Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
WORLD AIDS DAY

মুখ ফেরাল স্বজনেরা, ভিন রাজ্যে বেশ আছি

জ্বরটা কিছুতেই কমছিল না। কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেলাম। জ্বরের ওষুধও চলল, কিন্তু জ্বর আর দুর্বলতা যেন সঙ্গ ছাড়তে চাইছে না। লিখছেন রঞ্জন

রঞ্জন
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:১৩
Share: Save:

জ্বরটা কিছুতেই কমছিল না। কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেলাম। জ্বরের ওষুধও চলল, কিন্তু জ্বর আর দুর্বলতা যেন সঙ্গ ছাড়তে চাইছে না। এ দিকে কত দিন আর ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকা যায়! চাকরিটা তো বাঁচাতে হবে। কী করি! আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামের এক মেধাবী ছেলে কলকাতার সরকারি হাসপাতালের বড় ডাক্তার। তখন উনি গ্রামে এসেছিলেন রোগী দেখতে। দাদাদের পরামর্শে গেলাম তাঁর কাছে। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে খুব উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত দেখালো ডাক্তারকে। আমার বড় দুই দাদা আর স্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। জানা গেল, আমার রক্তে এইচআইভি-র জীবাণু পাওয়া গেছে।

বছর দশেক আগের ঘটনা। সেই সময়ে এইচআইভি, এডস এই শব্দগুলো সবে শুনছি। কর্মসূত্রে মুম্বইতে থাকতাম। জানলাম, চরিত্রস্খলনের কারণেই আমার শরীরে এই মারণ রোগের জীবাণু বাসা বেঁধেছে। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন বরফের স্রোত বয়ে গেল। আমার স্ত্রী বা দাদাদের অসুখটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। ডাক্তারবাবু বুঝিয়ে বললেন। আর তাতে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল আমাদের পুরো পরিবারের ওপর। আমার স্ত্রী নিতান্তই ঘরোয়া গ্রামের গৃহবধূ, দুটো ছোট ছোট ছেলে নিয়ে সংসার। তিনি ধরেই নিলেন আমার মৃত্যু আসন্ন। ভয়ানক কান্নাকাটি শুরু করলেন। দাদাদের কাছে গেলাম সাহায্যের আশায়। সেখানে আর এক ধাক্কা। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাঁরা জানালেন যে পৈত্রিক বাড়িতে আমার আর ঠাঁই হবে না। দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। দুটো ছোট শিশু আর স্ত্রীকে নিয়ে কী করব ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। আর মৃত্যুভয় তো ছিলই। সেই সময় দেবদূতের মতো পাশে এসে দাঁড়ালেন ওই ডাক্তারবাবু। গ্রামের মোড়লকে ডেকে আমাদের ভিটেমাটিতে থাকার অধিকার ফিরিয়ে দিলেন। শুরু হল চিকিৎসা। নিয়মিত ওষুধ খাবার পাশাপাশি বাড়ির লোকজনকে রোগের ছোঁয়াচ থেকে বাঁচানোর জন্য বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলার অঙ্গীকার করতে হল। আমার ভুল শোধরানোর উপায় জেনে আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম।

তত দিনে আমার স্ত্রীর শরীরেও ওই রোগের জীবাণু ঢুকে পড়েছে। তবে আমার মতো রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েনি এটাই রক্ষে। ঈশ্বরের আশীর্বাদে ছেলেদের জীবাণু স্পর্শ করতে পারেনি। ওষুধপথ্য নিয়ম সবই তো শুরু হল, কিন্তু চাকরিটা আর থাকল না। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাড়িতে আমাদের একঘরে করে দিল আমার নিজের দাদা-বৌদি-ভাইরা। একেবারে দিশেহারা অবস্থা। তখন আমার বয়স প্রায় চল্লিশের কাছে। জমানো টাকায় পাশে জমি কিনে নতুন করে ঘর বাঁধলাম। কিন্তু কলসির জল গড়িয়ে খেতে খেতে এক দিন তো শেষ হয়ে যাবে। ছেলেদের পড়াশোনা, সংসার খরচ, ওষুধ— কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একঘরে হয়ে হীন জীবনযাপন করছিলাম। ছেলেরা স্কুলে যেত, কেউ ওদের পাশে বসত না। আমার স্ত্রীর দাদা থাকতেন ছত্তীসগঢ়ে। বোন-ভগ্নীপতির দুর্দশার কথা শুনে এলেন দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলায় আমাদের বাড়িতে। উদার মনের এই মানুষটি আমাদের সপরিবার তাঁর সঙ্গে ছত্তীসগঢ়ে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। ছেলেদের নতুন স্কুলে ভর্তি, নতুন বাড়ি, এমনকী, আমার জন্য নতুন চাকরিও ঠিক করে দিলেন দাদা।

বছর আষ্টেক হল আমরা ভিন রাজ্যের বাসিন্দা। ভয়ে কাউকে বলি না যে আমার এডস হয়েছিল। নিয়মিত ওষুধ খাই। কাজও করি। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, তাদের সঙ্গে ছুটির দিনে তাস খেলি, গল্প করি, কিন্তু ভুলেও বলি না আমার অসুখের কথা। আমি এখন ঠিক আছি। মাঝে মাঝে জ্বর সর্দি ডায়েরিয়া হয়, দুর্বল লাগে। বাড়িতে বিশ্রাম নিই। আমার স্ত্রীর কোনও সমস্যাই নেই। রান্না, ঘরের কাজ সবই করেন। ছুটি পেলে কাছাকাছি সবাই মিলে বেড়াতে যাই। জব্বলপুরের মার্বেল রক দেখে এলাম। আমার মনে হয়, এডস নিয়ে আমাদের মতো অনেক মানুষই এখন যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু রোগীকে ঘৃণা করার ব্যাপারটা এখনও আছে। বছরে এক বার দেশের বাড়ি যাই। চাবি খুলে বাড়ি ঢুকি, রান্না করে খাই, আমার দাদার পরিবার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে।

(লেখকের নাম পরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

AIDS WORLD AIDS DAY
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE