Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Rabindra Jayanti Celebration

চুপ চুপ, কথা নয়

‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে।’ রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ উক্তি মনে করালেন অভ্র ঘোষ‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে।’ রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ উক্তি মনে করালেন অভ্র ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৭ ১৪:৩২
Share: Save:

আবার পঁচিশে বৈশাখ এলো। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ, নাকি পুজো, করতে হবে। এটা এখন একটা আনুষ্ঠানিক কাজ। অথচ সারা বছর আমরা একে অপরকে গালমন্দ করছি, মারধর থেকে শুরু করে খুন করছি, খুনের হুমকি দিচ্ছি। কেবল রাজনীতির কারণে নয়, সমাজজীবনে বা পারিবারিক তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্বার্থের কারণে আমরা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করছি। হানাহানির কোনও শেষ নেই। যে যত গলা উঁচিয়ে চিৎকার করবে, বাহুবলের আস্ফালন দেখাবে, অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনাবে— হতভাগ্য জনতা তাঁদের হাতেই নিজেকে সঁপে দেবে। এটাই এখনকার রীতি, সাম্প্রতিক কালে এটাই বদ্ধমূল রাজনীতি। এ সব ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে বাঙালির কিছুই নেবার নেই, রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার-টুত্তরাধিকার ইত্যাদি শব্দ নেহাতই কেতাবি, অথচ কারণে-অকারণে রবীন্দ্রনাথের কথা বলতেই হবে। এ-ও এক বিষম আপদ। আর দিনে দিনে এ সব কথাবার্তাও কেমন পানসে হয়ে যাচ্ছে।

আমার এই খেদোক্তি-বাচনের সূত্রে হঠাৎ মনে পড়ে যাচ্ছে বাইশ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথের কথা! জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে তখন ‘সাধনা’ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
ওই পত্রিকায় তরুণ কবি লিখলেন দুটি নাতি-দীর্ঘ নিবন্ধ। রচনা দুটির নাম ‘চেঁচিয়ে বলা’ (১৮৮২) আর ‘জিহ্বা আস্ফালন’ (১৮৮৩)। পাঠকরা খেয়াল করবেন এই দুটি লেখা যখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তখনও জাতীয় কংগ্রেস দলের জন্ম হয়নি। কিন্তু তাতে কি, দেশসেবার নামে বাঙালির চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। সদ্য-প্রয়াত বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য তাঁর এক রচনায় লিখেছিলেন, উনিশ শতক এক অর্থে বাঙালির বাচালতার যুগ। বহু আগে তরুণ রবীন্দ্রনাথ সেই কথাই সবিস্তারে লিখে জানিয়েছিলেন:
‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। চেঁচিয়ে দান করে, চেঁচিয়ে সমাজ সংস্কার করে, চেঁচিয়ে খবরের কাগজ চালায়, এমনকি, গোল থামাইতে গোল করে।...কাজেই বঙ্গসমাজে চেঁচানোটাই চলিত হইয়াছে। পক্ষীজাতির মধ্যে কাকের সমাজ, পশুজাতির মধ্যে শৃগালের সমাজ, আর মনুষ্য জাতির মধ্যে বাঙালিসমাজ যে এ বিষয়ে শ্ৰেষ্ঠতা লাভ করিয়াছে, ইহা শত্রুপক্ষকেও স্বীকার করিতে হইবে।’
চেঁচিয়ে বলা নিবন্ধটিতে এই কথাগুলি আছে। আগেই বলেছি এই রচনা প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রিকায় ১২৮৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় (অর্থাৎ ১৮৮২-র মার্চ মাসে)। আর এর ঠিক চার মাস বাদে চৌঠা জুলাই, ১৮৮৩ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ দু-মাস কারাদণ্ড ভোগ করে মুক্তিলাভ করলেন। নরিস সাহেবের অভিযোগক্রমে আদালত অবমাননার দায়ে সুরেন্দ্রনাথের শাস্তি হয়েছিল। তাঁর মুক্তির দিন নিমতলা ফ্রি চার্চ কলেজের ছাত্ররা তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং দিন পনেরো পর এক বিরাট জনসভায় সুরেন্দ্রনাথকে নিয়ে তীব্র মাতামাতি হয়। রাষ্ট্রগুরু অবশ্য জনসাধারণকে ধৈর্য ও মিতব্যবহার অবলম্বনের জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ সুরেন্দ্রনাথের উপদেশবার্তায় খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু জনগণের মাত্রাতিরিক্ত ভাবাবেগ দেখে লিখলেন তাঁর দ্বিতীয় নিবন্ধ ‘জিহ্বা আস্ফালন’। ‘চেঁচিয়ে বলা’ নিবন্ধের কথাগুলির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ একটা গল্পও বলেছেন কবি তার এই দ্বিতীয় রচনায়।
‘এইখানে একটা গল্প বলি। একটা পাড়ায় পাঁচ-সাতজন মাতাল বাস করিত। তাহারা একত্রে মদ্যপান করিয়া অত্যন্ত গোলমাল করিত। পাড়ার লোকেরা একদিন তাহাদিগকে ধরিয়া অত্যন্ত প্রহার দিল। সেই প্রহারের স্মৃতিতে পাঁচ-সাতদিন তাহাদের মদ খাওয়া স্থগিত রহিল, অবশেষে আর থাকিতে না পারিয়া তাহারা প্রতিজ্ঞা করিল আজ মদ খাইয়া আর কোনো প্রকার গোল করিব না। উত্তমরূপে দরজা বন্ধ করিয়া তাহারা নিঃশব্দে মদ্যপান আরম্ভ করিল। সকলেরই যখন মাথায় কিছু কিছু মদ চড়িয়াছে, তখন সহসা একজনের সাবধানের কথা মনে পড়িল ও সে গম্ভীর স্বরে কহিল, ‘চুপ’। অমনি আর একজন উচ্চতর স্বরে কহিল ‘চুপ্’। তাহা শুনিয়া আবার আর-একজন আরও উচ্চস্বরে কহিল ‘চুপ্’, এমনি করিয়া সকলে মিলিয়ে চীৎকারস্বরে ‘চুপ্ চুপ্’ করিতে আরম্ভ করিল— সকলেই সকলকে বলিতে লাগিল ‘চুপ্’। অবশেষে ঘরের দুয়ার খুলিয়া সকলে বাহির হইয়া আসিল, পাঁচ-সাতজন মাতাল মিলিয়া রাস্তায় ‘চুপ্ চুপ্’ চিত্কার করিতে করিতে চলিল, ‘চুপ্ চুপ্’ শব্দে পাড়া প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। আমাদের উঠ জাগো শব্দটিও কি ঠিক এইরূপ হয় নাই? সকলেই সকলকে বলিতেছে, জাগো, কে যে উঠে নাই ও কে যে ঘুমাইতেছে সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত ভালোরূপ মীমাংসাই হইল না।’’
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় টেলিভিশন চালু হয়নি। সন্ধে গড়ালে অসংখ্য বাংলা-ইংরেজি চ্যানেলে পলিটিক্যাল টক-শোর ছড়াছড়িও ছিল না। অথচ কী আশ্চর্য দূরদর্শিতায় কবি ‘চুপ্ চুপ্’-এর গল্পটি লিখেছিলেন, ভাবলে রোমাঞ্চ হয়। ‘জিহ্বা আস্ফালন’ নিবন্ধের শেষাংশে রবীন্দ্রনাথ আরও কিছু অভ্রান্ত কথা লিখেছিলেন:
‘অধিকাংশ বঙ্গযুবক মনে করেন পেট্রিয়ট হইতে হইলে হঠাৎ অত্যন্ত উন্মাদ হইয়া উঠিতে হইবে, হাত-পা ছুঁড়িতে হইবে, হুটোপাটি করিতে হইবে, যাহাকে যাহা না বলিবার তাহা বলিতে হইবে।....যতদিন পর্যন্ত না আমরা আত্মসংযম করিতে শিখিব, যতদিন পর্যন্ত অপরিণত বুদ্ধির ন্যায় আমাদের ভাবে ভাষায় ব্যবহারে একপ্রকার ছেলেমানুষী আতিশয্য প্রকাশ করিব, ততদিন পর্যন্ত বুঝিতে হইবে যে, আমরা স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত হইতে পারি নাই।’
একশো চৌত্রিশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক হালচাল লক্ষ করে এই কথাগুলি লিখেছিলেন। আজ অবশ্য অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। কেবল দাঁত-মুখ খিচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলা নয়, প্রবল উন্মাদনায় গুলি-বোমা-বন্দুক-বারুদের সঙ্গে রাম-রাবণের, বালী-সুগ্রীবের লড়াই চরমে পৌঁছেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় রবীন্দ্রনাথকে আমরা ভুলতে পারছি না। পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণ এলেই আমরা কবি-বন্দনায় মেতে উঠি! এ-ও এক দৃঢ়মূল অন্ধ সংস্কার হয়ে উঠছে না তো!
এই সুযোগে একটা কথা বলি। রবীন্দ্র-ভীরু ভদ্র বাঙালিদের অধিকাংশই পরিণত রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্রের চর্চাই বেশি করেন, অল্প-বয়সের রবীন্দ্রনাথ যে অগণ্য তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছিলেন, তা নিয়ে আর একটু বেশি চর্চা করলে মন্দ হবে না।

অলঙ্করণ: অর্ঘ্য মান্না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE