফিরিয়ে আনবার দুঃসাহসিক চেষ্টা করেছিলেন। এক জন প্রবীণ বাঙালি সে দিন দুঃখ করলেন, রবি ঠাকুরও চেষ্টা করলে সফল হতেন না, বিত্তলক্ষ্মীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বোধ হয় চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছে। শিক্ষিত মিডল ক্লাস বাঙালি স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ধারের ঘানি টানবার জন্য ক্রেডিট কার্ড-হ্যাংলা হয়ে উঠেছে।

আমার পরিচিত এই সিনিয়র সিটিজেনের দুঃখ, ‘শ্রেষ্ঠী’ শব্দটি এক সময় বঙ্গজীবনের অঙ্গ ছিল, লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার অধীশ্বরকে আমরা ওই টাইটেলে সম্মানিত করতাম। এখন অন্য ভাষার সফল ব্যবসায়ীরা ‘শেঠজি’ শব্দটি ব্যবহার করে বিশেষ গৌরব অনুভব করেন। বিশ্বভূমে বাঙালি শেঠজি আর নেই, আর কখনও ফিরে আসবে এমন কোনও ভরসাও নেই।

এর মানে কী? বিত্তসাধনা থেকে রেজিগনেশন দিয়ে এ দেশের বোস-ঘোষ-দে-দাস-দত্তরা কি বিত্তবন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী বিত্তসাধনা মোটেই কমেনি। সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল রেখে, আমরাও বিত্তসুখকে সামনে রেখে দ্রুত উচ্চবিত্ত হতে চাই। কিন্তু তা বিজনেসের মধ্য দিয়ে নয়, কয়েক ডজন পরীক্ষা-সাগর পেরিয়ে কোনও রকমে চাকরিনির্ভর সুখী গৃহকোণ রচনা করতে চাই। অথচ কেউ আমাদের মনে করিয়ে দেয় না, পরীক্ষায় টপ ফাইভ বা টপ টেন হয়ে আজ পর্যন্ত এই বঙ্গীয় সমাজে কে কবে ব্যবসায়িক সাফল্য বা সম্মান অর্জন করতে পেরেছে?

কয়েক দিন আগে এক মাঝারি সাইজের বাঙালি ব্যবসায়ী দুঃখ করছিলেন, ফুটবল, ক্রিকেট, সিনেমা, সঙ্গীত, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ভোটাভুটি ইত্যাদি নিয়ে যত আগ্রহ, তার এক-দশমাংশও নজর নেই ছোট বা বড় ব্যবসায়ের প্রতিবেদনে। আলুর দাম কেন বাড়ছে না আমাদের, বা অকালবর্ষণে উচ্ছে কেন পচছে? বড়জোর এই সব আষাঢ়ে প্রশ্ন। ব্যবসায়ী শব্দটাই সংবাদপত্রের সাব-এডিটরদের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তাঁদের নতুন প্রিয় শব্দ হচ্ছে উদ্যোগপতি। ভারতের প্রত্যেকটি রাজ্য কয়েক মাস অন্তর তাদের সিনিয়র জাঁদরেল অফিসারদের নতুন কোট-প্যান্ট-টাই পরিয়ে বড় হোটেলের সবচেয়ে বড় হলঘরে দাঁড় করিয়ে রাখছেন, শোনাচ্ছেন মন্ত্রীদের মূল্যবান ভাষণ: এই রাজ্যে আসুন, বিনিয়োগ করুন। জমি, ধার, সেবামুখী কর্মী— সব রেডি আপনার জন্য।

বিজনেসকে আহ্বান করা অবশ্যই অন্যায় নয়। যাঁরা কাছ থেকে এই মারমুখী প্রতিযোগিতা দেখছেন, তাঁদের আশঙ্কা বছরে তিরিশ-চল্লিশটা গ্র্যান্ড কনফারেন্সে তিন দিন করে ব্যয় করতে হলে তাঁদের ১২০ দিন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তার উপর মোটা সুদে ব্যাঙ্কের দেনা শোধটোধ আছে, নতুন হাঙ্গামা জিএসটি আছে, লাস্ট টু ইয়ারসে ওকালতির ব্যবসাতেই (পেশা) কেবল রমরমা দেখা যাছে। তার উপর, উৎকর্ষ-উন্নয়নের জন্য কিছু কর্মী সংকোচনেরও চাপ আছে অন্তর থেকে। এর পর নিউ বিজনেস কোথায়? আরে মশাই, খোঁজ করুন, ওয়র্ল্ডের কোথাও ইদানীং নতুন ব্যবসারম্ভ নেই। বরং সর্বত্র একটাই চাপ : চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!

বরপুত্র: দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামদুলাল সরকার, রামগোপাল ঘোষ ও মতিলাল শীল

নিন্দুকদের এই সব আলোচনা নিতান্ত নেতিবাচক। ইস্পাতে উৎসাহ না থাকতে পারে, অয়েল রিফাইনারি না থাকতে পারে, কিন্তু তেলেভাজা তো আছে। দূরদর্শীরা কেন ভুলবেন, এই তেলেভাজা উদ্যোগের জন্য ভোজ্য তেল দরকার, আলু দরকার, পিঁয়াজ দরকার, নুন দরকার, এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে অ্যাসিডিটি ও বদহজমের ট্যাবলেটও দরকার। সারা ভারত জুড়ে পিঁয়াজ এবং ডাল নিয়ে প্রবল চিন্তা এবং বিভিন্ন উদ্ভাবনী শক্তির প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

আমার পরামর্শদাতা অর্থনীতিবিদ বন্ধু বললেন, সমগ্র ভারতকে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত করে তেমন কিছু সুবিধা হবে না। তেলেভাজার বদলে যে সব দূরদর্শী ফুচকার কথা ভাবছেন, তাঁরা জেনে রাখুন, এই লাইনে কলকাতা শহরে এক জনও দাস, মণ্ডল, তিলি নেই। আরও একটু মাথা খাটিয়ে বঙ্গীয় যুবক যে ‘সত্যু’ বা ছাতু-সেবায় যাবেন, তারও জায়গা নেই। হোল জোব চার্নকের ক্যালকাটায় একটাও রোড ক্রসিং নেই যেখানে ভিনরাজ্যের উৎসাহী ইতিমধ্যেই যুবক বসে নেই ভোর পাঁচটা থেকে।

যাঁরা ম্যানেজমেন্টের হিস্ট্রি, জিয়োগ্রাফি নিয়ে অষ্টপ্রহর নাড়াচাড়া করেন, কথায় কথায় ফরেনে যান, তাঁরা আশ্বাস দেন—সেই পলাশির যুদ্ধের সময় থেকেই সব সময় মনে হয়েছে, প্রত্যেক কাজে অনেক লোক এসে গিয়েছে, মা লক্ষ্মী আর ওজন নিতে পারছেন না।

বিষয়টা ভাববার মতো। যাঁরা ক্রনিক হতাশা নামক রোগের স্টম্যাক-ট্রাবলে ভোগেন, তাঁরা বলেন বঙ্গীয় জননী-জন্মভূমির এখনকার সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে ‘পরীক্ষা’— বোধহয় ওয়র্ল্ডের বৃহত্তম পরীক্ষা সভ্যতা, তার নিন্দা কোরো না ব্রাদার। সর্বনাশ হবে। যাঁদের হতাশা কিছুতেই কাটবার নয়, তাঁরা বলছেন সিনেমা, ক্রিকেট ও ফুটবল তারকাদের পরেই বঙ্গীয় গণমাধ্যমে যাঁদের বিশেষ সম্মান, তাঁরা হলেন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক ইত্যাদির বড় বড় পরীক্ষায় প্রথম দশ জন। তাঁদের বিবরণ শুনে কোটি কোটি বঙ্গবাসী বেঁচে থাকার ভরসা পান এবং ছেলেমেয়েদের বলেন, জয় হবে, জয় হবে, হবে জয় আশায় বাঁধো বুক। কিন্তু ধৈর্য ধরে দশ বছর আগেকার বঙ্গীয় পরীক্ষা-হিরোদের খোঁজ করুন, বিশেষ কোনও খবরই পাবেন না। তাঁরা একের পর এক পরীক্ষা-সাগর পেরিয়ে, নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে, কঠিন-কঠোর ধরণীর কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন। অথচ শোনা যাচ্ছে, আমাদের চেনা মহানগরীতে এখনও কয়েকশো নয়া মিলিওনেয়ার প্রতি বছর আবির্ভূত হচ্ছেন, লোটাকম্বল-কালচার থেকেই যে কোটিপতি
হওয়া যে সবচেয়ে সহজ, বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।

তা হলে আমাদের শিক্ষাটা কী? দয়া করে জেনে রাখুন, পরীক্ষায় সাফল্য ও উপার্জনে সাফল্য এই উপমহাদেশে এক কথা নয়। যদিও লক্ষ্মী-সরস্বতীর অঘোষিত অদৃশ্য সংঘাত সেই কবে মিটে গিয়েছে, তবু এ রাজ্যের তরুণ-তরুণীরা এখনও তা মেনে নিতে পারেনি এবং সেই মতো নতুন পথের খোঁজখবর করে বিস্ময়কর কিছু খবর সৃষ্টি করতে তাঁরা উৎসাহিত বোধ করেনি।

নেতিবাচক মনোবৃত্তি নিয়ে পয়লা বৈশাখ শুরু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং বচ্ছরকার দিনে বঙ্গজননীর পুরনো সাফল্যের হিসেবসাগরে এক বার ডুব দিলে কিছু রত্নোদ্ধার আজও অকাজ বলে বিবেচিত হবে না।

১৪২৫ নববর্ষে এ বারের প্রশ্ন— ধনবান, নিজস্ব-বাটী, নিজস্ব-বিজনেস ভাগ্যবান বাঙালির সংখ্যা কি মহানগর কলকাতা ও অন্যান্য বঙ্গীয় শহর থেকে ক্রমশই পড়তির দিকে? ব্যাংক বা ইনশিয়োরেন্স বা পিএফ থেকে আজীবন দেনাশোধের দলিলে সই করা ‘ওয়ান রুম’ রুফটপ বাবুদের বাদ দিলে পরিস্থিতি তেমন উৎসাহজনক নয়। সোজাসুজি তেমন কোনও পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু মহানগরীতে বঙ্গভাষীরা শুধু মাইনরিটি নয়, কোটিপতি বেঙ্গল বিজনেসমেনও ক্রমশ বিলীয়মান।

আসুন, বিশিষ্ট ধনপতিদের একটা হিসেবনিকেশে বসা যাক বচ্ছরকার দিনে। প্রায় দু’দশক আগে (২০০১ সাল) বিত্তসাধক বাঙালিদের কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে একটা বই লিখেছিলাম, নাম দিয়েছিলাম ‘লক্ষ্মীর সন্ধানে’। আমার শ্রদ্ধাভাজন, বিলেতে শিক্ষিত এক বাঙালি আশা করে ছিলেন এই বই ‘বেস্ট সেলার’ হবে, হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় এ বার অনেকেই উৎসাহিত হবেন। সাহেবি-পাড়ায় বংশ পরম্পরায় বসবাসকারী এই নির্ভেজাল বাঙালি ভদ্রলোক আশা করেছিলেন, অন্তত আধ ডজন ‘হিট চলচ্চিত্র’ এবং নাটক তৈরি হবে আমার বইটির পঞ্চনায়ককে নিয়ে:

১) নিমাইচরণ মল্লিক (১৭৩৬-১৮০৭)

২) রামদুলাল সরকার (দেব) (১৭৫২-১৮২৫)

৩) মতিলাল শীল (১৭৯২-১৮৫৪)

৪) মার্চেন্ট প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)

৫) রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-১৮৬৮)

ভদ্রলোক আশা করেছিলেন, ভারতের ব্যবসায়িক মানচিত্র এঁদের নাম কোনও দিন মুছে ফেলা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।

ইংরেজ আমলের আগেও বঙ্গীয় বিজনেস-সাধকরা নিজেদের জাহাজে সাগর পেরিয়ে কেমন ভাবে ‘সোনার বেনে’ নাম পেয়েছিলেন এবং ধনপতি হয়েছিলেন, তার সুখপাঠ্য বিবরণ আজও বাংলায় সংগৃহীত হয়নি। তাম্রলিপ্ত নামে বন্দর থেকে বাণিজ্যযাত্রা করে কেউ কেউ যে লক্ষ কিংবা কোটি স্বর্ণমুদ্রার শ্রেষ্ঠী হয়েছিলেন, তা আজ আমাদের খেয়াল নেই। পরবর্তী সময়ে শ্রেষ্ঠী বলভদ্রের কাছ থেকে স্বয়ং বঙ্গীয় রাজা ধার চাইছেন ও সাবধানী ধনপতি তার বদলে কিছু সম্পত্তি মর্টগেজ চাইছেন এবং তাতে প্রায়-দেউলিয়া রাজার আঁতে ঘা লাগছে, তা আমাদের স্মরণে আসছে না।

আসলে হাজার বা ততোধিক বছর ধরে সম্রাট ও শ্রেষ্ঠীদের জটিল সম্পর্ক সম্বন্ধে তেমন কিছু খবরে আমরা আগ্রহ দেখাইনি। অতএব পলাশির যুদ্ধকালে শ্বেতাঙ্গ সেনাপতিদের নিয়েই আমাদের মাতামাতি, বাংলার ধনপতিদের কথা আমরা জানি না বললেই হয়। জানি না, সত্যবাদিতার জন্য ভারতবিখ্যাত এক মল্লিক-তনয়কে নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলেন স্বয়ং আওরঙ্গজেব! এঁরই পরবর্তী কোনও প্রজন্মের মল্লিকই নাকি জোব চার্নককে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়তে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ইতিহাসের ওই সব ধোঁয়াশার মধ্যে না গিয়েও বলা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিশ টাকা মাইনের শ্বেতাঙ্গ ক্লার্কদের সঙ্গে হস্তমর্দন করে যে সব বোস, ঘোষ, দে, দাস, সরকাররাও ‘টু পাইস’ করে ফেলেছিল, তাদের সংখ্যা কম নয়। তার পর এক সময় জন কোম্পানির মোনোপলি ভেঙে নিয়ে লালদিঘি ঘিরে যখন ডজন ডজন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হল, তখন প্রত্যেকটি ‘হৌস’-এ এক জন সাহেবের সঙ্গে এক জন বসাক, মিত্তির বা ঘোষ পার্টনার।

তখনকার কলকাতায় মানুষের পরমায়ু নিতান্ত সীমিত। অঢেল উপার্জন, অথচ ইনকাম ট্যাক্স নেই। সন্ধের পরে বৈদ্যুতিক আলো নেই। তাই যে সব অধঃপতন স্বাভাবিক, সে সব ঘটেছিল এবং তৎকালীন বাঙালি লেখকরা যে সব বাবু ও বিবিবিলাসের রোমাঞ্চকর ছবি এঁকেছেন, তা আজও সাগ্রহে পঠিত হচ্ছে। কিন্তু ধনপতিরা সবাই কামসর্বস্ব হয়ে বাড়ির বাইরে রাত্রিযাপন করতে উদ্‌গ্রীব তা ভাবার কোনও কারণ নেই। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের বঙ্গীয় সমাজ বড়ই জটিল—ত্যাগ ও ভোগের, পৌরুষ ও দাসত্বের এক বিচিত্র মিশ্রণ। নতুন এক ইঙ্গ-বঙ্গ সভ্যতা শুরু হতে হতেও হল না, ফিরিঙ্গি সভ্যতা হতে হতেও হল না, আজকে আমরা যাদের ‘বাঙালি’ বলি, তারাও অদৃশ্য হল না।

কিন্তু প্রশ্নটা হল, সীমাহীন বঙ্গীয় ঐশ্বর্য কাদের হাতে চলে গেল? পরিস্থিতি যে বেশ জটিল, তা নরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনকথা থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। উনিশ শতকের কলকাতায় একটা কেরানির চাকরি জোগাড় করতে গ্র্যাজুয়েট প্রার্থীর পায়ে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে।

চাকরিসন্ধানী বাঙালিবাবুদের ছেড়ে ধনাঢ্য কলকাতাবাসী ব্যবসায়ীদের কিছু খবর দেওয়া যাক। এ যুগে শোভারাম বসাকের নামই শোনেননি অনেকে। পলাশির যুদ্ধের দুই দশক পরে (১৭৮৩) বসাকমশাই মৃত্যুকালে এই শহরে সাঁইত্রিশটা বাড়ি রেখে যান। ১৮৩৭ সালে সিঁদুরপট্টির মল্লিকদের বাড়ির সংখ্যা ছিয়ানব্বুই। মনে রাখবেন, এই সময় আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত সায়েবরা তাঁদের ব্যবসা লাটে তুলে কলকাতা থেকে পালাচ্ছেন।

টু পাইস রোজগার করা বাঙালিরা কিন্তু সব সময় শান্তিতে ছিলেন না। সাহেব পার্টনারদের ধারের কাগজে গ্যারান্টর হিসেবে সই দিয়ে অনেকেই সর্বনাশা বিপদ ডেকে এনেছেন। কলকাতার বিখ্যাত পামার কোম্পানি লালবাতি জ্বালান ১৮৩০-এর পয়লা জানুয়ারি। সাহেব পার্টনারদের পাত্তা নেই। কিন্তু চরম বিপদে পড়ে গেলেন সহযোগী বাঙালি প্রতিষ্ঠানগুলি, যার মালিকানায় ছিলেন কমলাকান্ত দাস, পুত্র শিবচন্দ্র দাস, কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বেশ্বর দাস, শম্ভুনাথ মল্লিক এবং শ্রীরামপুরের রঘুনাথ গোস্বামী। এঁদের মধ্যে তিন ভাগ্যবানের টিটাগড়েই হাজার বিঘা জমি ছিল, যা সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিলেন। সায়েবদের দেনার বোঝার অপরাধে বাঙালি ধনপতিরা জেলে পচলেন, কিন্তু মূল অপরাধী আলেকজান্ডার কোম্পানির জেমস ইয়ং কিছু দিন গা-ঢাকা দিয়ে, চুপিচুপি কলকাতায় ফিরে এলেন। অথচ ইনিই চার কোটি টাকা দেনা রেখে কলকাতা থেকে উধাও হয়েছিলেন।

কলকাতার বিজনেসে বেপরোয়া সাহেবদের সুনাম ছিল সততার, কিন্তু তাঁরা সুযোগ পেলে বাঙালি পার্টনারদের নামে সীমাহীন দুর্নাম রটিয়েছেন। ইদানীং পুরনো কাগজ ঘেঁটে অনেক পচা ইঁদুর বেরিয়ে পড়ছে। যেমন ধরুন, ১৮০০-১৮৫০ এই পাঁচ দশকে কলকাতার বাঙালি ব্যবসায়ীরা তখনকার সুপ্রিম কোর্টে জোচ্চোর ইংরেজ সাহেবদের বিরুদ্ধে অন্তত এক হাজার মামলা দায়ের করেছে, দেনা শোধ না করার অভিযোগ।

একটা খবর আজও সারা ভারতে চালু রয়েছে, জমিদারি কেনার লোভে এবং কোনওক্রমে বিএ পাশ করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এবং রায়বাহাদুর হওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি অকারণে বিজনেসকে বিদায় দিয়েছিল। খবরটা বড়জোর অর্ধসত্য—এখন দেখা যাচ্ছে জোচ্চোর সাহেবদের জালে জড়িয়ে পড়ে অনেক ধার্মিক ও সৎ বাঙালির বিজনেসে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। আরও খুঁটিয়ে দেখা যাচ্ছে, ১৭৯৩ থেকে ১৮১৩ পর্যন্ত দুই দশকে বাঙালি ব্যবসায়ীরা জমিদারির দিকে তাকিয়েও দেখেননি। শোনা যায়, ব্যবসা-শিরোমণি রামদুলাল দে তাঁর দুই পুত্রকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, তারা জমিদারি-সুখের লোভে কোনও দিন বিজনেস ত্যাগ করবে না।

রামদুলাল সরকার যদি বাঙালি না হয়ে গুজরাতি হতেন, তা হলে কবে বলিউডের নজরে পড়ে যেতেন! যে-দাদুর কাছে তিনি প্রতিপালিত তাঁর পেশা যে ভিক্ষা, তা এক সময় বাঙালিরাও জানতেন। তাঁর দিদিমা কলকাতার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে রান্নাবান্না করতেন। পরবর্তী কালে অনাথ রামদুলাল দে বিখ্যাত দত্তদের সরকার, মাইনে দশ টাকা। মালিকদের টাকা থেকে ডুবে-যাওয়া জাহাজের সম্পত্তি নিলাম-ডাকে কিনে নিয়ে, কয়েক ঘণ্টায় তিনি লাখ টাকা রোজগার করেন এবং মালিকের ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে সেই টাকা ফেরত দিতে চেয়ে, দত্তদের বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।

বড়লোক মালিক সে টাকা রামদুলাল সরকারকে ফেরত দিয়েছিলেন। এর পর ইন্দো-মার্কিন বাণিজ্যে বিশ্বব্যাপী সম্মান অর্জন করলেও, রামদুলাল প্রতি মাসেই খালি পায়ে আদি মালিকদের বাড়িতে গিয়ে দশ টাকা মাইনে নিয়ে যেতেন। কৃতজ্ঞ আমেরিকানরা এই বিদেশে সহযোগীর স্মৃতিতে স্বদেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামদুলাল সোসাইটি। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির নাম ছিল ফার্গুসন অ্যান্ড কোম্পানি। শোনা যায়, আদিতে স্পেকুলেশনেই তাঁর আর্থিক সমৃদ্ধি। এক বার সস্তায় পুঁতি কিনে তা মাদ্রাজে বিক্রি করে রামদুলাল প্রচুর টাকা করেন। আর একবার গোলমরিচ বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করলেন। বহু বছর ধরে সংখ্যাহীন মার্কিন জাহাজ কলকাতায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। রামদুলাল এই সব জাহাজে পাঠিয়েছেন এ দেশের চা, চিনি, নীল, আদা, চটের থলে, লঙ্কা, রেশমি কাপড়, মসলিন এবং শৌখিন পাথরের অলংকার। তাঁর নিজেরও ছিল বেশ কয়েকটি সমুদ্রগামী জাহাজ। শোনা যায়, রামদুলালের মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে কলকাতা বন্দরে ছিয়ানব্বইখানা সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল, তার মধ্যে বিলিতি সওদাগরদের জাহাজ মাত্র পনেরোখানা!

রামদুলালকে নিয়ে নাটক নভেল তেমন লেখা হয়নি আজও। তিনি নাকি ব্যবসায়িক সওদা করার জন্য দিনে তিন লক্ষ টাকার চেক কাটতেন স্থানীয় ব্যাঙ্কের উপর। ব্যাঙ্ক-কে বেইজ্জতি করবার জন্য তখন ষড়যন্ত্র হয়েছিল, সে খবর আগাম পেয়ে রামদুলাল নাকি চুপি চুপি পঁচিশ লাখ টাকা ব্যাঙ্কের সিন্দুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা লজ্জা পেয়েছিলেন।

রামদুলালের বসতবাড়ি ছিল চোদ্দো বিঘা জমির উপর। পঁচাশি বিঘা জমির উপর তৈরি হয়েছিল তাঁর অভূতপূর্ব অতিথিশালা, প্রতিদিন এক হাজার অতিথিকে চাল ডাল আলু ঘি জ্বালানি কাঠ ও মাটির পাত্র দেওয়া হত। চারশো প্রতিবেশীকে রামদুলাল মাসিক অর্থ সাহায্য করতেন। এখন যাকে ‘সিএসআর’ বলে, সেখানেও তিনি পথিকৃৎ। প্রতিবেশীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য তিনি মাস-মাইনের ডাক্তার রেখেছিলেন।

রামদুলালের পারিবারিক জীবনও উপন্যাসের মতো। প্রথম স্ত্রীর নাম দুর্গামণি। তখন কারণে-অকারণে বড়লোকের বউয়েরা অভিমানে ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকতেন। দুর্গামণিও এক বার রাগ করে দরজায় খিল দিলে রামদুলাল অনুনয়-বিনয় করে দরজা খুলিয়ে, স্ত্রীর মানভঞ্জনের জন্য এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন! শ্রীক্ষেত্রে তীর্থযাত্রার সময় রামদুলালের স্ত্রী দুর্গামণি নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির মেথর গৌরকে। এই তীর্থসঙ্গীই তাঁর মুখে মহাপ্রসাদ তুলে দেন। এঁর শ্রাদ্ধে তিন হাজার টাকা খরচ হয় বলে শোনা যায়। এঁদের অপ্রকাশিত হিসেব-খাতায় কত নাটকীয় বিবরণ লুকিয়ে আছে কে জানে!

ধনপতিদের প্রধান হয়েও রামদুলালের ছিল অতি সাধারণ জীবনযাত্রা। পরতেন ধুতি ও বেনিয়ান, কাঁধে চাদর এবং মাথায় পাগড়ি। কলকাতার ব্যবসায়ী বাঙালি কোন সময় পাগড়ি ত্যাগ করল, তা এখন ঠিক বুঝতে পারি না। কর্মক্ষেত্রে রামদুলাল যাতায়াত করতেন পালকিতে, ঘোড়ার গাড়িতে নয়। শোনা যায়, তাঁর বক্তব্য ছিল, দস্যি ঘোড়ার খাবার জোগানোর চেয়ে গরিব পালকি-বেহারাদের অন্ন সংস্থান ভাল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE