Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Rabindra Jayanti Special

‘সব শিল্পীরই ২৭ নম্বর অনুষ্ঠানে গাইতে যাওয়ার তাড়া’

এখন আর কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় না। নিজেকে প্রেজেন্ট করার, নাম করার চাহিদাই এখন প্রবল! প্রমিতা মল্লিকের মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়এখন আর কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় না। নিজেকে প্রেজেন্ট করার, নাম করার চাহিদাই এখন প্রবল! প্রমিতা মল্লিকের মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৭ ১৫:১০
Share: Save:

প্রশ্ন: পঁচিশে বৈশাখ কলকাতার কোন অনুষ্ঠানে গাইছেন ?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন আমার কাছে নিশ্চয়ই একটা শ্রদ্ধার দিন। কিন্তু দিনটাকে ঘিরে যেমন পাগলামি হয়, তার সঙ্গে আর থাকতে চাইছিলাম না।

প্রশ্ন: সে কী!

উত্তর: একদিনে তিরিশটা অনুষ্ঠান। শিল্পীরা কেউ কারও গান শোনেন না। সকলেরই সাতাশ নম্বর অনুষ্ঠানে গান গাইতে যাওয়ার তাড়া। এই তাড়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করার চেয়ে কোনও একটি অনুষ্ঠানে অনেক গান গেয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আমার বেশি ভাল লাগে। মনে হয় আজ এটাই প্রাসঙ্গিক।

প্রশ্ন: যুদ্ধ, হিংসা হানাহানির যুগে রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রাসঙ্গিক?

উত্তর: ক্লাসে ‘মুক্তধারা’ নাটকের গান শেখাচ্ছিলাম। ধন়ঞ্জয় বৈরাগীর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আজকের অসহিষ্ণুতার কথাই তো বলছেন। ‘আরও আরও প্রভু আরও আরও’, আমাকে হিংসের জন্য মারতে পারো তোমরা, কিন্তু সেই আঘাত শুধুই আমার চামড়ায়, গায়ে লাগে। আমার হৃদয়ে তা ঘা দেয় না, আমার হৃদয়ে জ্যোতি আছে। মারের কোনও শেষ নেই! ‘মুক্তধারা’তেই আছে, পায়ের তলায় চেপে রাখতে হবে দুর্বলকে। যা হিটলার করেছেন। মুসোলিনীও করেছেন। কোনও প্রতিপক্ষ যেন না থাকে। রবীন্দ্রনাথ জাপানে ‘ন্যাশনালিজম’-এর বইটা সকলের পড়া দরকার। ক’জন পড়েছি আমরা? এখন তো অনেকেই না জেনে, না বুঝে রবীন্দ্রনাথকে ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ বলে! রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার কথা বলেছিলেন। সেটা আমরা কেউ করিনি। একটা বাচ্চা জন্মানোর পরে তাকে ধর্ম, জেন্ডার সব দিয়ে বেঁধে ফেলা হচ্ছে।

প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ-তেও সেই হানাহানি...

উত্তর: একদমই তাই। মব সাইকোলজি চমৎকার ফুটে উঠেছে। যে পথ দেখাতে চেয়েছিল তাকেই মেরে ফেলা হল। পরে বুঝলো এতে শান্তি নেই। তার দেখানো রাস্তাতেই চলল।

প্রশ্ন: আপনাকে যদি কলকাতায় কবিপক্ষের অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হত, আপনি কী করতেন?

উত্তর: আমি এক এক বছর এক একটা অঞ্চলে একটা করে অনুষ্ঠান করাতাম। জোড়াসাঁকো তো জন্মস্থান। সেখানে তো হবেই। কিন্তু তা ছাড়াও একটাই অনুষ্ঠান করতাম। এক বার মধ্য কলকাতায়, আর এক বার উত্তরে বাছাই করা শিল্পীরা গান গাইতেন। সকলকে নয়। তাতে অনুষ্ঠানের মানও অনেক উঁচু হত। আর লোকের আগ্রহ থাকত। এখন তো সবাই চা খায় আর গল্প করে। গান কেউ শোনে না।

প্রশ্ন: তা হলে কবিপক্ষের এই হুজুগ কি রবীন্দ্রনাথের গানের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে?

উত্তর: নাহ্‌, তা বলিনি। এমন অনেক শিল্পী আছেন, যাঁদের কবিপক্ষেই শুধু শুনতে পাই। ভালও লাগে তাঁদের গান। তবে এখন আর কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় না। নিজেকে প্রেজেন্ট করার, নাম করার চাহিদাই এখন প্রবল! এখন রবীন্দ্রসঙ্গীত কেউ চর্চা করে বলে মনে হয় না। তারা সুর খুব ভাল লাগায়। এমমিউজ পাশ। আমার থেকে গলাও ভাল। কিন্তু ভাবের জায়গা নেই। মজার কথা, এখন যেটুকু সিডি বিক্রি হয় তার বেশির ভাগটাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের। সে কারণেই অন্য গানের শিল্পীরাও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি করেন। রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে ক’জন রবীন্দ্রসঙ্গীত গান?

প্রশ্ন: কিন্তু অন্য রকম রবীন্দ্রসঙ্গীতে হাততালি বেশি পাওয়া যায়...

উত্তর: এখন অস্থিরতার সময়। সকালে লোকে বাড়ি থেকে বেরচ্ছে, জানে না ফিরবে কি না। যা চাই এক্ষুনি চাই। তাই গিমিক করে চট করে যদি সাফল্য পাওয়া যায়! এগুলো ডিস্টরশন। তবে গান গাওয়ার সময় মাথা, নাক গীতবিতানে গুঁজে দিলাম। এমনটা এ নয়। এটা তো মানতেই হবে আগের কোনও জিনিসই টানা ভাল লাগে না। গানের ক্ষেত্রেও পরিবেশনের ধারাটা বদলে যায়। পঙ্কজ মল্লিক বা কে এল সায়গলের গান আমাদের প্রজন্ম পছন্দ করে। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের তা পছন্দ হবে না। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা রিদমের গানের সাঙ্ঘাতিক ভক্ত। সেই কথাও মাথায় রাখতে হবে। তবে অযথা কালোয়াতির দরকার নেই। যেমন সুভাষ চৌধুরী বলতেন, ভাঙা গান তো রাগ থেকেই এসছে। আবার তাকে ভাঙা কেন? তান, কালোয়াতি...! রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, ‘‘সে দিন কি আসবে? যখন লোকে গানের সুর ভাল না বলে বলবে ভাব ভাল।’’ আমি সেই দিনের অপেক্ষায়।

কবিপ্রণাম। ২৫শে বৈশাখ, ১৪২৪। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

প্রশ্ন: এখন তো কথা ছুড়ে ছুড়ে, গানটা আড়ে ধরার, গানের শেষ অংশটা অ্যাবরাপ্টলি শেষ করার একটা ট্রেন্ড এসেছে। বলা হচ্ছে এটাই কমার্শিয়াল গান। এটাই কি তবে বদল?

উত্তর: কমার্শিয়াল গান বলে কিছু হয় না। বেশির ভাগই তো আজকাল সুর আর স্বরলিপি পড়ে গান গায়। রবীন্দ্রনাথ না পড়েই ‘বড় আশা করে এসেছি গো’ গানের সঙ্গে আজও ঝ্যাং ঝ্যাং করে লোকে ম্যারাকাস বাজায়, আর শ্রোতারা আহা! করতে থাকে। আমার তাদের কাছে প্রশ্ন, ওই গানের কথায় আছে ‘দীনহীনে কেহ চাহে না’র মতো বাণী, সঙ্গে এই যন্ত্রানুষঙ্গ কি যায়?

প্রশ্ন: কিন্তু লোকে ওই গান ওই ভাবেই তো শুনতে চায়?

উত্তর: চাইলে ওই ভাবেই গান চলুক। তবে আমার দীর্ঘ দিনের শিক্ষা যা বলে আমি তাই করব। চেষ্টা করব আমার গান যাতে লোকে পছন্দ করে।

প্রশ্ন: আজকের দুনিয়ায় একজন শিল্পীকে কী ভাবে রেট করা হয়?

উত্তর: এখন মিডিয়া ঠিক করে দেয় কে ভাল শিল্পী। মজার কথা, ক্রমাগত টিভির পর্দায়, কাগজে তার নাম দেখতে দেখতে আমরাও বিশ্বাস করি যার মুখ যত বেশি দেখব সেই সব চেয়ে ভাল শিল্পী। গান শোনার চেয়ে মুখ দেখানোটা এখন বেশি জরুরি। লোকে ভাববে আমি হিংসা করছি, তাই এমন বলছি। সেটা ভুল। এখন আর হিংসে করার আমার কিছু নেই।

প্রশ্ন: হারমোনিয়াম আর এস্রাজ বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বড্ড প্যানপেনে হয়ে যাচ্ছে...

উত্তর: এটা একদম বাজে কথা। যাঁরা পারেন না গান করতে, তাঁরাই এমন বলেন। যাঁদের কণ্ঠ সচল নয়, তাঁরা নিজেদের গলা ঢাকতে অনেক বেশি যন্ত্র ব্যবহার করেন। আমার এই বয়সেও এস্রাজ আর তানপুরা নিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি গানকে কতটা প্রাণবন্ত করা যায়। তবে অনর্থক অনেকেই গান ভীষণ টেনে টেনে গায়, এটাও ঠিক।

প্রশ্ন: এক জন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এবং শিক্ষক হয়ে সামপ্লেস এল্স-এর মতো জায়গায় গান গাইতে গেলেন কেন?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ কোথাও কি বলেছেন কেবল জুঁইফুলের মালা জড়িয়ে সাদা শাড়ি পরেই তাঁর গান গাইতে হবে? আমি যদি ড্রামের সঙ্গে ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ গাই, তাতে দোষ কী? সকলে এত এনজয় করেছিল, ভাবা যায় না। আমি ক্যাফে কফি ডে-তেও গান গেয়েছি। বহু অবাঙালির সামনে খালি গলায় গান গেয়েছি। যদি গান গেয়ে আনন্দ পাওয়া যায়, তা হলে যে কোনও জায়গাতেই গান গাওয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন: অ্যানিমেশনে ‘তাসের দেশ’ করার কথা ভাবছেন...আপনি কিউ-এর ‘তাসের দেশ’ দেখেছেন?

উত্তর: হ্যাঁ, আমার রুচির সঙ্গে মেলেনি। তাই ভাল লাগেনি।

প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে রুচি, শিক্ষা কতটা জরুরি? রিকশাওয়ালা কি রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে না?

উত্তর: বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট যে ‘লুঙ্গি ডান্স’-এর জনপ্রিয়তা কখনও ‘মল্লিকাবনে’-র হবে না। রবীন্দ্রনাথের গান রিকশাওয়ালার ভাল লাগবে না।

প্রশ্ন: ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে কথায় কথায় বলছেন বয়স হয়েছে, মৃত্যুর আগে কিছু গান রেকর্ড করে যাব...এখনই কেন মৃত্যুর কথা বলছেন?

উত্তর: নাহ্, বয়স বাড়ছে। গলাটাও তো এ বার খারাপ হবে।

প্রশ্ন: আর একটা প্রমিতা মল্লিক তো হল না!

উত্তর: প্রমিতা মল্লিক কে! এখন আমার স্টেটাস হচ্ছে তাকে তুলে রাখো, মাঝে মাঝে সংবর্ধনা দাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE