Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Riju Basu

খাওয়া, না-খাওয়ার বেলা

মারী-মন্বন্তর থেকে দেশভাগ-রাজনীতি যুগে যুগে বাঙালির মেনু ঠিক করে দিয়েছে। লিখছেন ঋজু বসু মারী-মন্বন্তর থেকে দেশভাগ-রাজনীতি যুগে যুগে বাঙালির মেনু ঠিক করে দিয়েছে। লিখছেন ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭ ১৪:৫৮
Share: Save:

লীলা মজুমদারের ঘোতনার কথা ভাবলে মনটা সত্যিই খারাপ হচ্ছে।

সেই যে ছেলেটা খেতে বসে বরাবর ঝিঙে, পটল, বেগুন, কুমড়োর মতো রাবিশগুলো ঠিক এক ফাঁকে জঞ্জালের মতো ভ্যানিশ করে দিত, সে-বেচারি এখন কী করবে!

বাঙালির আর একটা নতুন বছরের প্রাক্কালে, পাত থেকে এ বার মাছ-ডিম-মাংস ভ্যানিশ হওয়ার চোরা আশঙ্কা। বচ্ছরকার সুখাদ্যের স্বপ্নের মাঝে শুনতে পাচ্ছি নয়ডাবাসী পুরনো বন্ধুটির কণ্ঠ। দু’টো রোববার আগেই খবরটা যাচাই করতে তাকে ফোন করেছিলুম। ওই তল্লাটে আমবাঙালির মাছমুরগির দোকান কি সত্যিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে? একটু থেমে সে বলল, ‘হ্যাঁ রে, খবরটা সত্যি।’ নয়ডায় ওর বাড়ি সেক্টর ৫১-র তল্লাটে মাছবাজার বন্ধ। দিল্লি লাগোয়া গাজিপুরের বিরাট পাইকারি আমিষ বাজারের দশাও তথৈবচ। ফি-রোববার সাপ্তাহিক মাছ কেনা উপলক্ষে টালিগঞ্জ, সোদপুর, বাঁকুড়া, বাগনানের প্রবাসী বাঙালি সম্মেলনেরও অতএব দফারফা। গৈরিকধারী নয়া মুখ্যমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশে তখতে বসার পর থেকেই আমিষে একটানা অঘোষিত কার্ফু। কোনও হাইপার মার্কেট কিংবা দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক, ময়ূরবিহার থেকে মাছ মিলছে কেঁদেককিয়ে। কলকাতাতেও প্লাস্টিক ডিমের গুজবে বাঙালি খামোখা খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেল।

আমিষপ্রেমী রসনা পরিতোষের রাস্তায় এমন বিরাট ধসের খবর শুনেও একটু বেয়াড়া হাসি ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। সেই যে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন,

মৎস্য খাইনে কেন না পাই নে, মাংসেরও বেলা তাই হে, অগত্যা রোজই নিরামিষভোজী গাছপাঁঠা পেড়ে খাই হে।

অর্ধশতক আগে সেটা মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন মশাইয়ের আমল। দারুণ খাদ্যসঙ্কট, আকাশছোঁয়া দর। বাঙালির পাতের ভাত থেকে সন্দেশ-রসগোল্লার দুধের ছানায় অবধি হাত পড়েছিল বটে। খাস কলকাতায় সন্দেশ-রসগোল্লা তখন নিষিদ্ধ। কেসি দাশের আদি দোকান বন্ধ করে উত্তর কলকাতায় বাঁধানো ফলকে রসগোল্লার এপিটাফ অবধি লেখা হয়ে যায়।

সরকারি ফতোয়ায় শ’য়ে শ’য়ে মিষ্টির দোকান বন্ধের ফিরিস্তিও ধরা আছে অন্নদাশঙ্করের ছড়ায়,

এখন বল কে জোগাবে, স্বল্পতম দুগ্ধ, এই সন্দেশ শেষ সন্দেশ হে সন্দেশমুগ্ধ।

সুখের কথা সে দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়নি। তবে পছন্দের খাবারের জন্য বাঙালিকে তখনও লড়তে হয়েছে। চাল কম খান বা গম কিংবা কাঁচকলা খানের ফতোয়া নিয়ে পথে নেমে একদিন কম আন্দোলনটা করেনি বাঙালি। আবার একেলে মাল্টিপ্লেক্সে বেয়াক্কেলে চড়া দামের ভেজ সামোসা আর পপকর্ন সে ভালমানুষটির মতো মুখ বুজে গিলছে। তবু তার খাদ্যাভ্যাসের পথে ধর্মের চোখরাঙানি এমন ছড়ি ঘোরাবে, তাও কে-ই বা কস্মিনকালে ভেবেছিল!

•••

পেটের টানে যস্মিন দেশে যদাচারের রীতি অবশ্য কবেই মেনে নিয়েছি আমরা। মারী-মন্বন্তর থেকে দেশভাগ-রাজনীতি-দেশান্তর পাড়িও যুগে যুগে বাঙালির মেনু ঠিক করে দিয়েছে। জার্মান দেশে মশলাহীন ‘যাবনিক’ খাদ্য খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গিয়েছিল ঘোর ভেতো মুজতবা আলির। বহু সাধনার পরে কোন হোটেলে ভাতের পাতে হাঙ্গারিয়ান গুলাশের হদিস পেয়ে যেন আদরের মাংসের ঝোল-ভাতকে খুঁজে পান তিনি। আবার দূরে গিয়ে শিকড়কে নতুন করে চেনাও হয়েছে বইকী! নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটের ডেরা থেকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে বাঙালিনীর গলায় খুশি ঝরেঝরে পড়ে। ‘‘জান কী, সিদল, লইট্যা, নোনা ইলিশ, চিংড়ি শুঁটকি— একসঙ্গে এমন অঢেল স্টক কক্ষণও কলকাতায় দেখিনি।’’

জমপেশ আইসক্রিমের সঙ্গে ওদের এখন ডেলি চলছে শুঁটকি-বিলাস। বোঝা যাচ্ছে চলবেও কিছু দিন। মনে পড়ে গেল, এই কলকাতায় পাঁচতারা হোটেলে বসে বিলেতে ম্যানুফ্যাকচার-বট্‌লিং-করা নাগা লঙ্কার আচার চেখে কেমন চমৎকৃত হয়েছিলুম। এ শহরে আগত সিলেটের ভূমিপুত্র ব্রিটিশ বাংলাদেশি শেফদের সৃষ্টি লঙ্কার আচারের ব্র্যান্ড ‘মিস্টার নাগা’। উত্তর বাংলাদেশ-মেঘালয় সীমান্তের দুরন্ত ঝাল, অ-সামান্য সুগন্ধী মির্চি ‘নাগা লঙ্কা’ নামেই পরিচিত। সিলেট থেকে বিলেত হয়ে কলকাতা এসেছে। সার্ডিন মাছের ভর্তায় এ হেন লঙ্কার অভিঘাত রসিক খাইয়ের জিভে জমাটি মেহফিলের ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে যাবে। নাগা লঙ্কার মতো সিলেটি সুগন্ধী লেবু সাতকোরাও সেই প্রথম চাখার সুযোগ হয়েছিল। বোয়াল মাছ থেকে বিফের এমন রাজযোটক মেলা ভার। ইদানীং ঝালে-ঝোলে-অম্বলে গন্ধলেবুর আতিশয্যে মেতেছে বাঙালি। কিন্তু সাতকোরা এখনও কলকাতায় প্রায় অজানা। সে-বার মাথার পিছন দিয়ে হাত ঘুরিয়ে নাক ধরার মতোই সিলেটের লেবু বিলিতি শেফদের সঙ্গে লন্ডন হয়ে আমার কাছে ধরা দিয়েছিল।

•••

চেনা কলকাতাটার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে এমন অজস্র খোপখোপ স্বাদ-স্বর্গ। বইমেলার মাঠে সাদিক-শামিমদের সঙ্গে জমাটি আড্ডায় হাঁ করে শুনি পালং শাকের ডাঁটি দিয়ে জমাটি রেড মিটের কাহিনি। কে জানে অম্বর রেস্তোরাঁয় গরগরে সাগ মাটনের মতোই হবে হয়তো বা! শুধু কি শাক? কুমড়ো, পটল, ওল, লাউ— সব-কিছুতেই মাংস হয়। হাওড়া শিবপুরে শামিম-নবনীতাদের বাড়ির আড্ডায় কুমড়োছোলা দিয়ে মাটন খেতে খেতে আঙুল না-চেটে থামতে পারি না। চেনা কুমড়োর ছক্কার এ কোন ছক-ভাঙা অবতার। লীলা মজুমদারের ঘোতন থাকলে নির্ঘাত চমৎকৃত হতো, আ-হা, এ কুমড়োর প্রতি গ্রাসেই কি চমৎকার মাংসের আমেজ?

অনেকটা একই ধাঁচে আমিষের জয়জয়কার প্রদীপদা মানে প্রদীপ রোজারিওর বাড়িতেও। ইলিশের ডিমের সঙ্গে উচ্ছের গরগরে কষা। বাঁধাকপির সঙ্গে পর্ককুচি। সর্ষের তেলে ভাজা সসেজ ও ভাতমাখা। কষা মাংস, মালাইকারি, সর্ষে ইলিশের ক্লিশে বাঙালিয়ানার বাইরে এ সব হিরেমুক্তো অনেকেরই সিলেবাসের বাইরে থেকে গিয়েছে।

•••

না বাজার, ফুডকোর্ট, এসি ছাদের নীচের মস্ত বিপণী-সম্ভারের বাইরের এক এলাহি বুফেও আমাদের নিত্য নেমন্তন্নের হাতছানি দেয়। এই তো সে দিন বিরাটি স্টেশনের ধারে মন্টু-গীতাদের ঝুপড়ির অসু্স্থ ছেলেটা পেট পুরে ‘অখাদ্য মাংস’ ও মুরগির ছাঁট পেয়ে ফের সতেজ, ছটফটে হয়ে উঠছে ভেবে খুশি হই।

স্বাদচেতনার এই পেল্লায় মানচিত্রে ইদানীং এই দেশেরই আলওয়ার, জয়পুর, বা দাদরির ঘা-খাওয়া ক’টা চেহারা ঢুকে বেমক্কা বিষম খেতে হচ্ছে। পার্কসার্কাস বাজারের বিখ্যাত সসেজ, জাকারিয়া স্ট্রিটের খিরি কবাব, সুতি কবাবের সঙ্গে আসলে ঝগড়া নেই বড়বাজারের চটপটা সাংরি শাক, ঠাম্মার স্মৃতিবিজড়িত রাজকীয় কিন্তু স্নিগ্ধ চাপড় ঘণ্টের। আমিষ-নিরামিষ যা-ই হোক, কারও সঙ্গেই এত দিন তৃপ্তি বা আনন্দ ছাড়া আর কিছুর সম্পর্ক খোঁজার কথা তো মাথায় আসেনি। ইদানীং তা-ও আসছে। খাওয়া, না-খাওয়াটা আপরুচি। তার সঙ্গে বীরত্ব বা প্রতিবাদের সুদূরতম সম্পর্ক নেই। এ বড় সুখের সময় নয়, নিজের বা আর কারও জন্য পছন্দের খাদ্যের আর্জিটাও যখন রাজনৈতিক মাত্রা পাচ্ছে।

এ নববর্যে বাঙালির পাকস্থলিটাও অতএব অবিসংবাদিত ভাবে রাজনীতির ময়দান। কে জানে, হয়ত এই পেটুকের সীমান্তহীন আন্তর্জাতিকতাবোধেই বাঙালির ক্রমমুক্তি হবে।

কার্টুন: দেবাশীষ দেব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE