Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Rabindra Jayanti Celebration

তুমি খুশি থাকো

পরের প্রজন্মের কাছে দাবি রাখি, ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান।’ নিউ ইয়র্ক থেকে লিখছেন পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়পরের প্রজন্মের কাছে দাবি রাখি, ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান।’ নিউ ইয়র্ক থেকে লিখছেন পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র।

অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র।

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৭ ১২:৩০
Share: Save:

“আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো।’’

আমার মেয়ের নাম রেখেছিলাম নন্দিনী। অচলায়তনের বিরুদ্ধে, স্থবিরতার বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিভীষিকার বিরুদ্ধে, অন্ধকারের জগতে আলো নিয়ে আসার সংগ্রামে নন্দিনীর সাহস ও সৌন্দর্য যে প্রেরণা আমাকে দিয়ে এসেছে সারাজীবন, মহাকবিকে তার একটুখানি প্রতিদানের ইচ্ছে মেয়ের নামকরণের মধ্যে দিয়ে চেয়েছিলাম।

এই সুদূর প্রবাসের নিঃসঙ্গতায়, নির্বাসনে, বিষণ্ণতায় মহাকবির অফুরান সূর্যকিরণ মনকে বাঁচিয়ে রাখলো এই দীর্ঘ তিরিশ বছর। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্য কোনও ভাষা আমার তো জানা নেই!

নন্দিনীর পানে চেয়ে চেয়ে আমরা খুশি থেকেছি। আর, মহাকবিও খুশি হবেন, এই আশা করেছি চিরকাল।

রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছি সারাজীবন। তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক সেই কবেকার কলকাতার ফুটবল-ক্রিকেট, মায়াময় জীবনটা থেকে আজ পর্যন্ত শিরায় শিরায় পাতায় পাতায় ডালে ডালে কাঁপন দিয়ে গেছে। তখন তেমন করে বুঝিনি। দেবতার মতো পুজো করেছি ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁয়ার পিছন হতে। স্পর্শ করতে পারিনি। স্পর্শ অনুভবও করিনি।

সে অনুভব, সে রিয়ালাইজেশন এসেছে প্রবাসে দীর্ঘকাল কাটিয়ে। যেখানে এখন প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, জীবতারা যদি খসে দৈবের বশে। কিন্তু তার পরেই মনে হয়, খেদ থাকবে না, মহাকবি যদি মনে রাখেন আমায়। যদি মহাকবির চরণ ছোঁয়ার সুযোগ পাই, তা হলে ‘মক্ষিকাও গলে নাকো পড়িলে অমৃতহ্রদে।’ সে অমৃতহ্রদের সন্ধান আমি পেয়েছি। এই অনুচ্চারিত জীবনে ধ্রুবতারার সন্ধান পেয়েছি। তাই এই সেলুলার জেলের প্রায়-নিশ্ছিদ্র অন্ধকার জীবনসমুদ্রে নিজেকে আজ আর পথহারা মনে হয় না।

নন্দিনীও নিজের মনের খুশিতেই তার পথ খুঁজে পেয়েছে। সে এখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট থিসিস লিখতে ব্যস্ত। বিষয়: আমেরিকার বাঙালি অভিবাসীদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব।


সজনীকান্ত দাশ, যদুনাথ সরকারদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।

এই একটা কাজ করে গেলাম এই ছোট্ট, অনুল্লেখিত জীবনে। নতুন বাঙালি প্রজন্মকে মহাকবির মহাজ্যোতির একটা ক্ষুদ্র অংশ দিয়ে গেলাম। বাংলা ভাষা কি বেঁচে থাকবে? বাংলা সংস্কৃতি কি বেঁচে থাকবে? বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়-বিরোধী, ভালবাসা-করুণা-সমানাধিকারের মূল্যবোধ কি বেঁচে থাকবে? লালন-মধুসূদন-রামমোহন-বিদ্যাসাগর-ডিরোজিও-সূর্য সেন-প্রীতিলতা-অমর্ত্য-সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মুজতবা— বাঙালি জীবনদর্শন কি ধ্বংস হয়ে যাবে? এ সব প্রশ্ন যখন আর কেবলমাত্র তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, নিয়ন্ত্রণহীন দ্রুতগামী প্রাইভেট বাস ঘাড়ে এসে পড়ে শেষ করে দেওয়ার মতোই ভয়ঙ্কর বাস্তব, তখন দূর থেকে, এই সুদূর প্রবাস থেকে সে ভয়ের ছবি দেখে শিউরে উঠি। মনে হয়, আমাদের কি কিছু করার আছে? আমাদের কি কিছু কর্তব্য আছে এই ক্লেদাক্ত বেনোজলের সুনামি রোধ করার?

হয়তো আছে। হয়তো নেই। মার্কিন মুলুকে জন্মানো, বড় হওয়া মেয়েকে সে উদারনৈতিক জীবনদর্শনের প্রধান এক পথিকৃৎ যিনি, তাঁর সৃষ্টির আলোকে একটু আলোকিত করে গেলাম। ভরসা রাখি নতুন প্রজন্মের প্রতি। নবজাগ্রত প্রাণ চিরযৌবনের জয়গান গাইবে, এই বিশ্বাস মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। তাদের চোখে মুক্তচিন্তার আলো দেখি।

মহাকবি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জনম দাও।’ আমি আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে প্রার্থনা করি, ‘তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও।’ তোমরা আলোর পথযাত্রী। তোমাদের আলোতে, তোমাদের কর্মশক্তিতে পৃথিবী জড়তা-তামস-উত্তীর্ণ হবে। এ নিদারুণ কুয়াশার ক্লান্তিজাল বিদীর্ণ হবে। তাদের কাছে আমি দাবি রাখি, ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান।’

আমাদের মহাকবি, আমাদের জীবনের মহাগুরু আমাদের সে গান গাইতে শিখিয়ে গেছেন। ভয় কী তোমাদের?

কিন্তু, এ শুধু সেন্টিমেন্টের কথা নয়। শুধু আবেগ বিলাসে ভেসে যাওয়ার কথা নয়। বাঙালির আবেগ সর্বস্বতার দিন শেষ হয়েছে। শুধু ফুলের মালা আর সুদৃশ্য ভাষণ, সুরঙ্গমা লালপেড়ে শাড়ি, দুর্বল পুরুষের ঢুলুঢুলু চোখ, আর পঁচিশে বৈশাখে খাতা খুলে ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়ার দিন শেষ হয়েছে। এখন, ‘দরকার নেই কবিতার স্নিগ্ধতা।’ কবিতাকে ছুটি দিতে চাই না। কিন্তু কবিকে যাচাই করে নিতে চাই। মধ্যদিনে গান বন্ধ করতে চাই না। কিন্তু সে গানের ভাষা, বাণী, উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করতে চাই।

কিন্তু, বিশ্লেষণ হচ্ছে না। আবেগতাড়িত বাঙালি এক নতুন প্রজাতির ঠাকুর পুজো করছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে করছে, সত্যজিৎকে নিয়ে করছে, যেমন একসময়ে ইন্দিরা গাঁধীকে নিয়ে করেছে, জ্যোতি বসুকে নিয়ে করেছে, ও দিকে বাংলাদেশে শেখ মুজিবকে নিয়ে করেছে। যেখানে যুক্তিতর্ক, বিচার-বিতর্কের রাস্তা বন্ধ। যেখানে স্বেচ্ছায় আমরা মগজে কার্ফু জারি করেছি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE