Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Poila Baishak

পয়লা বৈশাখে আমি এক বাঙালি অভিযাত্রী

পয়লা বোশেখের সন্ধ্যায় হাতিবাগানে সুচিত্রা বা সুপ্রিয়া জোটেননি, জুটলেন হারুকাকা! স্মৃতিচারণায় রূপঙ্করপয়লা বোশেখের সন্ধ্যায় সুচিত্রা বা সুপ্রিয়া নন, জুটলেন হারুকাকা! স্মৃতিচারণায় রূপঙ্কর।

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৮ ১৬:২৮
Share: Save:

পয়লা পয়লা পয়লা...এই তিনটি মন্ত্র উচ্চারণ মানে তুমি পয়লা কী করেছ, পয়লা কীখেয়েছ,পয়লা প্রেম, পয়লা ল্যাং খাওয়া...আর এ সব কিছুর উর্ধ্বে পয়লা বৈশাখ বাঙালির বাঙালিয়ানা। বাঙালির ইংরেজি ভাষা না বলা, বাঙালির চাইনিজ না খাওয়া, বাঙালির জিনস প্যান্ট না পরা— এই সমস্ত উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য যা অন্য দিনগুলিতে লুপ্তপ্রায় তাপয়লা বৈশাখে বিশেষ দ্রষ্টব্য। বৈশাখের পরের মাসগুলো বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়লেও পয়লা বৈশাখ আর এই বৈশাখেই কবিগুরু দিবস (সে যতই তাঁর নোবেল আমরা রক্ষা করতে না পারি) এক জবরদস্ত আইটেম ভাইসকল। এখন কথা হল এই পয়লা বৈশাখে আমি কী করতাম আর এখনই বা কীকরি!

‘ছেলে মেয়ে সব সমান/এই আদরের রাখব মান’

এই দু’টি লাইন আমার খুব প্রিয়। এই লাইন দু’টি ছিল ব্রতচারীর লাইন। নবমিতালী সব পেয়েছির আসরে এই ব্রতচারী আমরা প্রত্যেক পয়লা বৈশাখে উচ্চারণ করতাম। ‘ছেলে মেয়ে সব সমান’ এই লাইন দু’টি যখন বলতাম, তখন শরীরে মননে কী রোমাঞ্চ তা অবর্ণনীয়, সবপেয়েছির আসরে কী পেয়েছি তা প্রশ্নাতীত, কিন্তু পয়লা বৈশাখে ফাটিয়ে অনুষ্ঠান হত এখানে। নাটক, গান, জিমনাস্টিক্স— এই মোহময়ী আইটেমে ওরা থাকতপয়লা। বিশেষত, ফাল্গুনীদি যখন গায়ে লেপ্টানো পাজামা পরে সর্বাঙ্গাসন করতেন তখন মনে হত বাঙালির এই পয়লা বৈশাখ কেন রোজ হয় না?

পয়লা বৈশাখে বাটিকের পাঞ্জাবি পরে কেত মারা ছিল আমার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। সন্ধ্যেবেলা ঘাড়ে পাউডার লাগিয়ে হাতিবাগানে শাড়ি পরা মেয়েদের জন্য একমাত্র আমিই। হ্যাঁ, আমিই ছিলাম উত্তমকুমার। দুর্ভাগ্য, সুচিত্রা বা সুপ্রিয়া কেউই জোটেনি। একবার জুটেছিলেন হারুকাকা। বাবার বন্ধু ছিলেন হারুকাকা। কোনও একবছরে হাতিবাগানে হারুকাকার শক্ত হাত কানে এসে লাগলে চমকে গিয়ে বলেছিলাম, ‘কী করলাম?’হারুকাকা বলেছিলেন, ‘চল বাড়ি! আর মেয়েদের কাছে কেরামতি মারতে হবে না। বাড়ি গিয়ে পড়তে বস।’ এখন যদিও ভেরিফাই করার জন্য এঁরা আর কেউই মজুত নেই।

পয়লা বৈশাখে ছোটবেলায় যে মজা ফূর্তি ছিল তা ক্রমে ক্রমে একটা ব্যবসায়িক রূপ নিল, যখন আমি পেশাদারি হওয়ায় ব্রতী হলাম।প্রথম দিকে পাড়ায় পাড়ায় ডাক পড়ত। তখন ঝুলিতে একটি-দু’টি হিট গান আর তার সঙ্গে পুরনো বাংলা গান আর থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। সময়ের পরিবর্তন হল, ক্রমে কর্পোরেট লগ্নি আসতে লাগল এবং বিভিন্ন অভিজাত ক্লাব, যেমন ক্যালকাটা ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব, বেঙ্গল ক্লাব, লেক ক্লাব ইত্যাদিরা ডাক দিতে লাগল। ক্রমে ক্রমে আমার ঝুলিও ভারী হতে লাগল (হিট গানের)। এই সমস্ত ক্লাবে যখন যেতাম তখন কয়েকবছর আগে পাড়ার পয়লা বৈশাখে গান গাওয়ার আমি আর এই কর্পোরেট আমির মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হতে লাগল। আমি হয়ে উঠলাম অনেক পরিণত, অনেক বাঙালি বাঙালি (মাঝেমধ্যে নিজেকে চিনতে অসুবিধা হয়, ভাবতে বসি আমি কি ফাটিয়েই না অ্যাক্টো করি)। তারপর ডাক আসতে লাগলপ্রবাসে, বিদেশে। সেখানে গিয়ে তো চমকে উঠি। প্রবাসীরা যেন এই সময় আরও বেশি বাঙালি হয়ে ওঠেন। আরও বেশি ররীন্দ্রপ্রেমী, আরও বেশি সত্যজিতের, আরও বেশি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের, তাঁদের সৌজন্য, অভিঘাত, আগ্রহ সবই বাঙালি বাঙালি। এটাও পয়লা বৈশাখে আমরা পয়লা অভিজ্ঞতা।

‘খাড়াইল কী?’ খাড়াইল এই যে পয়লা বৈশাখ হল বাংলা ও বাঙালির এক পরম বাঙালিয়ানার দিন। আর আমি এক বাঙালি অভিযাত্রী, যার দিন-রাত গুজরান হয় বাংলা গান, নাটক, সিনেমা, সাহিত্যের পরতে পরতে। যতই আমরা বলি যে বাঙালি তার ভাষা ভুলতে বসেছে, হিন্দির প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে, বাংলাধর্মী বিদ্যালয়গুলো প্রায় বন্ধের মুখে, সবাই তার বাচ্চাকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করতে চাইছে, এক আজগুবি ভাষায় বাঙালিরা কথা বলে, তবুও বলি, এখনও কবীর সুমন বাংলা খেয়াল তৈরি করেন। এখনও শীর্ষেন্দু বাংলাতেই লেখেন, শ্রীজাতর কবিতা বাঙালির গর্ব...দুরন্ত রকস্টার রূপম ইসলাম বাংলা গানই করেন। আর আমি ওইমুসাফিরখানায়বসে থাকি সেই বাঙালির জন্য, যার জন্যই অপেক্ষা করা যায় বহুবছর, বহু পয়লা!

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE