Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার ‘খোঁয়াড়’: পাভলভ মানসিক হাসপাতাল

রোগিণীকে নগ্ন করে বন্দি রেখে ‘শান্তি রক্ষা’র চেষ্টা

পাভলভ আছে পাভলভেই! গত এক মাস ধরে এক মানসিক রোগিণীকে এই মানসিক হাসপাতালের একটি ঘরে নগ্ন অবস্থায় তালাবন্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছে। দিনে দু’বার সেই ঘরে শুধু খাবারটুকু পৌঁছে দেওয়া হয়। ভাঙা তারের জাল লাগানো ঘরটিতে বেশির ভাগ সময়েই গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন আঁখি নামের ওই রোগিণী।

ছবি এঁকেছেন সুমিত্র বসাক

ছবি এঁকেছেন সুমিত্র বসাক

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫২
Share: Save:

পাভলভ আছে পাভলভেই!

গত এক মাস ধরে এক মানসিক রোগিণীকে এই মানসিক হাসপাতালের একটি ঘরে নগ্ন অবস্থায় তালাবন্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছে। দিনে দু’বার সেই ঘরে শুধু খাবারটুকু পৌঁছে দেওয়া হয়। ভাঙা তারের জাল লাগানো ঘরটিতে বেশির ভাগ সময়েই গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন আঁখি নামের ওই রোগিণী। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে ঘরের বাইরে বার করার অনুরোধ করতে থাকেন। প্রতিদিনের এই দৃশ্য এখন পাভলভের কর্মীদের গা-সওয়া। অন্ধকার ঘরে দিনের পর দিন এই নির্বাসন ওই রোগিণীর অবস্থা আরও খারাপ করে তুলছে। কিন্তু সে নিয়ে কারওই বিশেষ হেলদোল নেই। উল্টে কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন, “মেয়েটির ভালর জন্যই এই ব্যবস্থা।”

কীসের ভাল? যে চিকিৎসকের অধীনে আঁখি ওই হাসপাতালে ভর্তি, তাঁর বক্তব্য, “মেয়েটি মাঝেমধ্যেই অন্য রোগিণীদের বিরক্ত করে। মারধর করে। অন্য রোগিণীরাও ওকে পাল্টা মারার হুমকি দিয়েছেন। তাই আঁখিকে বাঁচাতেই আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছি।”

এক নার্সের অভিযোগ, “ওকে ছেড়ে রাখলে আমাদের ঘরে ঢুকে ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ওকে বন্ধ করে রাখলে সকলেরই শান্তি।”

যদি কোনও রোগী সত্যিই বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তা হলে তাঁকে অন্য ভাবে সামলানোর দায়িত্ব কি হাসপাতালের নয়? নাকি যেনতেন প্রকারে তাঁকে চোখের আড়াল করে রাখাটাই দস্তুর? যদি বন্ধ করে রাখাই একমাত্র সমাধান হয়, তা হলে হাসপাতালের চিকিৎসা প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন ওঠে না কি? এই সব প্রশ্নের উত্তর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেননি।

তবে হাসপাতালে এমন ‘শান্তি’ রক্ষার জন্য সপ্তাহ দু’য়েক আগে এই পাভলভেই এক রোগীকে ছারপোকা মারা ওষুধের বিষ-গন্ধে ভরা ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। ওই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনতলার জানলার গরাদ ভেঙে পাইপ বেয়ে নীচে নেমেছিলেন তিনি। সেই নিয়ম ভাঙার শাস্তি হিসেবে তাঁকে একটা খাঁচার মতো ছোট ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। সেই খবর সামনে আসার পরে স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছিলেন, রোগীদের স্বাথর্রক্ষায় তাঁরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।

কিন্তু পরিস্থিতি যে এক চুলও বদলায়নি, এই ঘটনাই ফের তা প্রমাণ করল। আঁখি নামে ওই রোগিণীকে শুধু যে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে তা নয়, তাঁর পরনে একটা সুতো পর্যন্ত রাখা হয়নি। হাসপাতালকর্মীদের বক্তব্য, “ওকে বাঁচাতেই আমরা ওকে আলাদা করে রেখেছি।” বাঁচানোর জন্য সমস্ত পোশাক কেন খুলে নিতে হল? এক নার্সের কথায়, “জামাকাপড়ের ফাঁস দিয়ে যদি আত্মহত্যা করে বসে, তাই জামা পরাইনি।” অথচ যে ঘরটিতে আঁখিকে রাখা হয়েছে (সেই ছবি আনন্দবাজার-এর কাছে রয়েছে), সেখানে লোহার জাল ভাঙা। সেই জালের ধারালো অংশে যে কোনও মুহূর্তে মারাত্মক জখম হতে পারেন যে কোনও রোগী।

এর আগে পাভলভের রোগীদের মশারি থেকেও বঞ্চিত রাখা হয়েছে, তাঁরা মশারির দড়ি গলায় জড়িয়ে আত্মহত্যা করবেন, এই অজুহাতে। আত্মহত্যার ‘সুযোগ’ না দিলেও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু কিন্তু রোখা যায়নি!

মানসিক রোগের চিকিৎসায় দেশের অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান ‘রাঁচি ইনস্টিটিউট অব নিউরো-সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সস’-এর চিকিৎসক মসরুর জাহান বলেন, “কোনও সভ্য জায়গায় এমন হতে পারে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্পষ্টই নির্দেশ দিয়েছে, কোনও রোগীর সঙ্গে এমন আচরণের অর্থ তার মানবাধিকার খর্ব করা। তা ছাড়া মেন্টাল হেল্থকেয়ার বিল-এও এর বিরোধিতা করা হয়েছে। রোগী উত্তেজিত বা হিংস্র হয়ে উঠলে তাঁকে আলাদা রাখার ধারণাটা এখন সব দেশেই বিলুপ্ত হয়েছে।” শুধু তা-ই নয়, তাঁর প্রশ্ন, এ ভাবে আলাদা ঘরে বন্ধ করে রাখার প্রশ্নই বা উঠবে কেন? তিনি বলেন, “কম দামে ভাল ওষুধ এখন আমাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। সরকারি হাসপাতালেও সেই ওষুধ মজুত থাকে। ওই ওষুধ খাওয়ালে খুব দ্রুত রোগী শান্ত হয়ে পড়েন। বন্ধ করে রাখার প্রয়োজন পড়ে না।”

তা হলে কি ধরে নিতে হবে ন্যূনতম সেই ওষুধের ব্যবস্থাটুকুও এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে নেই? পাভলভ কর্তৃপক্ষ জবাব দেননি। আর কবে হুঁশ ফিরবে স্বাস্থ্য-প্রশাসনের? স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, “আমরা গুরুত্ব দিয়েই বিষয়টি দেখছি। কিছুটা সময় লাগছে। কিন্তু এগুলো কোনও ভাবেই বরদাস্ত করবে না সরকার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pavlov mental hospital soma mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE