Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Poila Baishak

হারিয়ে গেল ছোটদের আঁকা নববর্ষের ক্যালেন্ডার

সবাই আনন্দ করছে, নববর্ষের নতুন রোদ্দুর এসে পড়ছে সকলের গায়ে, এটাই বা কম কীসের! লিখছেন রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়সবাই আনন্দ করছে, নববর্ষের নতুন রোদ্দুর এসে পড়ছে সকলের গায়ে, এটাই বা কম কীসের! লিখছেন রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:১৫
Share: Save:

বাংলা নববর্ষ তার চিরন্তন বৈশিষ্ট্যগুলির বেশ কিছু হারিয়েছে। আর পড়ে আছে যে ক’টা তারা একটু হলেও বদলে ফেলেছে নিজেদের পুরনো ‘লুক’। আগে যেমন অনেকগুলি সাধারণ দিনের মধ্যে তাকে আলাদা করে চিনতে পারা যেত, এখন হয়তো সে ভাবে আর যায় না। কথাটা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারলাম না, না! ধরুন, এক জন পরিচিত মানুষকে চেনা যায় কী ভাবে? দূর থেকে দেখলে তার চেহারা, হাঁটাচলা অথবা পোশাক-আশাক দেখে। গলার আওয়াজ শুনে। আর কাছ থেকে দেখলে তার খাদ্যরুচি, পাঠরুচি, গন্ধরুচি এবং নানাবিধ শখ-আহ্লাদ দেখে।

যেমন ধরা যাক, বাঙালি পুরুষদের শরীর ঋজু এবং দীর্ঘ হলেও সুষমাময়। বাঙালি মেয়েদের চেহারা ছিপছিপে এবং টানটান হওয়া সত্ত্বেও ছায়াঘেরা পুকুরপাড়ের মতোই স্নিগ্ধ ও কোমল। এদের হাঁটাচলার মধ্যে একটা সহজ ব্যাপার আছে । আছে নিজস্ব একটা ছন্দ । তাই ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবিতে ছেলেদের আর চওড়া-পাড় তাঁতের শাড়িতে মেয়েদের চিরকালই সুন্দর মানিয়ে যেত এবং আজও যায়। আজ সারা পৃথিবীর দেখাদেখি বাঙালির জীবনটাও যখন মেট্রো স্টেশনের এসকালেটরের মতো চির-ছুটন্ত হয়ে গিয়েছে, তখন পথেঘাটে ধুতি বা শাড়ি পরাটা নেহাত বাতুলতা। আর এটা বাড়তে বাড়তে এমন হয়ে গিয়েছে যে বাঙালির ধুতি বা শাড়ি পরাটা নববর্ষের মতো কয়েকটি নির্দিষ্ট উৎসবের গণ্ডিতেই আটকা পড়ে গিয়েছে। বাঙালির সন্তান, কিন্তু বাংলা ভাষাটা ভাল করে লিখতে-পড়তে পারে না-র মতো, ধুতি পরতে না-পারাটাও কোনও কোনও বাঙালির কাছে ইদানীং একটা শ্লাঘার বিষয়। এদের আমি আমার এরিনার বাইরেই রাখছি। কিন্তু ইচ্ছে রয়েছে, অথচ ধুতিটা একেবারেই ম্যানেজ করতে পারছে না, এমন বঙ্গতনয়রা পাঞ্জাবির সঙ্গে পায়জামা পরলেই বা ক্ষতি কী? উঠতি কোনও তরুণ রঙিন পাঞ্জাবির নীচে ডেনিম জিনস পরলেও তো ভালই মানায়! পায়ে হয়তো ‘বিদ্যাসাগরী চটি’র বদলে শুঁড় তোলা কোলাপুরি চটি! যে সব সদ্য তরুণী ঠিকঠাক শাড়ি ‘ক্যারি’ করতে পারছে না, তারা নববর্ষের দিনে ঝলমলে লহেঙ্গাই পরুক না! বাড়ির অশীতিপর মা-কাকিমাদের নববর্ষে চিরকাল শাড়ি উপহার দিয়ে এসেছেন, কিন্তু এখন বয়সের ভারে বারো হাত শাড়ি তাঁদের অসহ্য হয়ে গিয়েছে— নববর্ষে এঁদের দামি কাপড়ের প্রিন্টেড ম্যাক্সি দেওয়ায় তো কোনও দোষ নেই। ম্যাক্সি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি নয়। কিন্তু শাড়ি দিলে তাঁদের হয়তো সেটা পরাই হয়ে উঠবে না! তার চেয়ে এটাই তো ভাল! এই ভাবে নববর্ষটাকে হাত ধরে সাজঘরে নিয়ে গিয়ে, একটু অন্য ধরনের পোশাক পরিয়েও তো সবার সামনে আনা যেতে পারে! সবাই আনন্দ করছে, নববর্ষের নতুন রোদ্দুর এসে পড়ছে সকলের গায়ে, এটাই বা কম কীসের!

শুনে হয়তো হাসবেন, আমার কানে নববর্ষের নিজস্ব একটা শব্দও কিন্তু ধরা পড়ে। কী করে, সেটা একটু ভেঙে বলি তা হলে। ধরে নিন, আমি বাড়ির দোতলায় রয়েছি। নীচের রাস্তায় দু’জন মানুষ দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মুখ না-দেখেও আমি তাদের এক জনের গলা শুনেই, তার চেহারাটা মনে মনে এঁকে নিতে পারছি। এই যে শব্দ এক জন মানুষকে চিনিয়ে দিচ্ছে, এটা কিন্তু নববর্ষের মতো একটি দিনের বেলাতেও সত্যি। মানে, আমি বলতে চাইছি মানুষের মতো নববর্ষের উপস্থিতিরও একটা নিজস্ব শব্দ আছে। ভাষা আছে। আমাদের ছেলেবেলায় নববর্ষ উপলক্ষ্যে যে নতুন জামা-প্যান্ট হত, তা কিন্তু সবসময় রেডিমেড বা দর্জির তৈরি হত না। মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির মা-কাকিমারা সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে, দুপুরবেলায় নিজেদের বিশ্রামের সময়ে, বাড়ির কুঁচোকাচাদের জন্যে হাফশার্ট, হাফপ্যান্ট, সালোয়ার কামিজ কিংবা বুকের কাছে চমৎকার ফ্রিল দেওয়া পরি-পরি ফ্রক তৈরি করে দিতেন । চৈত্রের দুপুরে উত্তর বা দক্ষিণ কলকাতার পুরনো পুরনো গলিগুলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সেলাই মেশিনের অমন ঘরঘর আওয়াজ আমি অনেক শুনেছি। যে আওয়াজটা সন্ধের মুখে হারিয়ে যেত পাড়ার নববর্ষের অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হতে থাকা গান বা নাচের রেওয়াজে অথবা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার বারংবার প্র্যাকটিসে। আবার রাত্তিরের নববর্ষ কথা বলে পদ্মপুকুরের চড়কের মেলা থেকে কিনে আনা টিনের ঢোল বা কটকটি গাড়ির কট-কট আওয়াজে কিংবা কচি-হাতে বাঁশের বেহালায় বেসুরো ছড় টানায়।

তবে নববর্ষের সবথেকে মনে রাখার মতো শব্দটির উৎস হল অবশ্যই ‘চৈত্র সেল’। হাতিবাগান, গড়িয়াহাট, এমন বেশ কয়েকটি ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাথ চৈত্র সেলের বিক্রেতাদের বিচিত্র হাঁকডাকের জন্য এই দিনটিতে ভুবন বিখ্যাত হয়ে আছে। রাস্তার ধারে প্লাস্টিক পেতে তার ওপর জামাকাপড়ের পসরা বিছিয়ে তাঁরা বসে পড়েন। কেউ নিয়ে বসেন হাঁড়ি-কড়া-খুন্তি-বঁটি, কেউ হয়তো কাপ-ডিশ-চামচ, কারও কাছে হয়তো নানা কিসিমের প্রসাধনী— এমন আরও কত কী! দিনরাত ওঁদের সামনে ভিড় করে থাকেন অজস্র ক্রেতা। পিছনে, ফুটপাথ-লাগোয়া স্থায়ী দোকানগুলোতেও থাকে উপচে-পড়া ভিড়। আবহমান সময় ধরে চৈত্র সেলের এই ক্রেতা বিক্রেতাদের দিকে যদি একটু নজর ফেরানো যায় তো দেখা যাবে সেখানে হিঁদু-মোচলমান-খেস্টান সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। হিন্দু মালিকের কাছে খুশি মনে কাজ করে চলেছে তাঁর মুসলমান কর্মচারী আবার মুসলমান মালিকের দোকানে হাসি মুখে ডিউটি করে চলেছে তাঁর হিন্দু হেল্পার। এটা চৈত্র সেলের বাজারে চোখে পড়ার মতো কোনও ব্যাপারই নয়। ফুলগাছে যেমন ফুল ফোটে, গোলা পায়রা যেমন উজ্জ্বল রোদ্দুর ভরা আকাশে গোল হয়ে পাক খায়, এটাও তেমনই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। পঞ্চায়েত নির্বাচন, রাজনৈতিক মিছিল বা দেশের কোথাও ঘটা বিক্ষিপ্ত হাঙ্গামার খবরে এই ছবিতে মিশে থাকা রঙের কোথাও কোনও হেরফের ঘটে না। কারণ বাংলা নববর্ষটা শেষ পর্যন্ত বাঙালি নামক একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতির, যাদের প্রত্যেকেরই মাতৃভাষা বাংলা। আর মানুষের এই উৎসবে ধর্ম নামক গোলমেলে বিষয়টির কোনও বিশ্রী নড়বড়ে ছায়া নেই।

এ বার আসি নববর্ষের দিনের খাওয়াদাওয়ার কথায়। নববর্ষ মানেই যে দোকানে দোকানে শরবত, সন্দেশ, হাসিমুখ এবং ক্যালেন্ডার। এই ব্যাপারটার বোধহয় এখনও বিশেষ বদল ঘটেনি। ছেলেবেলার স্মৃতি- দোকানগুলিতে গেলে দু’ধরনের শরবত পরিবেশন করা হত। আমপোড়া আর তা নয়তো জলজিরা। পরে যখন ছোট্ট মোহিনী বোতলে ক্যাম্পাকোলা নামক অধুনালুপ্ত ঠান্ডা পানীয়টি দেওয়া হত, তখন মনে হত একেই বোধহয় অমৃত বলে। ক্যাম্পাকোলা-র স্মৃতি বুকে করে নিয়ে গিয়ে কদাচ বেলের শরবত পেলে মনমেজাজ কতটা খারাপ হয়ে যেত সেটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করা যেতে পারে। নববর্ষের দুপুরে এমন কিছু বিশেষ বাঙালি পদ বাড়িতে তৈরি করা হত, যারা রান্নার হ্যাপা ও তরিবতের কারণে আজ বাঙালির পাত থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

মনে পড়ে, ঘি-ছড়ানো ধোঁয়া ওঠা বাসমতী চালের ভাতের পরেই আসত বড়ি দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি শুক্তো। মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগ ডাল। পোস্ত ছড়ানো ঝিরিঝিরি আলুভাজা। এর পর একে একে রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, তোপসে মাছের বেসম-ডোবানো মুচমুচে বড়া, কলাপাতায় মোড়া ভেটকি মাছের পাতুরি, পাবদা মাছের কালোজিরে-কাঁচালঙ্কার রসা, চিতল মাছের মুইঠ্যা, কইয়ের হরগৌরী, পুঁটিমাছের ঝাল, মৌরলার টক-মিষ্টি অম্বল, খাসির পাঁজরার তুলতুলে কবিতামাখা পিসগুলি দিয়ে বানানো কষা (যার সঙ্গে দু-চার ফোঁটা দিশি পাতিলেবু মাস্ট), ধনেপাতা আর পুদিনাবাটা মাখানো ঝালঝাল দিশি মোরগের কারি, কাঁচা আমের ঝোল-চাটনি, বাড়ির পাথরবাটিতে পাতা সাদা-সুস্বাদু-মিষ্টি দই...আর সব শেষে বাড়িতে কাটানো ছানা দিয়ে গড়া লেবু সন্দেশ। ওহ, বলতে বলতেই আমেজে আমার চোখ প্রায় বুজে এল!

তো, এই যে আমোদিত পদসমাহার আমি আপনাদের কাছে নিবেদন করলাম, প্রায় কৈশোর পর্যন্ত প্রতি বছর নববর্ষের দিনে মা-জেঠিমারা এদের বেশ কয়েকটি করে পদ (কারণ গেরস্তবাড়িতে তো বেশি বাড়াবাড়ি সম্ভব নয়) নিজের হাতে রান্না করে পরিবারের প্রত্যেকের পাতে সাজিয়ে দিতেন। প্রাচীন বনেদিবাড়ির গরম রান্নাঘরে, ডবল উনুনের হু-হু উত্তাপে ঝলসে যেতে যেতে, তাঁরা হাসিমুখে যে কাশ্মীরি টিউলিপগুলি দিনের পর দিন আমাদের জন্য ফুটিয়ে গিয়েছেন, সে জন্য অশ্রুসজল চোখে তাঁদের পায়ে শতকোটি প্রণাম জানাই। বর্তমান প্রজন্মের গৃহিণীরা যে এ-সমস্ত করেন না বা করতে পছন্দ করেন না, তা আমি এক বারও বলছি না। তবে তাঁদের ইচ্ছে এবং শারীরিক সামর্থের মধ্যে সময়ের অভাব অনেক সময়েই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । নিজের হাতে রেঁধে-বেড়ে খাওয়ালে মনে যে তৃপ্তি পাওয়া যায়, হোটেলে নিয়ে গিয়ে তার সিকিভাগও হয়তো মেলে না। তবু কিছু কিছু রেস্তোরাঁ নববর্ষের দিনটিতে ওই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া পদ রান্না করে বাঙালির পাতে পরিবেশন করার ব্যবস্থা তো করেছে। তাদের মেনুকার্ডে রয়েছে বিভিন্ন ‘পঞ্চব্যঞ্জন থালি’। বাড়িতে রান্না করলে অনেক ভাল হত— এমন ভাবনা দূরে সরিয়ে একটা দিন তো এ সবের স্বাদ নেওয়াই যায়! এতে তো নববর্ষের গরিমা কিছু কমে না!

এ বার আসি ক্যালেন্ডারের কথায়। চৌরঙ্গির ‘নেহরু চিলড্রেন’স মিউজিয়াম’ এখনকার মতো তখনও শীতকালে একটি ছোটদের ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করত, যাতে ছোটদের আঁকার রং, কাগজ, তুলি ইত্যাদি সরবরাহ করত ধর্মতলার বিখ্যাত ছবি আঁকার সরঞ্জামের দোকান ‘জি সি লাহা’। সেই প্রতিযোগিতায় যে বাচ্চাটির ছবি প্রথম হত, তাই দিয়েই তাঁরা একটি চমৎকার ক্যালেন্ডার বার করতেন। আমার মতো অনেক ছেলেমেয়ে, যারা বাড়ির গুরুজনদের আগ্রহে ওই আঁকা কম্পিটিশনে অংশ নিত, তারা পয়লা বৈশাখে ওই ক্যালেন্ডারটি বেরনোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। বলা যায় না, এ বার হয়তো তার আঁকা ছবি দিয়েই ওটা তৈরি হতে পারে। যথারীতি ক্যালেন্ডারটি বাড়িতে আসত, আর লাফাতে লাফাতে গিয়ে দেখতাম, আমি নই, সেখানে আমারই মতো অন্য একটি বাচ্চার ভারি সুন্দর একটা ছবি ছাপা হয়েছে। সেই ছবিটা দেখে একটু যে মনখারাপ হত না তা নয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে মনটা আবার ভালও হয়ে যেত। ওই ক্যালেন্ডারের আরও একটা ব্যাপার ছিল। ওর এক-একটি মাসের পাতা এক-এক রঙের কাগজে ছাপা হত। বৈশাখটা হয়তো আকাশি নীল, জ্যৈষ্ঠটা হয়তো ফিকে গোলাপি, আষাঢ়টা হয়তো ফিকে সবুজ, এমন আর কি! ছোটদের মনের ভেতরটা বছরের শুরুর দিনে রঙিন করে দিতে পারলে, বাকি বছরটাও তাদের রঙিনই কাটবে— এটা সেই সময় ‘জি সি লাহা’র ক্যালেন্ডার বিষয়ক কর্তৃপক্ষ বোধহয় মনে মনে বুঝতে পেরেছিলেন। কেন যে আজ, এই বেরঙিন সময়ে দাঁড়িয়ে ওঁদের মতো আর কেউ ছোটদের জন্যে মন ভাল করা বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করতে আসেন না!

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE